Tuesday, September 10, 2013



এই কথা বৃষ্টিবাচক ॥ শামীম সাঈদ ॥ প্রচ্ছদ : জ্যোতির্ময় রায়
চিহ্নপ্রকাশনা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



___________________________________

নাসিমুজ্জামান সরকার



মেঘ-বায়ুতে আয়োজন করে জানিয়ে দেয় বার্তা, সেই বার্তার রেশ ধরে ঝরে যায় বৃষ্টি। এই কথা লেখা থাকে গাছের শাখায়, পত্র-পল্লবে, ভেজা মাটির বুকে। বৃষ্টির রেশ ধরে রাখে গাছের পাতায় জমে থাকা জলকণা। বাতাসের ঝাপটায় গাছ থেকে বৃষ্টিকণাগুলো ছিটকে পড়ে স্বরণ করে দেয় পূর্ববৃষ্টির ¯িœগ্ধতা। মেঘ, জলকন্যা, শ্রাবণধারা, নদী, ভেলা আনন্দ তাথৈ তাথৈ এইসব আলেখ্য থেকে যায় কবির স্মৃতিপটে, আত্মায়, মগজে ও মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহে। এইসব বৃষ্টিবাচক ইতিকথা প্রাণ পায় প্রিয়ার চোখে যখন তা বসবাস করে কবির হৃদয়ে। কবির চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনা হৃদয়ের সাথে সন্ধি করে- কথা হয়ে যায় বৃষ্টিবাচক। আমরা গান শুনে আনন্দ পাই। গান খুব বেশি বুঝে শ্রোতা বিচার করেন না গানটি কেমন। তবে তারা বেশ বলে দিতে পারেন গানটি তাদের মনের কথা বলে কিনা। প্রসঙ্গক্রমে কবিতার বেলায়ও কথাটা প্রায় ওরকমই। সুতরাং সমালোচনার মানদ- ধরে কবিতা পড়তে ঠিক তৃপ্তি হয় না। সাধারণ পাঠক হয়েই শামীম সাঈদের এই কথা বৃষ্টিবাচক কাব্যগ্রন্থটির ইতিকথা বলবো কিছুক্ষণ। এই কথা বৃষ্টিবাচক শামীম সাঈদের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। সন্ধালীন থেকে শুরু করে সমকালীন পর্যন্ত ক্রমানুসারে ৫৬টি কবিতা রয়েছে কাব্যটিতে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল খুব বেশিদিন আগের নয় (প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০১৩, চিহ্নমেলা এপার বাঙলা-ওপার বাঙলা)। অতি আধুনিক কবিদের হাতে ছন্দ পেয়েছে মু্িক্ত । ছন্দের বাড়াবাড়ি না করে মুক্ত ছন্দেই লিখতে পছন্দ করেন তারা। শামীম সাঈদও ব্যতিক্রম কিছু করেন নি। আর আধুনিক যুগের বর্তমান সময়ে তা সঙ্গতও বটে। তবে দু-একটি কবিতায় জায়গায় জায়গায় অন্তমিল দেখা যায়। সেকথা একেবারেই মুখ্য নয়। গ্রন্থটি সম্পর্কে একেবারে মৌলিক কিছু কথা বলা যাক। বইটির দু-একটি আদ্ধাত্মিক বা ভাববাদমূলক কবিতা যেমন- ‘প্রজাপতি’; ‘তাহা অধিজ্ঞান প্রত্নের সমান’ ব্যতীত প্রায় সব কবিতাই প্রেম বিষয়ক বা প্রেমের অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে প্রত্যেক কবিতাই যেন কবির হৃদয়ের অভিব্যক্তি যার সাথে একাত্ম হয়েছে কবির চিন্তা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রেমের অনুষঙ্গগুলো। স্থানে স্থানে কবি সংযোজন করেছেন উপমা আর একটি বিষয় চোখে পড়ে তা হল শব্দের প্রতীকী ব্যবহার। কবিতাগুলোতে কবির আত্মকথাই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। ইনিয়ে বিনিয়ে যেন কবি বলে চলেছেন ভাঙা ভাঙা শব্দে একের পর এক কেচ্ছা-কাহিনী। কখনো প্রিয়া হয়ে উঠেছে বেহুলা আর কবি আজন্মের লখিন্দর। এভাবেই কবিতার বুনন তৈরি হয়েছে একের পর এক। এই প্রয়োজন থেকেই বিভিন্ন কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের সেই পুরোনো মিথ। এমনকি গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে এইভাবে-‘ফারজানা আফরোজ শ্রাবণী আমার বিতংস বেহুলা, প্রিয়তমা বিষহরী’ এইভাবে কবি হয়ে উঠছেন লখিন্দর, প্রিয়াকে কল্পনা করছেন বেহুলা আর কবির কল্পনা শুধু ইহলোকেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। ইহলোক ছেড়েপুনর্জন্মেও সংসারী হওয়ার বাসনায় বিভোর হয়ে ওঠেন কবি: বিষহরী! পুনর্জন্ম পেলে তোমায় নিয়ে হবো সংসারি/ চিনে নিও চুম্বন চিহ্নে- আজন্মের তোমারই লখিন্দর [সমকালীন] প্রেম প্রতিপাদনে কবি শুধু দেহহীন লাবণ্য বর্ণনায় মগ্ন থাকেন নি, রক্তমাংসের আক্রমণ তাঁকে পীড়া দিয়েছে, ক্রমাগত দগ্ধ করেছে-‘সেই পীড়ায় প্রেমসুখ আছে আর তা মিশে গেছে দেহে, অস্তিত্বে এবং শূন্যে। উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতির বাইরে একটি ত্রিমাত্রিক অবস্থার কথা বলা হচ্ছে আর সেখানেও তা শূন্যের মতো মিশে থাকেÑনিয়ত তুমিতে লেপটে থাকি/তোমাকেই ছুঁয়ে বলি- আমি প্রস্তুত/ এস, যে রকম অবয়বে তুমি শূন্য/ উদ্বাহু বলি আমি- আছো যদি/ নাই কে বলি অটুট অধরা পরিস্থিতি/ দেহের মধ্যে শূন্যে মিশে থাকো যথারীতি  [অধরা] আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা, কল-কারখানা, উন্নত প্রযুক্তি, ইট-পাথর মানুষের জীবন থেকে দানবের মত গ্রাস করে চলেছেপ্রেম,আবেগ, মায়া-মমতা এইসব। অথচ নাগরিক জীবন-যাপন করেও প্রকৃতির দানকে উপেক্ষা করতে পারেন নি কবি। তাঁর কবিতায় প্রতীকে, উপমায় অসংখ্য প্রাকৃতিক রূপকল্প লক্ষ্যণীয়। যান্ত্রিক সভ্যতার খ্যাচখ্যাচানি, রাজনীতির ভনভনানি শামীম সাঈদের কবিতাকে একঘেয়ে করেনি মোটেও। কবিতায় তাঁর সরল স্বীকারোক্তিই পাওয়া যায়। তাঁর কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে এক রকমের বিলাপের সুর- তা যেন কবির একান্তই নিজের, আত্মার অন্তস্থলের গূঢ়কথা। কবির এই আত্মবিলাপের ভঙ্গিটিই পাঠক হিশেবে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে আমাকে। এছাড়া উপমা-প্রতীকে এবং কিছু কিছু চরণের অভিনবত্বে কবিতাগুলো নাড়া দিয়েছে নাজুক ইন্দ্রিয়গুলোতে যেখান থেকে নিঃসরিত হয়েছে অবিরাম আনন্দ। এমনই কিছু উপমা, অলঙ্কার ও