Friday, September 6, 2013

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে চিন্তনলেখন...




সনৎকুমার সাহা
কী তিনি? কেন তিনি?

______________________________________________________

জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও (১৯৪০) তিনি ঘোষণা করেন, ‘-আমি জন্ম-রোম্যান্টিক’। কল্পনায় ছবি আঁকেন ‘অনসূয়া’-র। কালিদাসের অর্ধস্ফুট নারী-প্রতিমায় স্পন্দন জাগান, আর, তাঁর সময়ের কাব্য-নায়িকাদের সঙ্গে তাঁর তফাত্টা তুলে ধরেন। বলেন--‘সে নয় ইকনমিক্স্-পরীক্ষাবাহিনী/ আতপ্ত বসন্তে আজি নিশ্বসিত যাহার কাহিনী।/ অনসূয়া নাম তার, প্রাকৃতভাষায়/ কারে সে বিস্মৃতযুগে কাঁদায় হাসায়,/ অশ্র“ত হাসির ধ্বনি মিলায় সে কলকোলাহলে/ শিপ্রাতটতলে।-’ আমরাও মুগ্ধ হই। ‘রোম্যান্টিক’ বলতে বুঝি, ‘অর্ধেক মানবী’, আর, ‘অর্ধেক কল্পনা’; এই নিয়ে গড়ে তোলা ‘মানসী প্রতিমা’। অনেক আগে ছিন্নপত্রতেও (১৮৯৫) ইন্দিরা দেবীকে তিনি তাঁর গোত্র চিনিয়েছেন, ‘রোম্যান্টিক’ বলে। জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয় তাঁর কীট্স্কে। উনিশ শতকের য়োরোপীয় রোম্যান্টিক ভাবনার অনুসরণ তিনি কতটা করেন, এমন কি কীট্স্-এরও, এ প্রশ্নে পরে আসছি, তবে তাঁর চেতনায় ‘রোম্যান্টিক’ বলতে কী ধারণা কাজ করে এবং আমরাও যা অকুণ্ঠ অভ্যস্ততায় ওই রকমই মনে করি-তার একটা আন্দাজ বোধ-হয় ওই ‘অনসূয়া’-তে পাই। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওই ঘরানাতে যে তিনি থেকে যান, এ কথা কবুল করেন তিনি নিজেই।

কিন্তু এই সরল সমীকরণ, এবং তা থেকে আত্যন্তিক সমতা, কি প্রতারণার ফাঁদ পাতে না? এতে যে সত্য নেই, তা নয়। কিন্তু এই কী সব? চেতনার কোষে কোষে অন্য বিভিন্ন তাড়নাও কি কাজ করে না? হয়ত একই সাথে, অথবা ছাড়া-ছাড়া? যদি করে, তবে তাঁর আদি-অন্ত রোম্যান্টিক-পরিচয় কি অক্ষুণ্ন থাকে? তিনি যদি তাতে স্বচ্ছন্দ থাকেন, তার পরেও? অথবা এটা কেবলই আড়াল? কিংবা হতে পারে, তিনিও পুরো জানেন না। তাঁর প্রতিভা, তাঁর সময়, তাঁর বাস্তবতা, দ্বন্দ্ব-বিরোধে, সখ্যে-সাহচর্যে তার ভিতরে কাজ করে চলে। জট পাকায়, জট খোলে। দ্বৈরথে-সমন্বয়ে, কিছু বুঝে-কিছু না-বুঝে তিনি নিজেকে প্রকাশ করে চলেন। ভাষা, রুচি, কালের অভিসন্ধি, এ সবই তার ওপর জুলুম খাটায়। পরিচয়ের অনেকটা বুঝি অধরাই থেকে যায়। তাঁর কথাতেও, সম্পূর্ণ সৎ ও আন্তরিক হলেও, হিসাব মেলে না। এটা অবশ্য একটা সম্ভাবনা। কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়। আমরা তাই কেবল কিছু প্রশ্নই তুলতে পারি। এবং এখানে তারা পারম্পর্যহীন-নেহাত্-ই ওপর ওপর। অনর্থক হলে খুশি মনে প্রচলিত ধারণাতে ফিরে যাবো। অনেক জানা-শোনা আছে, এমন দাবি করি না। সাধারণ কৌতূহলের বেশি এখানে আর কিছু নেই।

রোম্যান্টিক বলে নিজের পরিচয়-নিশানা রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন দিয়েছেন, তাঁর নানা সময়ের বিভিন্ন লেখা থেকে তার পক্ষে সাক্ষী সাজানো যায় কিন্তু অনেকই। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’ তার সরব ঘোষণা। ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়-’তে তার ছায়া ঘন হয়ে মনকে ঢেকে দেয়। ‘মানস সুন্দরী’ বা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ আমাদের চেতনাকে গ্রাস ক’রে তাকে পুরোপুরি সম্মোহিত রাখে। ‘উর্বশী’ বা ‘বিজয়িনী’ কুণ্ঠাহীন মালিন্যহীন সুন্দরীতমার অশেষ মাধুরীর তৃষ্ণা জাগায়, ‘সেকাল’ বা ‘স্বপ্ন’ সেই তৃষ্ণাকে অক্ষুণœ রাখে, তাঁর প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। জীবনের তৃতীয় প্রহরে এসেও লেখেন, ‘সাগরজলে সিনান করি সজল এলো চুলে/ বসিয়াছিলে উপল-উপকূলে।’ লেখেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ অথবা প্রান্ত বেলায় বিস্মরণের কুয়াশা ছিঁড়ে বিষণ্ন মাধুরিমায় ফিরিয়ে আনেন ‘গলায় মোতির মালা, সোনার চরণচক্র পায়ে’-‘বধূ’-কে ফিরিয়ে আনেন, ‘অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা’-য় ‘শ্যামা’-কে। তাই যখন তিনি বলেন, ‘আমি জন্ম রোম্যান্টিক’ তখন তাতে আমাদের সায় দিতেই হয়। গানেও এই ভাব আরো উপচে পড়ে। ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়’-এই চরণ আমরা বার-বার শুনি, বার-বার তার পুনরাবৃত্তি করি। ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে’ মনে মধুর আবেশের ভরা জোয়ার আনে। ‘আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে/ নিশার মতো নীরব ওহে, সবার দিঠি এড়ায়ে এলে’, অথবা ‘পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে,/ আজ তোমায় আমায় প্রাণের বঁধু মিলব গো এক সাথে’এক নিবিড় আনন্দ-বেদনার পূর্ণতায় আমাদের চেতনার আকাশ ছেয়ে ফেলে। তাঁর মতে যা রোম্যান্টিক, এরা তারই বার্তা নিয়ে আসে। উপন্যাসে ‘শেষের কবিতা’ ত তাঁর রোম্যান্টিক ভাবনার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। এমন কি ‘গোরা’ উপন্যাসেও গোরা-সুচরিতা বা বিনয়-ললিতার সম্পর্ককে তিনি অনুভবের যে জায়গায় বিকশিত করেন; তাকে রোম্যান্টিকই বলতে হয়।

কিন্তু এই কি সব? তা হলে ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।/ এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।’-একে বিচার করি কীভাবে? রোম্যান্টিক ত একে বলা যায় না। সক্রেটিসের অনুরণন কি শোনা যায়?  অথবা উপনিষদের? নিজেকে জানার ওপর জোর দেন তাঁরা উভয়েই। অবশ্য একই দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। সক্রেটিসে আত্মজ্ঞান নিজের আন্তরসত্তাকে আতিপাতি করে খুঁজে যদি কিছু মেলে, তা। নিজের, মানে, ব্যক্তিগত ভাবে যা আপনার, তা মাত্র নয়, মানব প্রজাতির যে কারো সাধারণ বৃত্তি-প্রবৃত্তি-অভীপ্সা-বিবিক্তি সব মিলিয়ে তার, অর্থাৎ মানুষের যে আত্মস্বরূপ, তা-ই। তারই খোঁজে তাঁর কেবল প্রশ্নের পেছনে ছোটা-একটা থেকে আর একটা, তা থেকে আবার একটা-অবিরাম। এই ভাবে নিজেকে জানা, মানে সবাইকেই জানা। কিন্তু সবটাই মানুষের চেতনার সীমানায়-এবং মানুষই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। অন্যদিকে উপনিষদে নিজেকে জানা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়েঅনোরনীয়ান মহতো মহীয়ান। বটবৃক্ষের বীজে যে প্রাণসত্তা, মানুষেও তাই। এবং প্রাণে-অপ্রাণে যে অন্তহীন বিস্তার, মানুষ তারই একটি কণা। কাজেই লোভ কোরো না। কীসে কার অধিকার? রবীন্দ্রনাথ, মনে হয়, সক্রেটিসকেই মানেন, তবে উপনিষদের আলোকে ফেলে। না হলে কেন লিখবেন ‘আমি’ কবিতা? কেন শোনাবেন ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে’? কেন আমাদের চমকে দেবেন এই বলে, ‘মানুষের অহংকার পটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প’? আবার সেই সঙ্গে টেনে আনবেন অসীমের সমস্তটাকেও‘অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করছেন সাধনা/ মানুষের সীমানায়,/ তাকেই বলে ‘আমি’।’ এই রকম কথা জোর দিয়ে বলেছেন তিনি আইনস্টাইনকেও (১৯৩০): মানুষের চেতনার প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব। নইলে তা অর্থহীন।
আরো একজন এসে যান এই ভাবনার যোগসূত্রে। তিনি ডারউইন। ওই গানেই শুনি, ‘কত জনম-মরণেতে তোমারি চরণেতে/ আপনাকে যে দেব, তবু বাড়বে না দেনা।/ আমাকে যে নামতে হবে ঘাটে ঘাটে/ বারে বারে এই ভুবনের প্রাণের হাটে।-’ এখানে ‘তোমারি’ বলতে অতিলৌকিক কিছু ধরে নেবার দরকার আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তহীন সর্বময়তাকে তা বোঝাতে পারে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ উদ্বর্তনবাদে তা হলে এ সহজেই মিশে যায়।

এখানে যা বলবার, তা হলো, এই ভাবনা। বিশ্ব রোম্যান্টিক নয়; এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে তার বার-বার ফিরে-ফিরে আসে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। একটু বেশি গীতাঞ্জলি পর্বে। এখানে গীতালিতে একটি গানের শুরুর দুই-চরণ আমাদের নজর কাড়ে : ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো,/ সেই ত তোমার আলো।’ বহু পরের স্টিফেন হকিং-এর ব্রহ্মাণ্ড-ভাবনা থেকে একে কি খুব দূরের মনে হয়? ‘বিগ-ব্যাং’ থিয়োরির মূলকথাটা কি রবীন্দ্রনাথকেও উত্তেজিত করেছিল? কল্পনা-বিলাস এখানে বস্তুজগতের আদি-কাণ্ড থেকে উঠে আসে। যুক্তিক্রম তার মূলে পৌঁছুতে চায়। একে রোম্যান্টিক বলা যায় না।