প্রতীকী শব্দের কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক: ঢাকিয়াল মেঘ, সুলক্ষণা সেউজগাড়ি, নিশুতির মধুমালা, কালের মান্দাসি, ইথার আঙিনা, উড়ালি আঁচল, রৌদ্র অরণ্য, বাঁকা বাতাস, বিজনের বুক, ধারা জল প্রভৃতি। কবিতায় কিছু চরণ আছে যেগুলো একবার পড়লেই নেশা লাগে, প্রতিনিয়ত পড়তে ইচ্ছে করে আর শেষবেলাতে থেকে যায় ঘোর। এমন কিছু চরণের কথা বলা যায়Ñ‘তোমার অবোধ আঁচলে খেলে জোছনা ভাটিয়ালি/আমার কিছু ইচ্ছা জ্বলে তারার সায়রে [নিশুতির মধুমালা] ‘এই কথা বৃষ্টিবাচক ঝরে যাবে পাতার অন্ধকারে/প্রতিশ্রুতি জেনেছি বৃন্তচ্যুত ভোরে [মেঘাঙ্কুর রচিত ভুল] মর্মর বিভবে জৈব বিস্ময়/ ছুঁয়ে দেখি- ছুঁতে গেলে উড়ে যায় প্রজাপতি! [প্রজাপতি] এমন আরও অনেক চরণ আছে যা পাঠক মাত্রই ভালো লাগবে। কবি লিখে আনন্দ পান আর সেজন্যই হয়তো লিখেন। তবে কবির কবিতা পড়ে পাঠকের আনন্দ পাওয়ার ব্যাপারটি একটু ভিন্ন রকম। কবির চিন্তা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি প্রকাশ পায় কবিতায়। পাঠক যখন তা পাঠ করে তখন স্বভাবতই কবিকে সে ভুলে যায়। কবিতার সাথে মিলিয়ে নিতে চায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি। সেজন্যই হয়তো ভালোলাগার ব্যাপারটি পাঠক হতে পাঠক ক্রমাগত ভিন্নতর বা মৌলিক বিষয়গুলোতে এক। আর এই কাব্যের ক্ষেত্রে যেটা মনে হয়- কাব্যটির প্রায় সব কবিতাই যেহেতু প্রেম এবং প্রেমের অনুষঙ্গ অনুভূতির অভিব্যক্তি সুতরাং তা সকল পাঠককেই কমবেশি নাড়া দেবে। আর সেজন্যই টেস্ট গ্রহণে কবিতাগুলো ভিন্ন রকমের। কবিতার ভালোলাগার বিষয় নিয়ে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন কবিতার অসঙ্গতি এবং মানের বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক। একটি বিষয় ঠিক পরিষ্কার হওয়া যায় না যে, অতি আধুনিক কবি বলে যারা নিজেকে দাবি করে থাকেন বা আমরা যাদেরকে বলে থাকি কোন বিষয়টিকে এক্ষেত্রে প্রতিপাদ্য করা হয়? উত্তরটি- শব্দ ও ভাষার ব্যবহারে নাকি ভাব ও অভিব্যক্তি উপস্থাপনে অভিনবত্বে, কোনটি? খুব খারাপ লাগে যখন দেখি এখনকার কিছু কবি অভিধান থেকে ছেঁকে তোলা কঠিন কিছু শব্দ এবং পারিভাষিক শব্দ বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে কবিতাকে আধুনিক করে তুলতে চান। হয়তো তারা ভেবে থাকেন কবিতাকে যতো অস্পষ্ট, জটিল এবং বিমূর্ত করা যাবে কবিতা ততোই আধুনিক হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে তারা যে বিষয়টিকে আশ্রয় করেন তা মূলত শব্দ। কঠিন কঠিন শব্দের ব্যবহার, একটি শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের অর্থের অসামঞ্জস্যতা, এক চরণের সাথে অন্য চরণের অর্থ ও বক্তব্যের মিলগত যোগ্যতার অভাব বেশিরভাগ সময়ই কবিতার ভাব এবং বিষয়কে প্রচ্ছন্ন করে রাখে। তাই কবিতা পড়ে প্রথমে মনে হয়- বাহ্! বেশ তো। কিন্তু অর্থ বুঝতে গেলে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় বা বক্তব্য এবং কবিতার ভাব সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় না। উপমা এবং প্রতীকের ব্যবহার তাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। ভাষা ভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। ভাষা এবং উপমা-প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে কতোটা সাযুজ্য দান করতে পারে তাই দেখার বিষয়। খুব যত্ন করে একটি চারাগাছ লাগিয়ে পরিচর্যার খাতিরে মাটি আলগা করতে হয় ভালো কথা। এতে গাছ পুষ্টি পাবে। কিন্তু এতে করে শেকড়টাই যদি কেটে যায় তবে ফল কি শুভ হবে? নিশ্চয় নয়। শামীম সাঈদের প্রথম দিককার বেশিরভাগ কবিতাতে এই সমস্যাই প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। আর গোটা কাব্যজুড়ে দু-একটি জায়গা ব্যতীত কোথাও কোনো বিরামচিহ্ন নেই। ভাব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনের জন্য বিরামচিহ্নরও তো প্রয়োজন। কলম ধরে ধরে এসব শব্দ, চরণের অর্থ দেখিয়ে অসঙ্গতিগুলো দেখানো যেতো। এটা করে রচনা দীর্ঘ করতে চাচ্ছি না। কবি এবং পাঠকগণ আমার বক্তব্য নিশ্চয় বুঝে থাকবেন। ঋতুচক্র এবং প্রাত্যহিক দিবস ও রজনীর মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বে আবদ্ধ মানুষের জীবন। দিন ও রাতের মধ্যবর্তী উষ্ণতা এবং আর্দ্রতা ছেঁকে পৃথক থাকতে চান ধার্মিক আর সেই উষ্ণতা এবং আর্দ্রতায় দগ্ধ হতে চান শিল্পী। ধার্মিক এবং শিল্পীর মৌলিক পার্থক্য মূলত এখানেই। ধার্মিক যেখানে নিজেকে রাখতে চান তফাতে শিল্পী সেখানে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়ে সেই দহন থেকে সৃষ্টি করেন শিল্প। এই শিল্পসৃষ্টির উল্লাস শুধু সাহিত্য নয়, সাহিত্য ছাপিয়ে সুর, সংগীত, চিত্র এমনকি বিজ্ঞানকেও স্পর্শ করে। শিল্পীর দায়বদ্ধতা কিছু থাকতে পারে তবে স্বেচ্ছাচারিতার প্রয়োজনই বেশি। সুতরাং শিল্পসৃষ্টিতে শিল্পমার্গ বলে কিছু নেই। বিলম্বিত লয়ে কি আর বিড়ম্বিত মন/ শিল্পমার্গ চুলায় যাক না/ শিল্পী বসে রং মাখাবে চুলে। [অনুষঙ্গ আলেখ্য] আমিও শিল্পীর সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শামীম সাঈদের এই কথা বৃষ্টিবাচক গ্রন্থে কিছু অসঙ্গতি, ভাবের গভীরতার অভাব এবং বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার অনুপস্থিতি হয়তো কাব্যটি শিল্প শিখরে পেীঁছানোর জন্য অন্তরায় তবুও ভালোলাগার খাতিরে কাব্যটি প্রশংসার দাবিদার বলতেই হয়।






বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা : মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন ॥ রকিবুল হাসান ॥ প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা ॥ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন ॥ ঢাকা 


_________________________________________________________
শহীদ ইকবাল

উপন্যাস জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। উপন্যাসের জনপ্রিয়তার শর্তও এর মধ্যেই নিহিত। কাহিনিগদ্যে যে রোমান্স-এ্যডভেঞ্চার ও অপূরণীয় জীবনকে সন্ধান করা যায় অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। নবকুমার ‘অকস্মাৎ বনমধ্য হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলেন যে, সম্মুখেই সমুদ্র’Ñ প্রভূত রোমাঞ্চে তা পরিণত, আছে অখণ্ড বিস্ময়। উপন্যাসের জনপ্রিয়তার সূত্রটি কোথায়? বলা যায়, এমন স্তম্ভিত আকস্মিকতায়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল। বঙ্কিমকে বলা হয় ‘বাংলার স্কট’। কিন্তু দেশীয় ঐতিহ্য তার ধর্ম। বঙ্কিম-ধারার মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) ঔদার্য ও উন্মুক্ত জ্ঞানে বাংলা গদ্যরীতিকে উপন্যাসের কাহিনিতে প্রবিষ্ট করেন। বিষাদ-সিন্ধু শুধু পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস নয়, একটি ধর্মভাবাপন্ন আখ্যানও বটে। বিষাদ-সিন্ধুর লেখক তাতে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার এমন ধারা ও তার চিত্র-অনুসন্ধানী রকিবুল হাসানের উদ্দিষ্ট গ্রন্থটি। মুসলিমরচিত বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা : মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন-এ চিহ্নিত হয়েছে একদিকে তত্ত্বগত আলোচনা অন্যদিকে আমাদের উপন্যাসের ধারায় কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান, আকবর হোসেনের খ্যাতিমান কর্মযজ্ঞের স্বরূপ ও সীমানার রূপায়ণ-প্রয়াস। গ্রন্থটি আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে দুটো প্রত্যয়, এক. বাঙালি মুসলিম উপন্যাসকার ও আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশপর্ব, দুই. জনপ্রিয়তা ও উপন্যাস। রকিবুল হাসান একদিকে ইতিহাসের পরিচর্যাটুকু তুলে ধরেন অন্যদিকে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম উপন্যাসকারগণের রচনার স্বরূপে তার শিল্প-প্রক্ষেপণটুকু ধরিয়ে দেন। এতে আরও একটি অনুষঙ্গ ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি কায়েম করে বাঙালি মুসলমানের ঔপন্যাসিক ভিত্তিটুকু জোরালো করে তোলেন। প্রসঙ্গত এ পাঠ জ্ঞানভিত্তিক, একাডেমিক। উচ্চতর বিদ্যাপীঠে জনপ্রিয় উপন্যাস এবং বাঙালি মুসলিম লেখকÑ এরূপ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নধর্মী জ্ঞানচর্চা কম নজরে আসে এবং তা অবহেলিতও বটে। যা হোক, সেই মীর মশাররফ থেকে এই চল্লিশের লেখক আকবর হোসেন আমাদের সম্মুখে দাঁড়ান জনপ্রিয় উপন্যাস লেখকের খ্যাতি নিয়ে। বক্ষ্যমান গ্রন্থে পূর্বাপর জনপ্রিয়তা শুধু নয় এরূপ লেখকের শিল্পমন ও মেধাও প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। তাতে শুধু বিবরণ নয়, যুক্তিসঙ্গত রূপে দেখিয়ে দেন কীভাবে তাঁরা লিখেছেন, কীরূপে ওই পশ্চাৎপদ সমাজের দ্বন্দ্ব-দ্বিধাকে শিল্পরূপ দিতে সক্ষম হন। ‘শিল্পরূপ’ আর ‘জনপ্রিয়তা’ এক কণ্ঠে কী করে চলে? একইভাবে মনে করিয়ে নিতে চাই, এই আলোচ্য বাঙালি মুসলমান লেখক আর চর্চিত ভূমি-ভূখণ্ডের প্রতিবেশ! তাঁদের রচনার সময়কাল উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। এ সময়টি প্রচুর রদবদল ও রূপান্তর যেমন ঘটে চলে তেমনি বৈশ্বিক উত্তাপে আমাদের মূল্যবোধে সংঘাত ও অভিঘাত জোরাল হয়ে ওঠে। রকিবুল হাসানের বইয়ে এসব প্রসঙ্গ আছে। তাঁর ব্যাখ্যা নিজের কিন্তু আমি ওতে পার্থক্য করি, ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করতে পারি- বলতে পারি আলোচনাটুকু এমনটা তুল্যমূল্য তিনি না করলেই পারতেন। তাতে হয়তো তর্ক-বিতর্ক তৈরি হবে, সৃজিত হতে পারে এ পরিপ্রেক্ষিতের আরও অধিক জ্ঞান, বোধ করি এমনটা আরও অনেকেই সামিল হবেন, বলবেন নিজের কথা, ভেদ বুঝিয়ে পার্থক্য জানাবেন আর সে কারণেই এ বিষয়ক অপরপাঠ-পাঠপুঞ্জ।

মুসলিমরচিত বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা : মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন বইটিতে- ‘মুসলিম’ শব্দটি আপত্তিকর, একইরূপে ‘জনপ্রিয়’ কথাটিও। উপন্যাস পঠনে মুসলিম-অমুসলিম কী, বা জনপ্রিয় অ-জনপ্রিয় কেমন কথা! ক্লাসিক উপন্যাসগুলোইবা কারা লেখেন? এখানে কি এসব আলোচ্য বিষয় হতে পারে? জবাবটি এমন-পারে বৈকি। এরও কারণ ও প্রেক্ষাপট আছে। কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামের লেখক মীর মশাররফ হোসেন আর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র দুই ব্যক্তিত্ব এক নন। যে ভূমি-সংস্কৃতির শাসনে তাঁদের বেড়ে ওঠা তাও এক নয়। কার্যত দেখি না, বঙ্কিম থেকে সাতচল্লিশ-পূর্ব পর্যন্ত এমন মাপের (রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভূষণ প্রমুখ ‘হিন্দু’) কোনো মুসলিম উপন্যাসকার- শুধু বিষাদ-সিন্ধুর লেখক ছাড়া। তখনই রকিবুল হাসানের নিকট সমুপস্থিত হয় ‘মুসলিম’রচিত শব্দবন্ধ এবং এর পরিপ্রেক্ষিত যাচাই প্রসঙ্গটি। বাঙালি মুসলিম স্বরূপ, তার শিল্পশক্তির সামর্থ্য, দ্বিধা-সংশয়-বিরোধ, ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, উদার ও অসাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে রক্ষণশীল-সংস্কারের সংঘাত- বিষাদ-সিন্ধুতে কম নয়, আরও পরে আমাদের নজিবর রহমান, ইসমাইল হোসেন সিরাজী বা আকবর হোসেনের লেখায় বিস্তৃত। সেটি রকিবুল হাসানের গ্রন্থের মধ্যে বিদ্যমান থাকে- স্বরূপে। অবাঞ্ছিত কেন, কীসের দ্বন্দ্বে? আনোয়ারার প্রতিরোধ কী, কোন্ সমাজের সংস্কারে সে অবরুদ্ধ- প্রভৃতি প্রশ্নসমূহ বিশ্লেষ্য করে তোলেন- কাজেই তখন ‘মুসলিম’ প্রসঙ্গটি সমাজ-ইতিহাসের সূত্রে আর খারিজ করা যায় না।

আগেই উল্লেখ করেছি, উপন্যাস কাহিনিগদ্যের কাঠামোয় নির্মিত। তাতে ঘটনা, রচন-বিরচনে এই মুসলিম কথাকারগণ সীমাবদ্ধতায়-দ্বিধায়-দ্বন্দ্বে উঠে এসেছেন। এতে পেয়ে যাই, এই ভূখণ্ড-যেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছি কর্পোরেট সুবিধার ভেতরে। চিন্তা করতে পারি কি- এই ঢাকাকে সাতচল্লিশ-পূর্ব সময়ে; যখন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন বিতাড়িত হচ্ছেন, ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র প্রজ্বলিত “শিখা”- কতোইনা প্রতিরোধে তাঁরা সাহসী ছিলেন মুষ্টিমেয় ক’জনা? উপন্যাসে তো তাই ছিলো, এ অঞ্চলের ভাষাটি, যে মায়ের ভাষা তার শঙ্কামুক্ত উচ্চরণও ছিল দ্বিধান্বিত! রাষ্ট্রশক্তির কর্তৃত্বে কখনো ফারসি, কখনো উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিভ্রান্তি তৈরি করে শ্রেণিশক্তি ওই ভাষা নিয়ে। মুসলমান- তার আত্মপরিচয় কী- তার সংস্কৃতি কী- তার লেখালেখি বা শিল্পচর্চা কোন্ ভাষায়- এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-বিভ্রান্তি কম হয়নি। এতে ভাষা নিয়ে রাজনীতি যেমন তৈরি হয় তেমনি তাতে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করে কর্তৃত্ব ও ভোগবাদি শক্তি- কখনো রাষ্ট্র বা শ্রেণিশক্তির লেজুড়বৃত্তিতে। সেক্ষেত্রে পূর্ব-বাংলার লোকায়ত-সংস্কৃতি ও তার প্রকৃতির দস্তুরকে বাঙালি ও বাংলা ভাষার নৃ-ঐতিহ্য-ইতিহাসের স্পষ্টতায়, অনুভবের আখরে অনিবার্য বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠা পায়- পূর্ব-পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরোধী জনতার প্রতিরোধে, যার পরিণাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এই স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রটি। তাই আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রটির লেখককে ‘মুসলমান’ পরিচয়টি দিতে হয় না। তবে সেটি প্রতিষ্ঠার গোড়ায় যে প্রতিরোধ-সংশয় তা পেরোতে হয়েছে রকিবুল হাসানের উদ্ধৃতিবন্দি লেখকদের। কাজী আবদুল ওদুদের নদীবক্ষেও তো অন্তরস্থিত শিল্পবিশ্বাসে লেখা হয় না- কেন? প্রশ্নটি গ্রন্থকারের ভাষায় বলি :

নদীবক্ষে একটি ফ্ল্যাট উপন্যাস। উপন্যাসের যে বাস্তবতা বা জীবনাগ্রহ দরকার তা কিছুতেই তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়নি। আর তা স্বাভাবিকও ছিল না। অথচ তাঁর সাহিত্যরুচি ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহ ছিল তুলনারহিত। সংস্কারাচ্ছন্নতা বজায় ছিল মুসলিম লেখকদের। ... চরিত্র যখন সংকটে পড়ে তখন লেখককে বিচলিত হতে দেখা যায়। ... উপন্যাসে গদ্যও বেশ সতর্কিত।

এমনটিই তো মুসলিমরচিত লেখকের বৈশিষ্ট্যগণ্য। আর জনপ্রিয়তা? তা আটকায় এই ধরনের অবরুদ্ধ সমাজ-কাঠামোয়! উপন্যাস এ কারণে জনপ্রিয়। কিন্তু পেতে হবে তার ভেতরের প্রতিশ্র“তি। আকর্ষণীয় চরিত্র সৃষ্টি করে তুখোর জনপ্রিয় হন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এখন তো আমরা সকলেই চিনি হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁরা খুঁজে দেখান চরিত্রের প্রতিরোধ, প্রাণদায়িনী সম্ভাব্য রূপ। সংজ্ঞা স্মরণ করি : অ হড়াবষ ফড়বং হড়ঃ পড়াবৎ ঃযব যিড়ষব ষরভব নঁঃ ধ হড়ঃধনষব যধঢ়ঢ়বহরহম রহ ষরভব, ড়ভ ধ শরহফ যিরপয যধং সধফব ষরভব ৎবাবধষ রঃংবষভ রহ ধ নৎরষষরধহঃ ভড়ৎস, ফবংঢ়রঃব ঃযব ভড়ৎসধষ ংঢ়ধঃরধষ ষরসরঃং. উল্লেখ করেছি, এখনকার ঔপন্যাসিককে ‘মুসলিম’ পরিচয়ে বলি না, একালে তা বলার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু মশাররফ থেকে আকবর হোসেন পর্যন্ত ঐতিহাসিক-বীক্ষণে তাকাতে হয়। তাঁদের রচিত উপন্যাসের যে কাহিনি-চরিত্র তা সপ্রতিভ বলা যেত বোধ করি ‘মুসলিম’ ঔপন্যাসিক আখ্যার কারণে। উদ্দিষ্ট গ্রন্থটির অধ্যায় বিভাজন-ক্রমে সে ইঙ্গিত আছে। এর ভেতরে উপন্যাসের করণকৌশলের সপ্রভ-নিষ্প্রভ ব্যাপারটিও চিহ্নিত হয়েছে। সবটুকু প্রমাণে মেলে মুসলিম অভিধায়।