আরো একটা ভিন্ন জাতীয় কবিতার দিকে এবার চোখ যায়। এমন কাহিনি-নির্ভর কবিতা তিনি জীবনের  অপরাহ্ণে অনেক লিখেছেন। ছোটগল্প আর তেমন লেখেন নি। এই কবিতাগুলো তার অভাব খানিকটা পূরণ করে। সে সবে রোম্যান্টিক কবিতাও ছিল। যেমন, আগেই উল্লেখ করেছি, ‘বধূ’ বা ‘শ্যামা’। কিন্তু এই কবিতাটি অন্যরকম। নিরাবেগ। নিরাসক্ত। তবে কদর্য বাস্তবতার মর্মভেদী ছবি বুকে বেঁধে অব্যর্থ। বোধ হয় তার অসহায় আর্তি এত দৈনন্দিন, আর এত শুকনো বলেই আমরা তার দিকে খুব একটা আকৃষ্ট হই না। শিল্প-উপভোগ ত একটু দূরত্বও দাবি করে! এই কবিতা তার অবকাশ রাখে না। হাহাকার একঘেয়ে প্রাত্যহিকতায় চাপা পড়ে। তবে এটুকু বলা ভালো, হাসান আজিজুল হক-এর সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো উপন্যাস, সাবিত্রী-উপাখ্যান-এ যেন এই কবিতাটির রেশ দূর থেকে হলেও ছুঁয়ে যায়। উপন্যাসটিকে কেউ অতি দূর কল্পনাতেও রোম্যান্টিক বলবেন না। এই কবিতাটিও তা নয়। এর নাম, ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় ঢাক বাজায় খালে বিলে’ (১৯৩৯)। আমরা এখানে ছাড়া-ছাড়া পড়ি :

আদিবিশ্ব-ঠাকুরমায়ের আশমানি এক চেলা
ঠিক দুপুর বেলা
বেগনি-সোনা-দিক-আঙিনার কোণে
বসে বসে ভুঁই জোড়া এক চাটাই বোনে
হলদে রঙের শুকনো ঘাসে।
সেখান থেকে ঝাপসা স্মৃতির কানে আসে
ঘুম-লাগা রোদদুরে ঝিমঝিমিনি সুরে-
‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে,
সুন্দরীকে বিয়ে দিলেম ডাকাত-দলের মেলে।’


একে বলা চলে, ভণিতা। বিষয়ের জায়গা-জমি একটু কাছে এসে চিনে নেওয়া। ঘটনার তীর বিঁধে কবিতার শেষাংশে :

কই আমাদের পাড়ার কালো মেয়ে-
ঝুড়ি ভরে মুড়ি আনত, আনত পাকা জাম,
সামান্য তার দাম;
ঘরের গাছের আম আনত কাঁচামিঠা,
আনির স্থলে দিতেম তাকে চার-আনিটা।
ওই যে অন্ধ কলুবুড়ির কান্না শুনি-
ক’দিন হল জানিনে কোন গোঁয়ার খুনি
সমত্থ তার নাতনিটিকে
কেড়ে নিয়ে ভেগেছে কোন দিকে।
আজ সকালে শোনা গেল চৌকিদারের মুখে,
যৌবন তার দলে গেছে জীবন গেছে চুকে।
বুক-ফাটানো এমন খবর জড়ায়
সেই সেকালের সামান্য এক ছড়ায়।
অন্তিমে শুনি কবির চাপা নিরুপায় আক্ষেপ :
শাস্ত্রমানা আস্তিকতা ধুলোতে যায় উড়ে-
‘উপায় নাই রে নাই প্রতিকার’ বাজে আকাশ জুড়ে।
অনেক কালের শব্দ আসে ছড়ার ছন্দে মিলে-
ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে ॥

এদিকে কিছুতেই যে কিছু হয় না, তারই প্রতীকে নীরব ধিক্কারে কবিতা শেষ হয় :
জমিদারের বুড়ো হাতি হেলেদুলে চলেছে বাঁশতলায়,
ঢঙঢঙিয়ে ঘণ্টা দোলে গলা ॥

আমরা দেখছি, তাঁর সৃষ্টিশীল রচনা থেকে, তিনি যে রোম্যান্টিক, এমন ধারণাকে একমাত্র বিবেচনা করে যুৎসই ভাবে দাঁড় করানো বেশ মুশকিলই। তাঁর মননশীল রচনা থেকে অথবা তাঁর সারা জীবনের বিপুল কর্মকাণ্ড থেকে তার পক্ষে তেমন কোন ইংগিত কি মেলে? এটা ঠিক, অনেক কথার ভিতরে রোম্যান্টিকতার অনুকূলেও তাঁর কথাবার্তা বেশ কিছু আছে। কিন্তু তা মূলধারায় এসেছে, এমনটি মেনে নেওয়া সহজ হবে না। তাঁর শান্তিনিকেতন-প্রবন্ধমালা, মানুষের ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ নিয়ে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত বক্তব্য, কালান্তরের ভাবনারাশি, পল্লীকথা বা বিশ্বভারতী-চিন্তা এদের কোনটিকেই রোম্যান্টিক-গোত্রে ফেলা চলে না। ঐতিহ্যের শিকড় থেকে তিনি বিচ্যুত হন নি। স্বতস্ফূর্ত আন্তরিকতায়, এবং সচেতন বিবেচনাতেও তিনি তা আঁকড়ে থেকেছেন; কিন্তু যুক্তি-কাণ্ডজ্ঞান এবং খোলা মনে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, সব উৎসের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আপন চেতনার পুষ্টিতে সমিধ আহরণে কোথাও কোন ছুঁৎমার্গকে প্রশ্রয় দেন নি। আপন বিবেকের কাছে যা সত্য বলে মনে হয়েছে, তাকেই সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছেন। একলা চলার সাহস হারান নি, আবার নিজের নামে আলাদা কোন নিশানও তোলেন নি। পাশাপাশি আর কারো বা আর কোন মতবাদের অনুসারী হবার আগ্রহ পরম ঔদাসীন্যে, কিন্তু সভ্য-শোভন আচরণে উপেক্ষা করে চলেছেন। এই ভাবে উনিশ শতকে য়োরোপীয় রোম্যান্টিক আন্দোলনের, বিশেষ করে ইংরেজি রোম্যান্টিক কাব্যের প্রেরণা নিঃসন্দেহে তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সেইটিই তাঁর অনন্য পরিচয়সূত্র হয়ে থাকে নি। গীতালি-র, আগেরওই গানটির শেষ চার-চরণে তিনি গান, ‘বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি/ সেই তো স্বর্গভূমি।/ সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি/ সেই তো আমার তুমি।’ তাঁর ব্যক্তিমানসের সমগ্রতার আভাসও বোধহয় এখানে আমরা পাই। তাঁর ‘তুমি’ জায়গা ছেড়ে দেয় তাঁর ‘আমি’-কে।
তারপরেও তিনি যেখানে রোম্যান্টিক, সেখানে তা য়োরোপীয় বৈশিষ্ট্য কিছু আত্মস্থ করলেও আন্তরমূল্যে ঠিক এক থাকে না। যে কীট্স্ তাঁর অতি প্রিয়, তাঁর সঙ্গেও আপন চেতনায় মৌলিক তফাত্ একটা ঘটে যায়। কীট্স্ সুন্দর ও সত্যে অভেদ দেখেন। বলেন, বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ বিউটি। যে কেউ সায় দিতে তৈরি থাকবেন। যেন স্বতঃসিদ্ধ। সুন্দর অমলিন। তাতে কোন অপূর্ণতা নেই। আতিশয্যেও নেই। দুর্লভ এই অস্মিতা সত্য-স্বরূপ ফুটিয়ে তোলে। আর সেভাবে ফুটে উঠলে তা অনিবার্য সুন্দর। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখতে গেলে প্রশ্নরা ভিড় করে। সত্য ত কুরূপও হতে পারে। হতে পারে ভয়ংকর। এমন কি থাকতে পারে তাতে বাড়াবাড়ি। রোম্যান্টিক য়োরোপ তাকে সুন্দর বলে মেনে নেয়। আগে রেনেসাঁ মানে নি। এই মেনে নেওয়ায় রোম্যান্টিক য়োরোপে সত্য-সুন্দরের অভেদ ভিন্ন মাত্রা পায়। অন্য কোন মূল্য-বিচার, যেমন ন্যায়-অন্যায়ের, সুখ-দুঃখের, আর মাথা গলাতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ যেখানে রোম্যান্টিক, সেখানে কিন্তু সুন্দরকে দেখেন পরিশুদ্ধ মুগ্ধতায়। যেমন, ‘উর্বশী’ বা ‘বিজয়িনী’তে, অথবা ‘স্বপ্ন’ কবিতায়। এখানে সত্য,-প্রিয়, বা অপ্রিয়,-অপ্রাসঙ্গিক। অবশ্য প্রশ্নটি যে তাঁকে ভাবায় নি, তা নয়। গভীরভাবেই ভাবিয়েছে। সমাধানও তিনি খুঁজেছেন তাঁর মত করে। কিন্তু তা আর রোম্যান্টিক থাকে না। যেমন, ‘রাজা’ নাটকে। এবং সুন্দরে ভালো-মন্দমূল্যবিচার ঢুকে পড়ে। তাতে সুন্দর তার অনন্যতা হারায়। যদিও তার হৃদয়গ্রাহিতা বাড়ে।