এই বঙ্গদেশে উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হওয়া দুরূহ। মীর মশাররফ হোসেন জনপ্রিয় বিষাদ-সিন্ধুর দ্রষ্টা। এর শিল্পরীতিতে প্রথম উঠে আসে মুসলিম জীবনাচার পুরাণ ইতিহাস। প্রভূত রোমাঞ্চ-কল্পনা আর কিংবদন্তী-কল্পনায় বাধা এর কাহিনি। ‘কৌতুকাবহ গল্প’ বলেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায়। সপতœী-বিদ্বেষ পুরাতন অনুষঙ্গ কিন্তু তাতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা অপ্রতিরোধ্য। মশাররফে নন্দনজ্ঞানের স্বরূপে গ্রন্থকার লিখেছেন : নিজের পরিবার দ্বন্দ্বই সেখানে বিদ্যমান। কিন্তু শিল্পের তুলিতে তা কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে আবদ্ধ থাকেনি। হয়ে উঠেছে বাঙালির চিরন্তন জীবনবার্তার অমোঘ সত্য।’ প্রাত্যহিকতার বাইরে তাঁর রচনার যে বিশাল আয়োজন, দুন্দুমার যুদ্ধ-দামামার আঘাতে সত্য-মিথ্যা-বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদির পার্থক্য ঘুচে গেছে-দুর্বার বেগে পুরো জয়-পরাজয় দৃশ্য পরিবেশিত হতে থাকে। নবী-দৌহিত্রের ন্যায়যুদ্ধ। এ যুদ্ধটি কারবালায় সংঘটিত হওয়ার ইতিহাস সেটি সকলের জানা কিন্তু তা এ দেশীয় করার জন্য কী ধর্মীয় আদলের ভেতরে বা তার বিবাদ-সংশয়-প্রেম অমোঘ করে তোলা হয়নি? এর জন্য আজগুবি, ফ্যান্টাসী, রোমহর্ষক উচ্ছ্বাস, কিংবদন্তী মিলে মনে হয় এক কুরুক্ষেত্র। ঠিক সেখানে প্রতিষ্ঠিত ন্যায়যুদ্ধ, সত্যের পক্ষে, নীতিবোধ নিরূপণের ক্ষেত্রে-বিষাদ সিন্ধু অপরূপ শিল্প। সেখানে জনপ্রিয়তার স্বরও এরকম কারণেই। রকিবুল হাসান তার গ্রন্থে সেটি কাল-স্থাপনার নিরিখে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক্ষেত্রে  বিষয়-নির্বাচনটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মীর কীভাবে শক্তিশালী? বড়ো শিল্পীর গুণ তিনি কীভাবে আয়ত্ব করেন! আর বিষাদ-সিন্ধুইবা কীভাবে অনিবার্য পাঠ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ওই কালে, ওই জীবন¯্রােতে? আমরা রকিবুলের লেখায় পাই বঙ্কিমযুগে হিন্দুসমাজ যে নবচিন্তার প্রসারের সঙ্গে যুক্ত হলো, তাতে নিজ ধর্ম-ঐতিহ্য-জাতীয়তা স্বাতন্ত্র্য জিজ্ঞাসা পেতে শুরু করে- নানা লেখায়, বিবিধ রচনায়। পাশাপাশি মুসলিম সমাজ যে কূপমণ্ডূকতার মধ্যে রইল, তার অনাধুনিক প্রবণতার স্বর তাদের অন্ধতার কূপে আটকে থাকল সেখান থেকে মুক্তির উপায়-উপলক্ষ সে অর্থে তেমন জানা ছিল না বৈকি। সেভাবে চিন্তা করাও দুষ্কর ছিল। মীর মশাররফ বড় শিল্পীর মহিমা পান এরূপ বিপরীত কাল¯্রােতে দাঁড়িয়ে শিল্পীর দস্তুর হিসেবে বঙ্কিম-অনুসৃত পথ বেছে নেন। এবং একই সঙ্গে নিজ ধর্ম-আনুকূল্যে পুঁথির প্রশ্রয়ে ফিরে যান কারবালা-দামেস্ক-ফোরাত প্রান্তরে। মুসলিম পুরাণ-ঐতিহ্য কথাশিল্পের কাঠামোতে ধারণ করে একপ্রকার লোকায়ত জীবনচেতনার প্রকট সংজ্ঞার্থকেই। যেখানে বস্তুত তিনি একা, একক। কিন্তু যে সত্যটি তখন সৃষ্টি হলো, তা মুসলমান ও বাঙালিত্ব অভিন্ন আর বাংলা ভাষা এই ভূখণ্ডের লোকায়ত জনচিত্তের প্রতিশ্র“তি। জনপ্রিয়তাও সে ভিত্তিতেই। বিষাদ-সিন্ধুর মীর মশাররফ যে সমাজ-অভিজ্ঞতার রূপটি তুলে ধরলেন তা বিচিত্র বিষয়ের সমাহারে বাস্তব ও জীবন্ত। মুসলিম সমাজের আপামর জনতা তা গ্রহণ করেছে। অনেককাল তার ধারা চলেছে- অনেকের মাঝে। বলতে হয়, এটি কী সত্যিই উপন্যাস? তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নিশ্চয়ই বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের ট্রিটমেন্ট এতে নেই। চরিত্রসৃষ্টির কল্পনা বা আবিষ্কারের শক্তি সর্বোপরি ব্যক্তি-মানুষ তৈরির অবতারণা সেভাবে বিষাদ-সিন্ধুতে ধরা পড়ে না। মনে হয়, ধর্মীয় আচরণের ভেতর নিষ্পাপ কিছু মানুষ (যারা একইসঙ্গে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী) যুদ্ধ করছে পাপিষ্ঠ-অন্যায়-অনাচরের বিপক্ষে। এখানে বৈপরীত্যের তত্ত্বে ন্যায়-অন্যায়, শ্রেয়-অশ্রেয়, সুখ-দুঃখ, পাপ-পূণ্য এমন আদর্শে সৃষ্টি হয়েছে চরিত্র। সত্যপক্ষ প্রবলভাবে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট, ক্ষমতার অধিকারী তারা অলৌকিকভাবে, জয় তাদের অনিবার্য। এ কাঠামোবন্দী কাহিনিতে এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক অযৌক্তিক ঘটনা ঘটে যায় অবলীলায়- প্রতিষ্ঠিত সত্যের পক্ষে। রোমাঞ্চ দানা বেধে ওঠে। সীমারের হস্তে হোসেনের মস্তক শিহরণ সৃষ্টি করে- উচ্ছ্বাসময় গদ্যের ভেতরে। তীব্র ও তীক্ষèধি উচ্চারণে তপ্ত হয়ে ওঠে কারবালার রক্তাক্ত প্রান্তর। দুলদুল ঘোড়া, কাসেম-সখিনা, মাসহাবকাক্কা, এজিদের পরাজয় স্বকপোলকল্পিত। মুখরা বর্ণনাই এর সত্য, বাদবাকী অসত্যের চাদরে মোড়া। এ কারণেই স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মুসলিম সমাজে, ধর্মানুগত্যের সংস্কারে, পশ্চাৎপদ সমাজে এ কাহিনির চর্চা ও পরিচর্যা তুমুল বেগে ও আবেগে ধাবিত। বহুকাল পর যেন মুসলমানগণ তাদের মনে কথা শুনতে পেল, আদর্শের চরিত্র হাতে পেল, বুকের কম্পনে স্থিরতা আসল- মীর মশাররফ শ্রেষ্ঠত্বের এবং জনপ্রিয়তার বাদ্যিতে অন্যরূপা হয়ে উঠতে সক্ষম হলেন। এটি ঘটে চলে একটি বিশেষ সাধারণ সমাজে। আমাদের ভূমিতে, লোকায়ত দর্পিত জীবন¯্রােতে। এককরূপে। কিন্তু বিপরীতে রবীন্দ্র-শরৎ-মানিক চিন্তনে যে চরিত্র তা পূর্ণায়ত সমাজসম্ভূত, জনপ্রিয়তার তল অন্যকোটির। এমনটা সত্য, শরৎচন্দ্রের দেবদাসের পাশাপাশি বিষাদ-সিন্ধুও অধিক বিক্রিত উপন্যাস। কিন্তু উপন্যাস-সংজ্ঞার্থে চরিত্রসৃজনে ও প্লট-নির্মাণে তাঁদের উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য ধারায় ব্যক্তি সৃজন। মীরের চেতনায় নিজ সমাজ ছাড়া তা কখনোই অনুসৃত হয়নি। ফলে মীর মশাররফ হোসেন প্রাচ্য-আচারধর্মে অনুসৃত এবং স্ব-সমাজের আধারে নির্ধারিত কাহিনি-চরিত্র- এবং তাতেই তার সাফল্য ও জনপ্রিয়তা। ব্যক্তি-মানুষের পরীক্ষা অবচেতনভাবে বঙ্কিম-অনুসৃত পথে হয়ে থাকতে পারে কিন্তু তা উপনিবেশগত ধারায় নয়- যেটি তার পক্ষে সম্ভবও ছিল না। বাঙালি মুসলিম উপন্যাসকারদের মধ্যে তাঁর সম্পদ নিয়েই তিনি পুরোধা- সন্দেহ নেই। সৃষ্টিশীল আবিষ্করণের গুণে নিশ্চয়ই তিনি তার ধর্ম-সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে সমগ্র হয়ে ওঠেন- উপন্যাস-সাহিত্যের পরিমণ্ডলে। যে কহিনিগদ্যের উদ্ভাবন তিনি ঘটান তা উদার ও উচ্চমাপের শিল্পগুণে, সেখানে তাঁর কৃতিত্ব একক এবং অপরিমেয়। বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারায় তিনিই প্রথম, পরে যেটি শরৎচন্দ্র হয়ে সম্মুখে আরও এগিয়েছে। গ্রন্থকারের চিহ্নিত মশাররফ যথার্থ ও সঙ্গত, অপরিহার্য। প্রমাণ, শতবর্ষ পরেও বিষাদ-সিন্ধুর অব্যাহত জনপ্রিয়তা।