সমস্যা দেখা দেয় সত্যকে চিনে নেবার বেলাতেও। অবশ্য তার সঙ্গে তাঁর রোম্যান্টিক থাকা-না-থাকার কোন সম্পর্ক নেই। অল্প বয়সে বঙ্কিমের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কালে সত্য তাঁর কাছে ছিল সরল, অনপেক্ষ ও শাশ্বত। ক্রমশ তাতে নানা প্রশ্ন ঢুকে পড়েছে। আত্যন্তিক সততায় তিনি তাদের মুখোমুখি হয়েছেন। বলাকা-র কালে বিপুল আস্থায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক।’ ‘চিরন্তন এক’-এর ধারণাটা আন্দাজ করা বোধ হয় তুলনায় সহজ। যে বিধান অসংখ্য গ্রহ-তারা নিয়ে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে একক নির্দিষ্ট নিয়মের পথে বিরতিহীন চালু রেখেছে, এখানে তার কথাই আমরা ভাবতে পারি। অতি-জাগতিক, অধ্যাত্মিক কিছু আরোপ করা অনর্থক। কিন্তু গোল বাধে শান্তি ও শিবের সঙ্গে সত্যকে এক করে দেখা নিয়ে। প্রথমত, শান্তি বা কল্যাণ (শিব) চিনে নিই কী করে? তারা কি অনপেক্ষ, অনন্য, বাস্তব ও সত্যনিষ্ঠ? সবাই কি তাদের একইভাবে দেখি, একইভাবে বুঝি? তিনি নিজেই ত গীতবিতানের শুরুতে গান, ‘-শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্ব-ভুবন মাঝে, / অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।’ তাঁর গান কি তবে সত্য-নির্ভর নয়? আর কল্যাণের কোন একক রূপ যে কোন বাস্তবতাতেই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সমঝোতার অনন্য নয়, অন্যতম সমাধানই সব সময় শিরোধার্য করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এদের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই এগিয়েছেন। এবং এই লড়াই কখনোই রোম্যান্টিক ছিল না। না য়োরোপীয় ঘটনার না তাঁর নিজস্ব চেতনার। শেষ পর্যন্ত বলে যান, ‘সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম-/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ (রূপনারাণের কূলে, ১৩ মে ১৯৪১) এই সত্য যদি অটুট থাকে, তবেই মেলে ‘শান্তি অক্ষয় অধিকার’। (‘তোমার সৃষ্টির পথ’, ৩০ জুলাই, ১৯৪১)।
বিষয়টা কিন্তু কিঞ্চিৎ অস্পষ্টই থেকে যায়। সত্য কঠিন, এটা মেনে নিই। কিন্তু তার রূপ এক, না, অনেক? লক্ষ্যেরও কি রূপ বদলায় না? যেমন বদলায় প্রেক্ষাপট? দ্বিতীয়ত, পথটা উল্টে যায়। শান্তি থেকে সত্যতে নয়, সত্য থেকে শান্তিতে। এই শান্তি অন্তরের। ফলে তা ব্যক্তিগত। কিন্তু ঝামেলা বাধায় সত্য। ব্যক্তিগতভাবে যা সত্য বলে মনে করি, সমষ্টিগতভাবে পরিণামে তা সত্য না-ও হতে পারে। আবার বিপরীত দিক থেকেও ব্যাপারটা ঘটতে পারে। ফলে কিছুই নিশ্চিত হয় না। তবু তিনি এর মুখোমুখি হয়েছেন। এবং আমৃত্যু মুখোমুখি থেকেছেন; সততার ও সাহসের সঙ্গে বরাবর। ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম’এই কথাটি তিনি এক গানে আমাদের মনে রাখতে বলে গেছেন। আরো মনে রাখি চেতনার প্রান্তরে তাঁর এই অতি-মানবিক-মানুষী লড়াইটা। অবশ্য ‘গান’ শব্দে যদি প্রতীকী অর্থে এ সবও ধরা থাকে, তবে আর বাড়তি কিছুর প্রয়োজন করবে না।

তাহলে রবীন্দ্রনাথকে ‘রোম্যান্টিক’ বলে একটা দলে ভিড়িয়ে দিয়ে আলাদা করে চিনে নিই কী করে? এতে যদি তিনি খুশি থাকেন, তারপরেও? আসলে কোনখানে কোনভাবে গণ্ডি টেনে তাঁকে আটকে রাখা যায় না। আত্মখণ্ডনও তিনি করেন না। নদীর মত কেবল প্রসারিত, বিস্তারিত, প্রবাহিত হন; বিশাল বটগাছের মত ক্রমাগত আকাশে মাথা তোলেন, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সব শুষে নেন, ছায়া দেন,পথিকেরা শ্রান্তি কাটিয়ে আবার যার যার মত যার যার দিকে পথ চলে।

কিন্তু স্মৃতি ত ফিকে হয়। নদী, গাছ-তাদের মহিমাও সময় হরণ করে। দ্বন্দ্বে-বিকাশে-উদভ্রান্তিতে-উৎক্রান্তিতে ধাবমান মানুষ যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেকে ছড়ায়, ছাড়ায়, আবার হারিয়েও যায়। এই অনিবার্য কালস্রোতে কেন তবে তাঁকে আবার ফিরে দেখা, কেন তাঁকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনা, তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের পথ চলার কথা ভাবা? না কি ‘এ শুধু অলস মায়া’-‘বাতাসেতে বিসর্জন’?
এ কথা ঠিক, আজ আর আমরা কেউ রবীন্দ্রনাথের ঢঙে লিখি না। জীবন আমাদের জ্বালায়-পোড়ায়, আবার, জাগায়-চালায়। আমরা তাতে শামিল হই। তবে সকর্মকও থাকি। অন্তত থাকাটাই আমাদের মানুষী অভিজ্ঞান। ‘প্রতিদিনের পথের ধুলায়’ হারিয়ে যেতে যেতে চেতনাতেও। এইখানেই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। এখনও। আরো অনেক ‘এখন’ কি তার পেছন পেছন আসবে? জানি না।

যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন, তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে নি। এমন কি তাঁর রোম্যান্টিক ভাবনাও আমাদের জড়ায়। কিন্তু চেতনার জগতে দাপাদাপি বেশি উত্তর-আধুনিক, উত্তর-উপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার কোলাহলের। এ পুরোপুরি অরাবীন্দ্রিক-বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের বিপরীত মেরুতেই এর ঘাঁটি। ‘বিশ্ব সাথে যোগে’ এর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ‘ভুবনজোড়া আসনের’ খোঁজ শুধু বিরক্তিকর নয়, অনিষ্টকর। আসল অস্তিত্বের মূল খুঁজতে অতীতের অন্ধকার খোঁদলে, দেড় হাজার দু হাজার বছর বছর আগের প্রথা ও সংস্কারের মড়া-কাঠের জঞ্জালে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি, আর, উচ্চকণ্ঠে আমাদের নিজস্ব সত্তার বুলি আওড়াই, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে মানবিক দায়িত্বহীনতায় আত্মরতির প্রদর্শনী খুলি, সেই সঙ্গে ডুগডুগি বাজিয়ে তার পুজোতে মত্ত হই, এই হলো আজ কর্মের ও চিন্তার জগতে বিশিষ্ট হবার নতুন ফ্যাশন। কোন-কিছুই নিজস্ব চিন্তার ফসল নয়; বরং সবটাই বাইরে থেকে ধার করা। এখানে শুধুই তোতাপাখির মত শেখানো কথায় গলা-মেলানো। তাতে যদি পারঙ্গম হওয়া যায়, তবে দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থের কাছে খাতির জোটে মন্দ না। অবশ্য দেশি কায়েমি স্বার্থেরও টিকি বাঁধা বিদেশে। আজ-কাল এনজিও-সংস্কৃতির দাপট তাকে চিনিয়ে দেয় ভালই।
বিষয়টা মিশে আছে বিশ্বায়নে অর্থনৈতিক স্বার্থের নতুন সম্পর্ক-জালের সঙ্গে। বিশ্ব-জোড়া পুঁজি ও প্রযুক্তির কেন্দ্রীভবনে কাম্য নয় আর কোথাও তাদের বিকাশ ঘটুক। তৃতীয় বিশ্বে রাষ্ট যদি সহায় হয়, তবেই ওই বিকাশ সম্ভব। কাজেই প্রথম আঘাত হানো বহু মানুষের মিলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে। তা যদি টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে, অথবা, ঠুঁটো-জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে, তবে বিশ্বায়িত পুঁজির পোয়াবারো। তাকে সফল করতে চাই ওই রাষ্ট্রের এলিট সমাজের সমর্থন। তাদের জন্যে তত্ত্বভূমি রচিত হয় উত্তর-আধুনিক উত্তর-উপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে স্বেচ্ছায় ফাঁদে পড়ায় আগ্রহী বুদ্ধিমান মানুষের অভাব হয় না। আমাদের দেশে দালাল-মুৎসুদ্দিদের কারবার নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথের পশ্চাৎভূমিতেও তা ছিল। এখন দেখি নবকলেবরে তার উত্থান।

এ কথা সত্য, বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রকে সুনজরে দেখেন নি। উপনিবেশিক অভিজ্ঞতা তাঁকে পীড়িত করেছিল; এবং সেই সময়ে পাশ্চাত্যে জাতীয়তাবাদী সংঘাতে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। ব্যক্তিগত সুনাম-দুর্নামের পরোয়া না করে খোলাখুলি তিনি তাকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। কিন্তু আজ বিশ্বায়িত পুঁজি ও মুক্তপদ প্রযুক্তির আগ্রাসন ঠেকাতে হলে গণসমর্থিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন বিকল্পের কথা ভাবা যায় না। এইখানেই আসে জনগণের অংশগ্রহণের বহু ধরণের- বহু মানুষের সক্রিয় গণতন্ত্রের কথা, আসে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা। দুটোতেই রবীন্দ্রনাথের অকুণ্ঠ আগ্রহ ছিল। সীমিত আকারে-সীমিত সুযোগে পতিসর-শিলাইদহে ও পরে বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতনে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছিলেন। তাদের সীমা ও সম্ভাবনা আজকেও আমাদের ভাবায়, যদিও উত্তর-আধুনিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীপরায়ণতা তাকে পাত্তা দেয় না। তাঁর আদর্শ-কল্পনা কতটা কাজের, তাও নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা দরকার। এবং সেইখানেই আসে রাষ্ট্রের ইতিবাচক কার্যকারিতা। তা হেলাফেলার নয়। এসবের প্রেক্ষিতে আমরা কী করবো, আর কী হবো, এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে এখনও তাঁর সৃষ্টিকলা ও তাঁর মূল্যমান ভালোভাবে বোঝা আবশ্যিক থেকে যায়। এমন কি, যদি কোথাও তাঁর সঙ্গে একমত হতে না পারি, তবুও। তবে তাঁর মনের মুক্তি, রোম্যান্টিক থেকেও রোম্যান্টিকতাকে অতিক্রমণ, উদার বিশ্ববোধ, মানবচৈতন্যের নিরাসক্ত প্রকাশ, করুণা ও আত্মজ্ঞান, এবং ব্যক্তিগত নয়, আত্মগতভাবে অভিজ্ঞতার সমস্ত ধাপ পার হয়ে পূর্ণতার উপলব্ধিকে প্রাথমিকতা দেওয়া, এগুলো আমাদের প্রেরণা জোগায়। পরিবেশ যদি বৈরী থাকে, তারপরেও। এবং বেশি করে সে কারণেই। অস্বীকার করি না, রবীন্দ্রনাথ আমাদের চেতনায় মিশে আছেন, এ কথা বলা আদিখ্যেতাকাণ্ডজ্ঞাহীন ভাবালুতা, অথবা মিথ্যা বিশ্বাসের অসার আবরণ। কিন্তু মিশে না থাকলেও মিশার প্রয়োজন ফুরোয় নি। রোম্যান্টিক হবার জন্যে নয়, মানুষ হবার ও মানুষ থাকার জন্যে। সেটা যদি অবান্তর হয়ে পড়ে, আজ অথবা কাল, তবে অবশ্য ভিন্ন কথা।

এই মনুষ্যত্বকে মূল্য দিতে ওঠে নিম্নবর্গের প্রসঙ্গ। এটা ঠিক নয়, তিনি তাদের উপেক্ষা করেছেন। তবে তারাই একমাত্র, এমনও ভাবেন নি। ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘রথের রশি’, ‘রক্তকরবী’ তাঁরই রচনা। ‘ঐকতান’ কবিতায় নিজের অপূর্ণতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বীকার করায় সতর্ক-বাণীও আছে‘সেটা সত্য হোক,/ শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।’ আরো যোগ করেছেন, ‘সত্য, মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি/ ভালো নয় ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।’ এই ‘সত্যমূল্যে’র খোঁজ আমাদের শুধুই নিম্নবর্গে বেঁধে রাখে না। পরবর্তী সময়ের মানুষের ইতিহাস, যতই অপূর্ণ ও বিকৃত হোক, তার সাক্ষী। প্রয়োজন অন্ত্যোদয়ের সঙ্গে সর্বোদয়। এবং সর্বোদয়ের জন্যেই বেশি ঝোঁক অন্ত্যোদয়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও কাজ তাঁরই কথায় ‘সর্বত্রগামী’ যদি না-ও হয়ে থাকে তবু এই লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত হয় নি। এক সমন্বিত সুষমা ছিল তাঁর অন্বিষ্ট। তা অলীক নয়। এবং দায়িত্বে সম্পূর্ণ মানবিক। বোধহয়, তার শেষ নেই। কারণ, প্রতিটি বাস্তবতাই লালন করে দ্বান্দ্বিকতা। সমাধানের চেষ্টাই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথের করা এবং হওয়া, আমৃত্যু-আজীবন, সেই পথে। কোন ভান ছিল না তাতে।







জুলফিকার মতিন
অমরত্বের জ্বালা
________________________________________

জীবৎকালেই রবীন্দ্রনাথ প্রভূত মানুষের কাছে রূপান্তরিত হয়েছিলেন গুরুদেবে। সাধু-সন্ত-সন্ন্যাসী কিংবা পীর-ফকির-আউলিয়ার এই দেশে তাঁর শ্মশ্র“মণ্ডিত ভক্তি উদ্রেককারী সুদর্শন চেহারাও তাতে অনেকটুকু সাহায্য করেছে বলে মনে হয়। বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর প্রতিকৃতি অক্ষত রেখে দিয়েছিল, এ-ও তো আমাদের এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। এবং সন্দেহ নেই, এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর ঐ চেহারারই কল্যাণে মারতে এসেছে তারা জীবিত মানুষকে, তাই বলে এক জন দরবেশের ছবিকে তো আর অসম্মানিত করা যায় না! আবার যারা শ্রেণীসংগ্রামের ঝাণ্ডা ওড়াচ্ছিলেন, তাদের কাছে তিনি হয়ে পড়েছিলেন প্রতিক্রিয়াশীলতার ধ্বজাধারী। জন্মদোষে দুষ্ট মানে ধনীলোকের সন্তান হয়ে তাঁর পৃথিবীতে আগমন ছিল এমত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক সরল যোগফল। কেন না, রূপার কিংবা সোনার চামচ মুখে নিয়ে আসাটা কতটা অপরাধ, তা, বোধ করি, যৌক্তিক ভাবে নির্ধারণ করা যায় না। মানুষের জন্ম মাত্রই একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। কিংবা এটাকে দুর্ঘটনাও বলা যেতে পারে। এখানে তার ইচ্ছাশক্তির কোনই ভূমিকা নেই। সুতরাং ইচ্ছা নিরপেক্ষ কোন কাজের জন্য শাস্তির বিধান দেয়াটাও এক হাস্যকর বিষয়। এ ক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব যা কিছু, সবই তার পিতা-মাতার। নানা কারণেই মানুষ বিবাহ কিংবা সন্তানের জন্মদান থেকে বিরত থাকে। তবে দারিদ্র্যের কারণে সে নিজেকে ওকাজ থেকে দূরে রেখেছে, এমনটি শোনা যায় না। বরং অর্থনীতির ক্লাসে এক সময় শিখেছিলাম, পভার্টি অ্যাণ্ড ফিকানডিটি গো টুগেদার। বিনোদন বলতে তাদের জীবনে আর তো কিছু নেই, তাই স্ত্রীসঙ্গমই হল নিত্যকার কর্ম। কারণ, যৌনানন্দ হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ। কেবল এই ধরাধাম কেন, মৃত্যু-উত্তর স্বর্গসুখেও তা গ্যারান্টেড। কাজেই তা যদি অবাধে চলতে থাকে, তবে সন্তান উৎপাদন ঠেকায় কে? সেটা ঠিকই আছে।  আবার এ ক্ষেত্রে, আমাদের দেশের বাস্তবতা অন্য একটি দিকের প্রতিও দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ফ্যামিলী প্লানিং জিনিসটা উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত অর্থাৎ যারা অধিক সংখ্যক সন্তানের ভরণপোষণে সমর্থ, তাদের ক্ষেত্রে যতটা কার্যকরী হয়েছে, নিম্ন আয়ের লোকজনের বেলাতে কিন্তু তেমনটি হয়নি। তাদের কাছে একটি হাত বাড়া মানে বাড়তি উপার্জনেরও ব্যবস্থা হওয়া। সুতরাং অধিক সন্তান তাদের জন্য একটি পজিটিভ ব্যাপার। তা ছাড়া, মাথা গুনতিকে মানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এখন বিকল্পহীন বলেই আমরা মেনে নিয়েছি। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই মূল নিয়ামক। তার জোগানটাই বা কে দেবে? ওরাই। কাজেই জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম কেমনজ্জএকজন মানুষের চারিত্র্য নির্ণয়ে সে বিবেচনাই অগ্রগণ্য । রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যে তা হয়নিজ্জসেটা তো পরিষ্কার। এর পাশাপাশি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও নতুন মাত্রা পেয়েছে। ব্রাহ্মসমাজভুক্ত রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে হিন্দু সমাজের খুব বেশী সময় না লাগলেও এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের তিনি দুচক্ষের বিষ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তিনি মুসলিম জীবন রূপায়ণে পরাক্সমুখ ছিলেন। এমন ভাবেও বলা হয় যে তাঁর কানে কখনও আজানের ধ্বনি প্রবেশ করেনি। যারা এ কথা বলেন, তারা নিজেরা যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেন, তা কিন্তু নয়। বরং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়ার জন্যই তাদের এ কথা বলা। নান্দনিকতা বিকাশের ধারা কিংবা শিল্পসাহিত্যের মূল কাজ সম্পর্কে হয়ত এক ধরনের মূর্খতা তাদের ভেতরে ক্রিয়াশীল,জ্জশুধু মাত্র এটা ভেবে তাদের করুণা কোন ব্যাপার এখানে নেই। কেন না, কে না জানে, কবিই বলি আর লেখকই বলি, আর শিল্পীই বলি, প্রত্যেকেরই একটা সামাজিক অবস্থান রয়েছে। তিনি তার লেখার উপাত্ত সংগ্রহ করবেন সেখান থেকেই। কিন্তু তার কাজ হবে কাউকে হিন্দু কিংবা মুসলিম কিংবা বৌদ্ধ-খৃষ্টান বানানো নয়। অবস্থানগত পারিপার্শ্বিকতার যে শৃঙ্খল, তা থেকে মানুষের যে শৃন্বন্ত রূপ, তার একটি রক্তাক্ত ছবি আঁকা। কিংবা তার আত্মার ক্ষরণ দেখানো। লক্ষ্য হবে তা থেকে মানবাত্মার মুক্তির সাধনা। নৈতিক মূল্যবোধই হোক আর ধর্মীয় অনুশাসনই হোক, তা গড়ে ওঠে সমাজের বিরাজমান পরিপ্রেক্ষিত থেকে। কিন্তু সমাজ তো নিয়ত পরিবর্তনশীল। কাল প্রবাহের ধারায় তার রূপের বদল ঘটতে থাকে ক্রমাগত। এ কারণে মঙ্গলামঙ্গলের ধারণা থেকেই আচরণীয় কিংবা অনারচণীয় যে রীতিনীতিগুলো গড়ে উঠেছিল, নষ্ট হয়ে যায় তার কার্যকারিতা। অবস্থা বিশেষে হয়ে দাঁড়ায় মানবতাবিরোধীও। এ পরিস্থিতিতে এক জন লেখক কি করবেন? তাকে তো বলতে হবে মানুষের মুক্তিরই কথাটা। হতে পারে সে মানুষ হিন্দু, হতে পারে মুসলমান বা এইরকম আরও কিছু। কাজেই তিনি মুসলিম সমাজের ছবি এঁকেছেন, না হিন্দু সমাজের, এ প্রশ্নটি নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। যে সমাজ কিংবা ধর্মীয় জনগোষ্ঠী থেকেই তিনি তার উপাদান সংগ্রহ করুন না কেন, তার ভেতর মানবাত্মাকে তিনি কি ভাবে ধরতে পেরেছেন, সেটাই হল মূল। তর্কের খাতিরে একটা তালিকা করে দেখানো কোন কাজের কথা নয় যে কতটা মুসলিম প্রসঙ্গ রবীন্দ্র-রচনাতে আছে। বরং যেটা দেখার, তা হল, তিনি যে সমাজকে তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়, সেই সমাজের মানুষগুলো কতটা মানবিক হতে পেরেছে? কতটাই বা মানব-মুক্তির পথে ধাবিত হয়েছে?