আনোয়ারা ‘নীতিধর্ম পালনের যান্ত্রিকতায় আনোয়ারা পরিণত হয়েছে প্রাণহীন শুষ্ক পুতুলে। বালিকা হৃদয়ে প্রণয়-অনুরাগের উন্মেষ ঘটিয়ে লেখক তার চরিত্রে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা পরিণতি পায়নি’- এমন বিশ্লেষণ মেনে নিয়েও বলা চলে- ‘ঘড়াবষ ফড়বং হড়ঃ মরাব ধহংবিৎং, রঃ ড়ভভবৎ ঢ়ড়ংংরনষরঃরবং’ সেটি সম্ভব হয়ে উঠেছে নজিবর রহমানের লেখায়। জনপ্রিয়তার কয়েকটি কারণও আছে : এক. নীতিশিক্ষা বা হিতসাধন, দুই. ধর্ম-নীতিবহির্ভূত মানবিক প্রেম, তিন. অন্তঃপুরের সচিত্র রূপায়ণ। আনোয়ারা সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেও পরের উপন্যাসসমূহেও প্রেম-রোমান্স-দাম্পত্য পরাকাষ্ঠা অবিদিত নয়। বিশ শতকের গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতির চলচ্চিত্রায়ণই মুখ্য। রকিবুল হাসান উপন্যাসকারের সীমাবদ্ধতা ও সাফল্য চিহ্নিত করেছেন। তথ্য-উপাত্তের আধারে ইতিহাসে তার গুরুত্ব দেখিয়েছেন। কাজী ইমদাদুল হকের প্রসঙ্গ তেমন আলোচিত হয়নি। অবশ্যই তার প্রয়োজন ছিল।

আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত জনপ্রিয় হয়েছিল। আকবর হোসেন ও মীর মশাররফ হোসেন একই অঞ্চলের বাসিন্দা কিন্তু স্বতন্ত্র ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, চর্চা করেছেন ভিন্ন বোধ। মধ্যবিত্ত ঘরের কাহিনি নিয়ে লিখলেও নজিবর রহমানের ভঙ্গুর সামন্ত গ্রামীণ পটচিত্রে লিখিত সাধু ভাষার চালটি তিনি গ্রহণ করেননি। এমনটি আকর্ষণীয় এই কারণে যে, সামন্ত ভঙ্গুর সমাজের বিপরীতে যে আধা-পুঁজি প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ‘ব্যক্তি’র আচারণ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে- নানা ভোগবাদী বা লালসার সামগ্রীর ভেতর দিয়ে পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ব প্রকটরূপে দেখা মিলছে- এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে। রকিবুল তার গবেষণায় উল্লেখ করছেন : ‘বিচ্ছিন্ন মানুষ, উন্মূল মানুষ, কিংবা মধ্যবিত্তের হতাশা স্বাধীন বাংলার বৈশিষ্ট্যে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে লেখকের ভাষ্যে।... সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে প্রায়োগিক আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, ধর্ম-বর্ণের বা নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব, মানবাধিকার ইত্যাদি অনেক বিষয়ে বিশ শতকের প্রথমার্ধেই তিনি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’