এখন কি কারণে রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তির টার্গেট হতে হয়েছে, সে বিষয়গুলি, বোধ করি, বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। আমার মনে হয়, তাঁর গুরুদেব হওয়াটা এ দেশের জল-হাওয়ারই মাজেজা। কথাটা যে ভাবেই বলি না কেন, আমাদের লোকজীবনে ভক্তিবাদ একটি ঐতিহ্যানুগত অনুসঙ্গ। আর এই ভক্তিবাদের সঙ্গে গুরুবাদের সম্পর্কও অঙ্গাঙ্গী। ধর্মাচারণের ভেতর দিয়ে ভক্তির যে ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়, গুরুই তার পথপ্রদর্শক। সাধন-ভজন যাই বলি না কেন, গুরুকে ধরেই তবে তার সিদ্ধি। তা ছাড়া, সব ধর্মেরই একটা মিস্টিক প্রেক্ষিত রয়েছে। এই মিস্টিসিজম মানুষের মনে এক অতীন্দ্রিয় বোধের পরিচর্যা করে থাকে। ব্যাখ্যাতীত যা কিছু রয়েছে, তার সবকিছুই গ্রহণযোগ্যতা পায় এই মিস্টিসিজমের মধ্যে। এক দিকে সৃষ্টিকর্তার নিরাকারত্ব বিশ্বাসে প্রোথিতজ্জতার কোন বস্তুরূপ নেই। অন্য দিকে ভগবান সৃষ্টি, পালন ও সংহারকর্তাজ্জএই তিন রূপে সাকার হয়েছেন, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে তার কোন আকার নেই। আবার  সাকারে যখন গুণ আরোপ করা হচ্ছে, তা-ও দাঁড়াচ্ছে  ভাববাদী ব্যাপার হয়ে। আর এই সব ভাবের অবস্থান যখন তুরীয়লোকে, তখন অঙ্কের হিসেবেই তা পরিণত হচ্ছে মিস্টিসিজমে।

ধর্মের এই জাতীয় মিস্টিক্যাল ব্যাপারগুলির প্রয়োগ যে বাস্তব জীবনেও ঘটে না, তা নয়। যে কোন ঘটনা কিংবা কাজের একটা তাত্ত্বিক যোগফল নামানোর প্রবণতা মানুষের মধ্যে হরহামেশাই দেখা যায়। সব কিছুর মধ্যেই দেবতাদের লীলাখেলা দেখতে পাওয়াটাও নতুন নয়। শিল্প-সহিত্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেও এর কমতি নেই। শ্রীকৃষ্ণ যাই করুন না কেন, তার ভেতরে পরমপুরুষেরই প্রতিভাস আমরা খুঁজে বের করি। রাধার শ্রীকৃষ্ণ ভজনাও প্রকৃতির প্রতিরূপে ঐ পরমপুরুষের দিকেই ধাবিত হয়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে’র রাধা-কৃষ্ণের ব্যাপারটার আবার আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় ইউসুফ-জোলেখাতে। একটির ঘটনা ঘটেছে ভারতবর্ষে, আরেকটির মিশরে। দুটোরই বিষয় পরকীয়া। রাধার স্বামী আইহন নপুসংক। ‘সতী ময়না লোর চন্দ্রানী’র বামনও তাই।  আমাদের বাংলা ভাষায় নপুসংক শব্দের প্রয়োগ আছে, কিন্তু অর্থটা ঠিক পরিষ্কার নয়। যৌন ক্ষমতা না থাকা কিংবা থেকেও বীর্যে সন্তান উৎপাদনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় শুক্রাণুর অভাব থাকা কোনটা এর মধ্যে পড়ে, শব্দটির প্রয়োগ রীতিতে তা সহজবোধ্য নয়। ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ যদি হয়, তবে অবশ্যই শুক্রাণু একটা ফ্যাক্টর। আর বিষয়টা যদি শুধু সেক্সের হয়, শুক্রাণু না থাকলেও, তাতে কি কোন সমস্যা থাকে? স্বামীর সাথে দেহমিলনের বিষয়টা বড়– চণ্ডীদাস খোলাসা করে বলেননি। জোলেখারও স্বামী সংস্পর্শ ঘটেনি। ইউসুফ যেহেতু তার নির্ধারিত পুরুষ, এ কারণে আজিজ মিসিরের ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেসনের ব্যাপার ঘটেছে। এক পরী এসে মিলিত হত তার সাথে।  যাই হোক, আমার মনে হয়, সাধারণ ভাবে স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরপুরুষের প্রতি ধাবিত হওয়াটাকে জাস্টিফাই করার জন্য এক জনের বেলাতে নপুসংতাকে উপলক্ষ্য করা যায়। আরেক জনের বেলাতে তো স্বপ্ন-দর্শন ইত্যাদির জন্য জিনিসটা একবারেই নিয়তি নির্ধারিত হয়ে পড়ে। তবে আমরা কিন্তু এখানেই থেমে থাকি না। রাধা কিংবা জোলেখার ব্যাপারটা তো সামাজিক অনাচার। বিশেষতঃ ইউসুফকে জোলেখার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল সন্তান হিসেবেই প্রতিপালন করার জন্য। তাদের এই কাজটাকে আরও জাস্টিফাই করার জন্য রাধা কিংবা জোলেখাকে রূপকায়িত করে এর একটা মিস্টিক্যাল চেহারা দাঁড় করাই। তখন তারা আর রক্ত-মাংসের মানুষ থাকে না। মঙ্গলকাব্যগুলিতে তো দেবদেবীরা প্রত্যক্ষ, জগৎ-সংসারে তাদের কার্যকলাপ মানুষের মত হীন হলেও, তারা তো দেবতাই। কিন্তু দৌলত কাজী কিংবা আলাওল যা করেন এবং সম্ভবত বুঝে-শুনেই করেছেন, তাকে এক কথায় মায়ার সৃজন বলেই, বোধ করি, আখ্যায়িত করা যায়। পাখীটিও এখানে আমাদের এক রহস্যময়তার সন্ধান দেয়। কাজেই, কত আর বলা যাবে? পটভূমিকাটা তৈরী হয়ে আছে এ ভাবেই। এক অর্থে এটা আমাদের আধ্যাত্মিকতারও পথ। এই আধ্যাত্মিকতার পথে হাঁটতে গেলে গুরু ধরা ছাড়া উপায় নেই। বাউল দর্শন কিংবা যে কোন লোকধর্মের কথাই বলি না কেন, তান্ত্রিক সাধনা কিংবা অন্যবিধ গোপন সাধন-পদ্ধতিজ্জসব কিছুতেই গুরু লাগে। পীরেরাও আলাদা কিছু নয় তারাও গুরু। সুতরাং এই রকম গুরুময় দেশে রবীন্দ্রনাথ যে গুরুদেব হয়ে যাবেন, তা কি কোন অপ্রত্যাশিত বিষয়? বিশেষতঃ তাঁর সাহিত্যে যেখানে ফুটে উটেছে আধ্যাত্মিকতার এক বিশাল রূপ, যার গভীরতা সমুদ্রের মতই অতলস্পর্শী, তার প্রখর সংবেদনশীলতা মানবচৈতন্যকে নিয়ে যায় এক রহস্যময় জগতে। বিষয়টাকে এ ভাবে ভাবলে হয়ত ঠিকই আছে। কিন্তু যখন তা, বলা যেতে পারে, অন্তঃসারশূন্য ভক্তির ফেনায় মাখামাখি করে ফেলে সব কিছু, তখন ভক্তদের বাড়াবাড়িটা বড়বেশী হাস্যকর হয়ে যায় না কি? হয়ত এ কারণেই তাঁর এই গুরুদেবত্ব লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় অন্যদের আক্রমণের। তা ছাড়া, যে কোন একটা লেবেল পরিয়ে দেয়ার অর্থই হল তাঁকে একটা সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে নিয়ে আসা। সেটা তাঁর জন্য যে কতটা অগৌরবের হয়, তা কি দরকার আছে ব্যাখ্যা করে বলার?

রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বানানোটা যেমন অতি উৎসাহের ফল, তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল বলাটাও তেমনই নতুন কিছু করে ফেলার উত্তেজনার ফসল। নতুন কিছু বলছি এ জন্যই যে,  আইডিয়া হিসাবে মার্কসবাদ ভারতবর্ষে এর অনুসারীদের একটা বড় অংশের ভেতরে গড়পরতা কিছু হিসাব কষে দিয়েছিল। যেমন, পৃথিবীতে দুটো ভাগজ্জএকটা হ্যাভ, অন্যটা হ্যাভ নট। তবে কতটা থাকলে হ্যাভ হবে, আর হ্যাভ নট-এর জন্য কতটা না থাকা দরকার,
সেটা ঠিক পরিষ্কার ছিল না। আসলে এ কথা দ্বারা আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা হল, সামাজিক বাস্তবতা বোধের একটা অভাব তাদের মধ্যে দেখা যায়। ধরা যাক, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবেজ্জএটা একটা প্রতিপাদ্য। সমাজের মানুষ শোষিত হচ্ছে বলেই শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটা আসে। কিন্তু কারা শোষক, তাও তো নির্ধারণের একটা ব্যাপার আছে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে পুঁজির বিকাশ সেভাবে ঘটেনি যে, সেই পুঁজি যারা নিয়ন্ত্রণ করছেজ্জতাদেরকে সহজেই শোষক বলে আডেনটিফাই করা যাবে। ভূমিকেন্দ্রিক যে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও একটা পাঁচমিশেলী অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের কোন কোন অংশে জমিদারী প্রথা থাকলেও বাকী জায়গায় তো আর তা ছিল না। লর্ড হেস্টিংসের আমলের পাঁচসালা/দশশালা বন্দোবস্তের পর ১৭৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে চিরস্থায়ী প্রথা চালু হয়। আর মার্কসীয় চেতনার নিউক্লিয়াস দানা বাঁধতে থাকে প্রথম মহাযুদ্ধ কাল থেকে। মাঝখানে কিন্তু চলে গেছে একশ-সোয়াশ বছর। সাবডিভিশন-ফ্রাগমেন্টাশানই বলি আর মালিকানা হস্তান্তরের ঘটনাই বলি, তাও কিন্তু চলেছে অবাধে। হয়ত মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বে সূর্য অস্ত না যাবার মত রাণী ভবানীর জমিদারীতেও তাই হত। কিন্তু তত দিনে অবস্থান্তর ঘটেছে তারও। কাজেই এখানেও একটা প্রশ্ন চলে আসে আইডেণ্টিফিকেশনের। এটা ঠিক যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন চলেছে। নানা স্থানে কৃষক বিদ্রোহ অর্জন করেছে সাময়িক সফলতাও। কিন্তু যে ভাবেই হিসেব করা যাক না কেন, তা ছিল না কোন সামগ্রিক ব্যাপার। আর সব চেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা হল, বৃটিশ ভারতে জাতীয় মুক্তি অর্জনের আন্দোলনই ছিল মুখ্য। আপামর জনসাধারণও উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তাতে। কাজেই মাঠ পর্যায়ে মার্কসবাদীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্র যেমন অনুকূল ছিল না, তেমনই চলমান আন্দোলনেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। এ অবস্থায়, আমার মনে হয়, সাংগঠনিক কার্যকলাপ যেহেতু ছিল সংকুচিত, এ কারণে তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেইজ্জব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জগতেই, বলা যেতে পারে, মাফ করবেন, এ কথার জন্য, অনেকটা চায়ের কাপে ঝড় তোলার মতই, তাদের ক্রিয়াকলাপ পরিদৃশ্যমান হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আমার আরও মনে হয়, একবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তাদের মধ্যে যে এত বিভাজন এবং যা কালে কালে কমেনি, বরং বেড়েছে, তার কারণও ঐ বিরাজমান পরিস্থিতিকে বিবেচনার মধ্যে না এনে, কেতাবী ছকে সব কিছু সম্পর্কে সারমন দেয়ার যে প্রবণতা, তা তাদেরকে একদিকে যেমন জনবিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, অন্যদিকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক পথের সন্ধানকল্পে তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতবিরোধিতাই জন্ম দিয়েছে এবং দিচ্ছে এত ভাগের। যা হোক, মার্কসবাদের ডিক্টেটরশীপ অব দি প্রোলেটােিয়ট, ডায়ালেকজ্জঠিক ম্যাটেরিয়লিজম, সারপ্লাস ভ্যালু ইত্যাদিজ্জআইডিয়া হিসেবে নতুন এবং চমকপ্রদ। আর শ্রেণীসংগ্রামজ্জশ্রেণীশত্র“র তো কথাই নাই, রীতিমত উত্তেজক। সুতরাং মাঠেময়দানে তা নিয়ে হাতপা ছোঁড়ার সুযোগ যখন কম, তখন বুদ্ধিবৃত্তির জগতেজ্জশিল্প-সাহিত্য-নান্দনিকতার বলয়ে একটা ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করাও তো কম কাজের কথা নয়। এ জন্য রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তাদের কাছে উপযুক্ত ব্যক্তি। যদিও এ দেশে মার্কসবাদ আসার বহু আগেই তিনি লিখেছেন, ‘এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে / দিতে হবে ভাষা; এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে / ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে...’ ইত্যাদি। এখন শুধুমাত্র দুঃখ-দারিদ্র-অভাবের দিনলিপি রচনা কিংবা মিছিল-মিটিং-শ্লোগানের বিবরণ দেয়া যদি মার্কসবাদী সাহিত্য হয়, তা হলে এটা ঠিকই ছিল, কিন্তু বিষয়টা তো তা নয়। মার্কিস্ট-নন্দনতাত্ত্বিকেরা তা স্বীকার করতেও দ্বিধা করেন না। আর করেন না বলেই প্রথম দিকে রবীন্দ্র বিচারের যে মাপকাঠি অনুসৃত হত, অতি অল্পকালের মধ্যেই তার পরিবর্তন ঘটে।

মার্কসীয় মানদণ্ডে রবীন্দ্র-বিরোধিতা যেমন ক্রমশঃ থেমে গেছে, কিন্তু তার পাশাপাশি বাঙালী মুসলিম সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে মূলতঃ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক ও বাহকেরা। প্রথম দিকে রবীন্দ্র-সাহিত্য নাকচ করে দেয়ার কোন উগ্র তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি, বরং তাঁর নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পর সূফী দর্শনের প্রভাব সেখানে কতটা কি ভাবে কাজ করেছে, তা নিয়েও অনেক মুসলমান লেখকই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ভেতর দিয়ে বৃটিশ শাসকেরা দৃশ্যতো ডিভাইড অ্যাণ্ড রুলের যে বিষবৃক্ষ বপন করে, তাতে যে ফলটি ধরে, তা হল, পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। এটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই পাকিস্তানী আদর্শে বাংলা সাহিত্য রচনার যে এলান আসে, সেখানে রবীন্দ্রনাথকে প্রত্যাখ্যান করার মনোভাবটাকেই করে তোলা হয় মুখ্য। রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথ, হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে লেখা নজরুলের লেখাগুলিকে পর্যন্ত অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে অর্জিত হতে থাকে ধর্মীয় কর্তব্য পালনের সোয়াবও। বাধা আসে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে। এক পর্যায়ে সরকারী প্রচার মাধ্যম রেডিওতে নিষিদ্ধ করা হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। এবং ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পরও রবীন্দ্রচর্চা যে একেবারে স্বচ্ছন্দ হয়েছে, তা ঠিক মনে হয় না। কেন না, যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে এক দিন পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই রাজনীতির ভূতের আছর এ দেশে এখনও কমেনি। বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থান দিনে দিনে তাকে করে তুলছে তীব্র। রাশিয়া ও তার সমাজতন্ত্র ঠেকানোর জন্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামিক শোভেনিজমের মদদ দেয়া শুরু করেছিল, এখন তা ফ্রাঙ্কেস্টাইন হয়ে চেপে বসেছে তারও ঘাড়ে। আজকে হয়ত সে জঙ্গীবাদ দমনের নামে সামরিক প্রয়োগে অতি উৎসাহ দেখােেচ্ছ, কিন্তু তার কোন আদর্শগত ভিত্তি না থাকায়, তা কতটুকু কাজে আসবে, সে সন্দেহ করাটাও অযৌক্তিক নয়। তদুপরি সাম্প্রতিক সময়ে তার ভূমিকা, তাও এই ইসলামী জঙ্গীবাদের পালে বাতাস দিচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলিতে যে অস্থিরতা, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই হাত রয়েছে, এমত বিশ্বাস বাংলাদেশের মুসলমানদের মনে দানা বেঁধে উঠছে। এ সব দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক শাসন থাক আর না থাক, এমন কি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানজ্জকার কোন কোন দেশের জনগণের সংগ্রামের ফলে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তাও তাদের মদদেই ঘটছে বলে প্রতীত করার মত লোকের সংখ্যা এখানেও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। কাজে কাজেই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রবীন্দ্রনাথকে নাকচ করা লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, এমন মনে করার তেমন কারণ আছে বলে মনে হয় না।

এখন কথা হল, এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বোধের কি করে সৃষ্টি হল আর তা বৃদ্ধির কি কারণ, সে বিষয়টিও, বোধ হয় আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। কি অসুখ হয়েছে, রোগ নিবারণের জন্য, তা যেমন জানা দরকার, এক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তিত হবার পর দেশে দেশে তা বিস্তৃত হয়। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষও তার মধ্যে পড়ে। ফকির-দরবেশ-পীর-আউলিয়াদের দ্বারা এটা ঘটলেও মূলতঃ রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণই ব্যাপক ধর্মান্তরকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। উদাহরণ হিসেবে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশের কথা বলা যেতে পারে। ব্যতিক্রম হিসেবে, বোধ করি, স্পেন ও ভারতবর্ষের কথাটি উল্লেখ করা যায়। এ দুটো জায়গায় শাসন ক্ষমতা মুসলমানদের হাতে এলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়নি। ভারতবর্ষের কোন কোন অঞ্চলে যেমন বঙ্গদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও টোটাল হিসেবে তারা সংখ্যালঘুই। আর আমরা যাকে মাইনরিটি সাইকোলজি বলি, তা হল, নিজেদের সংরক্ষণশীলতার বোধ। স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাটা তাদের অস্তিত্ত্বের জন্যই অত্যাবশ্যকীয়। কাজেই, নিজেদেরকে আলাদা রাখার একটা নিরন্তর প্রয়াসকে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবেই মেনে নিতে হয়। তবে বোধ করি, ভারতবর্ষ ব্যতিরেকে অন্যত্র প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার ফলে দেশের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের পৃথক করার ব্যাপারটা তত প্রখরতা পায়নি। এ জন্য, নিজেদের লোকায়ত সংস্কৃতি বর্জনটা মুখ্য হয়ে ওঠেনি। একটা উদাহরণ, যেমন, নাম রাখা। ইরানী, ইরাকী, তুর্কী কিংবা অন্যান্যরা নিজেদের মাতৃভাষাতেই সে কাজটি করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় তো ব্যাপারটি আরও মজার। রামায়ণ-মহাভারতের প্রভাব তাদের লোকজীবনেরই অঙ্গীভূত। তাদের অনেক নামই এখনও এ দুটো মহাকাব্যের বিভিন্ন চরিত্রের নামে হয়ে আসছে। কিন্তু ভারতবর্ষেও ক্ষেত্রে তো আর তা হয়নি। এখানে তো মুসলমানেরা সংখ্যালঘুই ছিল এবং এখনও তাই আছে। আর আমার মনে হয়, নিজেদেরকে এই আলাদা রাখার ব্যাপারটা ভারতবর্ষীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের জন্য একটু সহজই হয়ে গিয়েছিল। কারণ বহিরাগত মুসলমানেরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল, সেটাকে তারা ধর্মেরই অঙ্গীভূত জ্ঞান করেছিল। ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী মুসলমান ও তাদের বংশধরদের দিয়েই বিষয়টা, বোধ করি, খোলাসা করা যেতে পারে। যেমন, বাংলা ভাষায় যেহেতু বাঙালী হিন্দুরা কথা বলে, এ জন্য মাতৃভাষা হলেও  তাকে ধর্মশুদ্ধ বলে গ্রহণ করা যাবে না। আমার মনে হয়, অবাঙালী মুসলমানদের ভাষা ও সংস্কৃতির চাপটা বাঙালী মুসলমানদের ওপর একটু বেশীই ছিল। দিল্লীতে তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সময় থেকেই বঙ্গদেশ তার রাজনীতির আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে। সতের জন অশ্বারোহী নিয়ে এসে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের  যে মীথের সৃষ্টি করে দিলেন, বলা যায়, তা দিয়েই এর শুরু।। দিল্লী থেকে বিতাড়িত তুর্কী, আফগান, পাঠান, মোঘলসহ নানা জাতের মুসলমানেরা নিরাপদ আশ্রয় স্থল ভেবে এখানে যে ভাবে পুনর্বাসিত থাকে, সে ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে একেবারে ইংরেজদের পূর্ব পর্যন্ত শাসন ক্ষমতাও থাকে তাদেরই হাতে। এ কারণেও, বলা যেতে পারে, ধর্মান্তরিত হতে থাকলেও বাঙালী মুসলমানদের কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। আলাউদ্দিন হোসেন শাহই বলি, আর যার কথাই বলি, বাঙালী হিন্দুদের তাদের রাজসভায় যতটা উচ্চ আসন ছিল, পাশপাশি বাঙালী মুসলমানদের খুঁজতে গেলে মাইক্রোসকোপ ও টেলিসকোপজ্জদুটো ব্যবহার করেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালী হিন্দুদের সাথে সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করা বহিরাগত মুসলমান শাসকদের রাজনৈতিক বিবেচনার ফল, সে কথাটাও ম্যাকিয়াভেলী না পড়েই বলা যায়। তার পরও ইসলামের সামাজিক সাম্য বর্ণশাসিত হিন্দু সমাজের অধঃপতিদের ধর্মান্তরিত হতে যেমন  উদ্বুদ্ধ করে, তেমনই তাদের দ্বারা আচরিত সংস্কৃতি বর্জন করাটাও ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেই গৃহীত হয়। তবে, বোধ করি, এটাও ঠিক যে, আধুনিক কালে পুঁজি বিকাশের দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের আকাক্সক্ষা থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির যে বহিঃপ্রকাশ তখন তা ছিল না। বাঙালী মুসলমানদের হীনাবস্থাই ছিল সে সময়ের ঐতিহাসিক নিয়তি।
পরবর্তী কালে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ পুঁজির আগ্রাসন ও ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রই বলি আর নবাবতন্ত্রই বলি, তার মূলোচ্ছেদ করে। কিছু দেশীয় রাজ্য আর তার রাজারা থাকলেও, তা ছিল এ্যাকুরিয়ামে রাখা মাছের মত। এটাকে শো কেসে রাখা দর্শনীয় খেলনা-সামগ্রীও বলতে পারেন। প্রথম দিকে যদিও স্পর্শকাতরতার কথা ভেবে তারা হিন্দুদের জন্য এক ধরনের আর মুসলমানদের জন্য অন্য ধরনের শিক্ষার আর বিচারের প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু পরে ইংরাজী ভাষাবাহিত আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের মাধ্যমে ভারতবাসীর চিন্তা জগতে যেমন যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে, তেমনই বর্ণভিত্তিক পেশাগত গণ্ডীরও সীমারেখা ভেঙে দেয়। যেমন লেখাপড়া শিখলে চাষার ছেলের আর চাষা হবার বাধ্যবাধকতা থাকে না, তেমনই তাঁতীর ছেলেরও আর কাপড় বুনানোর দরকার পড়ে না, ঘোষের ছেলেও দধি-মিষ্টি তৈরী না করে স্বচ্ছন্দে হয়ে যেতে পারে জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট। জন্মের বন্ধন ছিঁড়ে শুরু হয় মানবিকতার দীক্ষা। এ ভাবেই দেখি, জন্ম নিতে থাকে একটি নতুন সম্প্রদায়জ্জ যাকে আমারা এখনও অভিহিত করি মধ্যবিত্ত বলে।