আকবর হোসেন অনালোকিত লেখক। কিন্তু বেশ কিছু উপন্যাসে পুঁজিবাদের প্রকৃতি ও স্বভাব নির্ণয়ে তিনি সক্ষম হয়েছেন। এ সক্ষমতার স্বরূপ কী? মধ্যবিত্ত নিয়ে নিরন্তর নিরীক্ষা! প্রত্যেকটি উপন্যাসেই সেটি প্রকাশ্য। এক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি দোষও আছে। রকিবুল তা তুলে ধরেছেন। কিন্তু মধ্যবিত্তের দ্বিধা-দোলাচলতা, সংশয়-লালসা-ভোগ-প্রবৃত্তি আকবর হোসেনের মুখ্য প্রতিপাদ্য। বিষয় নির্বাচন নিয়ে একপ্রকার প্রথানুগ ত্র“টি ধরা পড়লেও পুরুষ কর্তৃত্ব  ভোগবাদের স্বরূপটি তিনি তুলে ধরতে ভোলেন না। এক্ষেত্রে তাঁর লেখা অশ্লীলতার দোষদুষ্ট বললেও তিনি বিচলিত হননি। শিল্পের নিজস্ব প্রকাশরূপটিই তিনি গ্রহণ করেছেন। অবাঞ্ছিত কার অবাঞ্ছিতত্ব? সেটি মীমাংসা একপ্রকার হলেও নায়িকা রোকেয়ার পরিণতি সংগ্রামমুখী। হতাশা, নৈরাশ্য প্রভূত পরিচর্যায় তার চরিত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনপ্রিয়তার স্বরূপটিও সেভাবেই ধরা পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর জীবন ব্যবস্থার স্বরূপ, সমাজের সৃষ্ট অবক্ষয়, অস্থির মনুষ্যচিত্র, ভেতরে-বাইরের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব কাহিনি-শরীরে চিত্রিত করেন। এক্ষেত্রে তার কথক-রীতিই প্রধান শক্তি। রোকেয়ার প্রতিরোধ, মনোবাঞ্ছা, কি পাইনি উপন্যাসে সাম্যচিন্তা, শোষক শোষিতের দ্বন্দ্ব, ব্ল্যাক আউট, ঠগবাজ, মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ কী নেই তার উপন্যাসে? মোহমুক্তি, ঢেউ জাগে- এসব উপন্যাসে সমাজপ্রসূত রিপুর তাড়না যেমন আছে তেমনি অর্থনীতির চালে বন্দী মানুষের প্রদাহ চিহ্নিত। আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস প্রকাশ পায় ১৯৫১ সালে। কাজী ইমদাদুল হক (আলোচ্য গ্রন্থটিতে তেমন গুরুত্ব পায়নি), নজিবর রহমানের পথ বেয়ে আকবর হোসেন আধুনিক দৃষ্টিচিন্তায় ব্যক্তি-সমাজকেন্দ্রিক বিস্তর বিষয় পাঠকের সম্মুখে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এ সক্ষমতার সাহস বা শক্তির উৎস কী? বাংলা উপন্যাসের জনপ্রিয় ধারায় এর সপক্ষে কী সাক্ষ্য আছে? কার্যত, ত্রিশোত্তর সাহিত্য আন্দোলন, ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, নেতা ও নেতৃত্বের প্রসার, স্বাধীনতার বিভিন্ন আইন পাস, সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাতন্ত্র্য চিন্তার প্রসার, জীবনের আলো-আঁধারের সংস্কার বিলোপ, সাম্য ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ সম্পর্কে উচ্চাশা পোষণ প্রভৃতি বলা যায়। আকবর হোসেন অগ্রসর সমাজের মানুষ, আর্থনীতিক বিষয়সমূহ তার ভাবনায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ফলে তাঁর উপন্যাসে পুরুষ কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রের তোষণ, পুঁজির প্রকোপ, স্বার্থ ও শোষণ- প্রভৃতি কাহিনিতে উঠে আসে স্বরূপে। অনগ্রসর মুসলিম সমাজের লেখকের হাতে এই নতুন ‘নাগরিক’ মধ্যবিত্ত ব্যক্তির সাক্ষাৎ মিলল। অপেক্ষা নয়, সময়ের কালরেখায় তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেল।