এবম্বিধ প্রভাবে বাঙালী হিন্দু সমাজের পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে, মোটামুটি, উনিশ শতকের গোড়া থেকেই। আর বাঙালী মুসলমানদের বেলাতে, প্রায় একশ বছর পরে, বিশ শতকের প্রারম্ভে।  এই বিলম্বের কারণ হিসেবে সাধারণ ভাবে, প্রায় মীথের আকারে যে সব কথা প্রচলিত আছে, সেগুলো তথ্য হিসেবে সেগুলি যেমন প্রশ্নসাপেক্ষ, তেমনই আবার অনেকাংশে হাস্যকরও বটে। যেমন বলা হয়ে থাকে রাজার জাত মুসলমানেরা রাজ্যহারা হয়ে গেল। আসলে তো ইংরেজ অধিকার বিস্তারের কালে ভারতবর্ষ কোন কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ছিল না। ভেঙে-চূড়ে তা পরিণত হয়েছিল নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে। এই রাজ্যগুলি মুসলমানেরা যেমন শাসন করত, হিন্দুরাও করত। হিন্দু-মুসলিম রাজাদের মিলিত প্রয়াসেই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। আর বাঙালী মুসলমানের কথা যদি বলেন, তারা তো রাজা কিংবা রাজধানীজ্জকোনটারই ধারে কাছে ছিল না। কাজেই, এ হিসেবে কেবল মুসলমানেরাই ফকির হয়ে গেল আর হিন্দুরা রাজা থেকে গেলজ্জতথ্য হিসেবে এটা বিভ্রান্তিকর নয় কি? আবার ইংরেজ প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থার কারণে মুসলমানদের সম্পদচ্যূত হওয়ার গল্পটাও বেশ জোরে-সোরে চালু আছে। তবে এটা বাংলার বাইরের ক্ষেত্রেও কতটা সঠিক, তা একটি জরীপ চালিয়ে দেখার বিষয়। কেন না, বৃটিশ আমলে উত্তর প্রদেশ কিংবা পাঞ্জাব কিংবা সিন্ধুর মুসলমানেরা  যে কি পরিমাণ সম্পদশালী ছিল, তা বোধ করি, নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বঙ্গদেশের ব্যাপারটা ভিন্ন। বৃটিশ-পূর্ব কালে এখানে বাঙালী মুসলমান ভূম্যধিকারীর সংখ্যা আদৌ ছিল কি না, তা একটি গবেষণার বিষয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেও তো দেখা যায় এক রাণী ভবানীই ছিলেন অর্ধবঙ্গেশ্বরী। কাজেই, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালী মুসলমানেরা যে নতুন করে জমিদারী হারিয়ে ফেলল, তাও যথার্থ বলে মনে করা মুশকিল। আসলে তাদের মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা না ঘটার মূল কারণ অতীতমুখিতা। বৃটিশেরা এ দেশে এসেছিল একটি নতুন সভ্যতা নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে তাদের রূপান্তর ছিল এই সভ্যতারই পরিণতি। এই সভ্যতার স্বরূপ উপলদ্ধির অক্ষমতা থেকে নিজেদের অধোগতির কারণ হিসেবে তারা ধর্মীয় বিচ্যুতিকেই তারা ভেবেছিল মূল কারণ। ধর্মীয় আচরণ যথাযথ হলে আবারও তাদের পূর্ব গৌরব ফিরে আসবেজ্জ এই বিশ্বাসে অতীতচারিতাকেই করেছিল আশ্রয়স্থল। কিন্তু ইতিহাসের চাকা যে পেছন দিকে ঘোরে না, তাই গত যুগ আর ফিরে আসেনি।       

তবে বাস্তবতার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে এক সময় সামনের দিকে এগিয়ে যাবার ব্যাপারটাও এসে যায়। আর বলা যায়, আরম্ভটা ভালই ছিল। মহিয়সী রোকেয়া কিংবা নজরুলের মত আধুনিক মানুষের আবির্ভাবও ঘটে তাদের মধ্যে। মাসিক সওগাত পত্রিকার প্রকাশ কিংবা ঢাকা মুসলিম সমাজের প্রতিষ্ঠা সূচনা হিসেবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এক দিকে অবাঙালী মুসলিম নেতৃত্ব, আর অন্য দিকে বাঙালী শিক্ষিত মুসলমানের মধ্যে পুঁজি বিকাশের সমস্যা, তাদেরকে ঠেলে দেয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালো গহ্বরে। বাঙালী শিক্ষিত মুসলমানেরা দেখেছিল, নিজেদের একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সৃষ্টি হবে এক অবাধ প্রতিযোগিতাহীন অবস্থার। তাদের করেকম্মে খাবার জন্যই এটা দরকার। আর মুসলমান হিসেবে আইডেণ্টিফাই করেই তা অর্জন করা সম্ভব। এর সব চেয়ে বড় প্রমাণ হল ১৯৪৬ সালের নির্বাচন। বাংলাই ছিল ভারতের একমাত্র প্রদেশ যেখানে পকিস্তান ইস্যুতে সংখ্যাগষ্ঠিতা পেয়েছিল মুসলিম লীগ। আর এটাও ঠিক যে আপামর বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত বাঙালী মুসলমানেরাই অনুপ্রাণিত করেছিল মুসলিম লীগকে ভোট দিতে। পরবর্তীতে অবশ্য নতুন করে জাতিগত নিপীড়নের সামনে দাঁড়িয়ে এই শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বপ্নভঙ্গ একটু বেশী দ্রুতই হয়েছিল। কিন্তু সে ইতিহাস তো ভিন্ন। কাজেই, যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার অপচেষ্টা, তাতে মুখ্যস্থান দখল করে আছে এই ধর্মীয় রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা।