পুঁজির অনাস্থা দেখাতে গিয়ে ভোগবাদকে স্বরূপে তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়। কোনো আড়ষ্ট নন তিনি। শিল্পীর হাতে তা অকপট-বীক্ষা পেল, ব্যাপক শোষণ-ত্রাসন সংবাদ উঠে আসল। রাজনীতির প্রতিক্রিয়া আর তার প্রতিক্রিয়াশীল রূপ চরিত্রের পরতে পরতে দ্বিধাহীন নিঃশঙ্ক উচ্চারণে পুনর্গঠিত হয়ে চলে। নারীর প্রতিবাদ ও সাহসী রূপ, দায়িত্বনিষ্ঠ কর্ম ও নিয়মানুবর্তিতার চিত্রও আছে উপন্যাসে। রকিবুল তার গ্রন্থে উপন্যাসের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, পরীক্ষা করেছেন তাঁর শিল্পশক্তি। কিন্তু তার বিশ্লেষণ গৎবাধা, ক্ষণে ক্ষণে তিনিও পুনরাবৃত্তি এড়াতে পারেননি। হয়ে পড়েছেন আবেগবহুল। তবে গ্রন্থটির পঞ্চম অধ্যায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারতো। এখানে শিল্পগুণ বিচার করেছেন তিনি। এটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু রুচিমাফিক সে বিশ্লেষণ যেমন হয়নি, তেমনি তা হয়ে উঠেছে বাছাই করা কিছু উদ্ধৃতির সমাহার। উদ্ধৃতির কারণ ও প্রবণতা ব্যাখ্যা জরুরি যেমন ছিল তেমনি একইসঙ্গে এর মূল্যায়নও অপরিহার্য। কোন্ উক্তি কোন্ প্রসঙ্গে বিধৃত তার জবাব এখানে নেই। মোহমুক্তির ব্যাখ্যায় চেতনাপ্রবাহরীতির কথা বলেছেন- তা মানা যায় না। কারণ, চেতনার প্রবাহরীতির প্রয়োগ আকবর হোসেনের কোনো উপন্যাসে নেই। এ আধুনিক ফর্মটির প্রয়োগ উপন্যাসকারের দৃষ্টিচেতনায় ছিল না। আকবর হোসেনের দৃষ্টিকোণের প্রধান পরিচর্যা বিশ্বযুদ্ধোত্তর মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের রূপায়ণ। এক্ষেত্রে তিনি বড়ো ক্যানভাসের উপন্যাস রচনা করেননি। কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও ছিল বলে মনে হয় না। ফলে তাঁর চরিত্ররা একই প্রবণতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। বিবরণে তারা বহির্মুখী। উপন্যাসের কাহিনিও বাইরের ঘটনা দ্বারা নিরূপিত। শ্রমিক শোষণ, দুর্ভিক্ষ, সমাজের অবক্ষয় ও মূল্যবোধকেন্দ্রিক বিরোধ, যৌনতা প্রভৃতি বাইরের টানে প্লটে পুনর্গঠিত। মনোজগতের সংশ্লেষ বা বিশ্লেষ-এ ফর্মকেন্দ্রিক কোনো অভিনবত্ব পাওয়া যায় না। হয়তো বর্ণনার কোনো অংশে মনের আস্থা বা অবস্থার চিত্র থাকতে পারে কিন্তু তা চেতনা প্রবাহের বৈশিষ্ট্য নয় বলেই মনে হয়।   শিল্পগুণ অংশটিতে বিশ শতকের সমসাময়িক ঔপন্যাসিকগণের একটি তুলনামূলক পাঠে রচিত হওয়ার সুযোগ ছিল। কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান, আকবর হোসেনের ফর্মের তুলনামূলক আলোচনা এ অধ্যায়ে অসঙ্গত হতো না। মুসলিমরচিত উপন্যাসকারগণের ভাষাপ্রয়োগ, ভাষাচিত্রকারের স্বরূপ, তার বিবর্তন এবং নির্ধারিত সমাজ-বীক্ষণ এ অধ্যায়ে তৈরি হলে গ্রন্থটির উপযোগিতা আরও বাড়ত। কারণ, রকিবুল প্রথম অধ্যায়ে বাঙালি মুসলমান গ্রন্থকার তাদের শিল্পচর্চার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে যখন পাঠ তৈরি করেন তখনই এ প্রবণতার ঔপন্যাসিকগণ কীভাবে লিখেছেন, কীভাবে ভাষার পরিখা তৈরি হয়েছে, বিবর্তনের স্বরূপটি কী (নিশ্চয়ই নজিবর রহমান আর আকবর হোসেনের ভাষারীতি এক নয়, একইভাবে তারা একই বিষয় নিয়ে লেখেনও নি), প্রবণতাইবা কীভাবে পাল্টিয়েছে, সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে লেখকের ধারণা কীরূপে প্রকাশ পেল ইত্যাদি বিষয়সমূহ শিল্পগুণ-পর্বে আলোচনার অবকাশ রয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী ইমদাদুল হক বা নজিবর রহমানের উপন্যাসের প্রধান বিষয় ছিল গ্রাম, মধ্যবিত্ত গ্রামীণ মুসলমান, তাদের ধর্ম-সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষার দ্বন্দ্ব, আশরাফ-আতরাফ ভেদ-বিভেদ কিংবা কল্যাণকর আদর্শের প্রচার কিন্তু একটু ব্যবধানে আকবর হোসেনের উপন্যাসের বিষয় হলো ‘অবাঞ্ছিত’ নারীর দ্বন্দ্ব- যেখানে পুরুষতন্ত্র বা পুরুষ কর্তৃত্ব মুখোমুখি, এছাড়া ব্যক্তির বিনাশ-ক্ষয়, মন্বন্তর, শ্রেণিসংগ্রাম, যৌনতাড়না প্রভৃতি অভিঘাতে পরিপুষ্ট। এমন মৌলগত পার্থক্য পাওয়া যায় শিল্পের কাঠামোয়। বস্তুত সে সেটির অভিব্যক্তি পাল্টে গেছে ভাষার-স্বরূপে, শিল্পের বিন্যাসে। আর এ পরিবর্তন সমাজ-মানস থেকেই পরিস্রুত। বৈশ্বিক প্রভাব, মানুষের ভেতরের সত্তার নিঃসংকোচ প্রকাশ আকবর হোসেনের উপন্যাসের অনিবার্য অনুষঙ্গ। হ্যাঁ, তাঁর শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে কিন্তু যে বিষয়গুলো তিনি পাঠকের সম্মুখে নিয়ে আসেন- তা ওই সময় মুসলিম রচনাকারদের একপ্রকার নাগালের বাইরেই ছিল। সে প্রয়াসটুকু এরূপ গ্রন্থে যখন একাডেমিক পাঠে নির্ধারিত হয় তখন তার সবটুকু প্রকাশ পাঠক আশা করতেই পারেন। সেজন্য আলো-অন্ধকারের পশ্চাৎপট যুক্তি ও ইঙ্গিতটুকুও গবেষকের পাঠ্য। তবে সেটি যে এ গ্রন্থে সর্বপ্রকারে অবহেলিত তা বলছি না, বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রণীত নক্শায় তা অনেকটা সুচারু এবং সুনির্দিষ্ট। কোনো গ্রন্থই কী কোনোকালে স্বয়ম্ভূ হয়েছে- হয়নি। কার্যত, যা হয়ে উঠেছে তা তো সত্যে স্বয়ংপ্রকাশ। আর ‘হতে পারতো’ অর্থে যা বলছি তা আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ, এরূপ আলোচনায় সে সুযোগটুকু তো অবশ্যই আছে। এমনটা তো ঠিক, এ ধরনের গ্রন্থ নিয়ে কিছু লেখার বা আলোচনার অর্থ হচ্ছে নির্ধারিত বিষয়ে কিছু চর্চিত জ্ঞান উপভোগ করা, ঘাত-অভিঘাতের সূত্রগুলো খুঁজে দেখা। এমন আলোচনায় এটিও তো সামনে আসতে পারে, আমাদের বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানগণের লেখালেখির কাল কেমন ছিল, কী আড়ষ্ট হয়ে তারা লিখতেন, কতোটা গ্রাম্য ছিল তাদের পঠন-পাঠনের ধরণ কী ছিল ইত্যাদি? আবার এর বিপরীতে স্বতন্ত্র সত্তারূপে তার আধুনিক হয়ে ওঠা, আজকের বৈশ্বিক সম্পৃক্তি, টেকবিশ্বের উপযোগ, কর্পোরেট সংস্কৃতি কিংবা এই কনফারেন্স কক্ষ বাঙালি মুসলমানের আজকের লেখালেখি, অভিবাসন চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক-আধুনিক চিন্তা সবকিছুর পুনর্পঠন তো করা যায় এই গ্রন্থটি ধরেই। সুতরাং যে পরামর্শ বা পরিচিন্তন তা এই গ্রন্থটির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই। আর গ্রন্থকার রকিবুল হাসানকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

No comments:

Post a Comment