এ প্রসঙ্গে, বোধ করি, একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী উৎসব’ (১১ভাদ্র, ১৩১১) কবিতাটি তাঁর মুসলমান বিদ্বেষের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি যৌক্তিক ভাবে বিবেচনা করলে এ অভিযোগ ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না। ‘মুসলিম’ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ‘হিন্দু’ মারাঠী শিবাজী হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর প্রতি হুমকী স্বরূপ। আমরা এটাও দেখি, তাঁর রাজত্বের প্রায় অর্ধেক সময়েই তাঁকে দাক্ষিণাত্যে কাটাতে হয়েছিল মূলতঃ এই শিবাজীরই কারণে। তাঁর সমাধিও হয়েছে সেখানে। তাঁদের এই দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে যেটা হিসেবের মধ্যে আনা হয় না, তা হল, এই বিরোধটা ছিল ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা ক্ষমতা দখলের লড়াই শুধু হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের নয়, হিন্দুর সঙ্গে হিন্দুর বা মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানেরও হয়েছে। মুসলমানদের ভেতরে সেই খেলাফতের কালেও কে ক্ষমতার অধিকারী হবে কিংবা কে সিংহাসনে বসবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত দ্বন্ধও লক্ষ্য করা গেছে। খোলাফায়ে রশেদীনের চার খলীফার খেলাফত পাবার প্রক্রিয়াও অবিকল এক রকম ছিল না। পরবর্তী সময় মাবিয়া তো কোন জনমতের ধার ধারেননি। খেলাফতের রাজধানী পর্যন্ত তিনি সিরিয়াতে স্থানান্তর করেন। তাঁর পুত্র এজিদ তো আক্রমণ করে কাবা শরীফও ধবংস করেছিলেন। আব্বাসীয় প্রথম খলীফা তো উমাইয়াদের হাড়হাড্ডিও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম বানিয়ে ছেড়েছিলেন। এ রকম উদাহরণের তো শেষ নেই। দিল্লীর সিংহাসন দখল নিয়েও অন্য রকম কিছু হয়নি। দাসবংশ-এর পরে খিলজী, তুঘলক কিংবা মোঘলদের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পরস্পরের যুদ্ধবিগ্রহের দ্বারা কতটা রক্তাক্ত, তা, বোধ করি, বলার  অপেক্ষা রাখে না। একই বংশের ভেতরে রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ ব্যক্তিরাও লিপ্ত থেকেছে হত্যা-ষড়যন্ত্র-হানাহানিতে। আওরঙ্গজেবের পিতামহের পিতামহও ঐ একই ভাবে ইব্রাহীম লোদীকে উৎখাত করে দখল করেছিলেন ক্ষমতা। আওরঙ্গজেব নিজেই বা কি করে সম্রাট  হয়েছিলেন, প্রয়োজন আছে কি সে ইতিহাস পুনর্ব্যক্ত করার? এটা ঠিক যে, ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে তিনি কঠোর ভাবে নিয়ানুবর্তী ছিলেন। যুদ্ধ চলা কালেও নামাজ পড়া থেকে বিরত হতেন না। কিন্তু রাজ্য শাসনের জন্য তাঁরও প্রয়োজন পড়েছে ধর্মীয় অনুশাসনের ঊর্ধ্বে ওঠার। এ জন্য আল্লাহ মাফ করনেওয়ালা বলে মাফও চেয়েছেন। মসজিদে অবস্থানরত বিদ্রোহীদেরকেও দমন করা হয় তাঁর সময়। কাজেই রাজনৈতিক কারণে তাঁর সাথে শিবাজীর যে সংঘাত, তাতে ধর্মীয় লেবাস পরানোর কোন সুযোগ নেই বলেই মনে হয়। দাক্ষিণাত্যে অবস্থান কালে আওরঙ্গজেব নিজে বেরার ও আহমেদাবাদ নামে দুটি  মুসলিম রাজ্যের স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন। তখনকার সময়ে শিবাজীর একাধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে এ দুটি স্বাধীন রাজ্যের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ছোটবেলায় স্কুলে ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে, তাই, বোধ করি, পড়তে হয়েছে যে, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য পতনের এটাও ছিল একটা কারণ । সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লিখে বাঙালী মুসলমানের ধর্মীয় বোধের কতটা ক্ষতি সাধন করেছেন, এ প্রশ্ন করাই যেতে পারে। তবে আমার মনে হয়, হিন্দু অথবা মুসলমান হিসেব করে নয়, শিবাজীকে অভিযুক্ত করার অন্য একটি ন্যায্য কারণ রয়েছ্।ে তাঁর বর্গী বাহিনী যে ভাবে লুণ্ঠন কার্য চালিয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অতিশয় মানবতা বিরোধী। বঙ্গদেশেও বর্গীদের আক্রমণ ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী সুবিদিত। তবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ন করতে চাইলে এ ভাবে ভাবার সুযোগ কোথায়?

এ প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণও টানা যেতে পারে। ‘সমস্যাপূরণ’(অগ্রহায়ণ, ১৩০০) গল্পটির মেসেজ যাই থাক, সেখানে ‘যবনীর গর্ভে’ হিন্দুুর ঔরসজাত এক সন্তান উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। এখন যবন শব্দের আভিধানিক অর্থ হল বিদেশী বা বহিরাগত। তারই স্ত্রীলিঙ্গ হল যবনী। এই বিদেশী বা বহিরাগতরা যে কোন জাতির হতে পারে। ভারতবর্ষে এ রকম বিদেশী বা বহিরাগত জাতির অভাব নাই। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন বাঙালী হিন্দু সমাজে নবজাগরণের সূচনা ঘটে, তখন যবন শব্দটি বিশেষ ভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে মুসলিমদের বেলায়। এবং তা শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় গালিতে। মুসলমানদের জন্যও তা পরিণত হয় অপমানসূচকে। তবে গল্পটিতে যে পরিস্থিতিতে একটি চরিত্রের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য তার মুখ দিয়ে শব্দটি উচ্চারণ করানো হয়েছে, তা বাস্তবানুগ ও যথাযথ। আমরা রেগে গেলে কি করি? স্থান-কাল-পাত্র ভুলে শালা-বাঞ্চোৎ বলে গাল দেই। এমত পরিস্থিতিতে কোন লেখায় যদি ওরকম ভাষা ব্যবহার না করা হয়, বরং সেটাই হয় কৃত্রিম। কাজেই ‘যবনী’ শব্দের ব্যবহার যে রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে হয়েছে, তা মনে করবার কোন কারণ নেই। কেন না, তিনি মুসলমানদের বহিরাগত হিসেবে দেখেননি। ‘ভারততীর্থ’ (গীতাঞ্জলি, ১৮আষাঢ় ১৩১৭) কবিতাতে ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীনজ্জ/ শক-হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’ বলার অর্থ কি? সবাইকে এ ভাবেই তিনি ভারতীয় করে নিয়েছেন। সুতরাং এখানে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ঘটনা তো অন্য জায়গায়। হিন্দু ও মুসলমানজ্জউভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই একটা স্পর্শকাতরতা বোধ খুব প্রবল। আর এটা এসেছে, বোধ করি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গীরই কারণে। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই তাদের কাছে ভোগের সামগ্রী হিসেবে নারী হল এক নম্বরের। সুতরাং কোন মুসলমান রমণী যদি কোন হিন্দুর সঙ্গে প্রণয় কিংবা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়, অথবা যদি  উল্টোটা ঘটে, তবে আর রক্ষা নাই। জাত-কুল-মান-মর্যাদা সবই যেন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেলজ্জএমন একটা প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়ে দেখা দেয়। যে সম্পদ আমার, তা বিধর্মীদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে, তার চেয়ে অপমানের আর বেশী কি থাকে? নারীরও যে একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, আর তা যে পুরুষের সমান, তা মেনে নেয়ার ব্যাপারটা নেই বলেই এই ফ্যাসাদ। মানবিক প্রবৃত্তিই বলি, আর জৈবিকতাই বলি কিংবা যৌনতার বোধই বলি, তা পুরুষের মধ্যে যেমন, নারীর ভেতরেও তা একই ভাবে প্রবহমান। ঘোড়ার সহিসের সাথেও রাজকন্যার ভালবাসা হয়। এখানে সহিস তো বিষয় নয়। উপলক্ষ্য হল পুরুষ। নারী পুরুষকে ভালবাসবে কিংবা পুরুষ নারীকেজ্জএটাই হল মানবিক ধর্ম। এমন হতে পারে, আর কোন পুরুষ পায়নি বলেই রাজকন্যা যাকে ভালবেসেছে, তার পেশা ছিল ঘোড়ার খবরদারী করা। যা হোক, বঙ্গদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার পেছনে এই অসম ধর্মীয় প্রণয় কিংবা বিবাহেরও কনট্রিবিউশন খুব একটা কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্র শুরু করলেন আয়েশা-জগৎসিংহকে দিয়ে, ইসমাইল হোসেন তার জবাব দিতে থাকলেন রায়নন্দিনী লিখে। সুতরাং এ রকম একটা পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ যবনীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করালেন, তা  মেনে নেয়া কি সহজ? আসলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার এই বোধ সৃষ্টিতে কিছু কিছু শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীর অবদান(?)ও, বোধ করি, নেহাৎ কম নয়। বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানজ্জউভয়েরই মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার লিখিত রূপের পরিচর্যা শুরু করেছিলেন বাঙালী বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যরা। এরপর তো চতুর্দশ শতাব্দী থেকে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানেরাও বাংলাভাষায় সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোযাগী হয়। মিশ্র ভাষায় রচিত দোভাষী পুঁথিগুলির কথা যদি ছেড়েও দেই,  শাহ মুহম্মদ সগীর, সাবিরিদ খান কিংবা দৌলত উজীর বাহরাম খানের মত কবিদের তো উল্লেখ না করা ছাড়া উপায় আছে কি? এরপর রোসাঙ্গ রাজসভার দৌলত কাজী কিংবা আলাওলের সহিত্যকীর্তিও কিংবদন্তীতুল্য। মধ্যযুগের এক মুসলিম কবি তো দোজখের আগুনে পোড়ার ভয় উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করার দুঃসাহসও দেখিয়েছেন। সর্বোপরি আবদুল হাকিমের ঘোষণা : ‘যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ...’জ্জতারও কি কোন তুলনা আছে? কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর নব্য শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা যখন বাংলা সাহিত্যেও ইতিহাস লিখতে শুরু করলেন, সেখানে এই সব কবিরা হতে থাকলেন উপেক্ষিত। সুকুমার সেন তো ‘ইসলামী বাঙ্গালা সাহিত্য’ (১৩৫৮) লিখে আলাদাই করে দিলেন তাদের। তার অর্থ এই সব লেখকেরা যেন এ দেশের কেউ নয়, বাংলা তাদের ভাষাও নয়। অনেকটা এখনকার সালমান রুশদী কিংবা অরুন্ধতী রায়রা যেমন ইংরেজীতে লিখছেন, তার মত। এ জাতীয় মনোভাবের একটা হাস্যকর উদাহরণ হল মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন। একজন মুসলমান এ রকম বাংলা ভাষা লিখেছে, ঘটনাটা যেন খুবই আশ্চর্যজনক। ভাব খানা হল বাংলা যেন বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা নয়। বলা যেতে পারে, এরই প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদেরও নিজেদের কীর্তিকাহিনী স্বতন্ত্র ভাবে প্রকাশ করা ভিন্ন উপায় থাকল না। উদ্দেশ্য যাই থাক, এতে করে বিভাজনের ওপরই প্রলেপ আরও গাঢ় হতে থাকল। একটা উদাহরণ হল, মুহম্মদ এনামুল হকের ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ (১৯৬৮)। এ জাতীয় কীর্তিকলাপের আরেকটি উদাহরণ হল, বাংলা সাহিত্যে ‘অন্ধকার যুগ’ চালু করা। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কী মুসলমানেরা এসে জগৎ-সংসার এমন ভাবে ছারখার করে দিল যে এক লাইন কবিতা লেখার মত অবস্থাও আর থাকল না, সব কিছু ঢেকে গেল ঘোর অমানিশাতে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সহই বলব এক শ্রেণীর বাঙালী হিন্দু পণ্ডিত এ ভাবেই প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড় করালেন মুসলমানদের। এটা করার আগে তারা এক বারও ভাবলেন না, তুর্কী আক্রমণের আগে কালের অবক্ষয় এড়িয়ে হাতে গোণা মাত্র কয়টি নিদর্শন পাওয়া গেছে বাংলা সাহিত্যের? গোয়াল ঘরসহ যদি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য’ অগ্নি দ্বারা ভস্মীভূত হত, তা হলে বাংলা সাহিত্যের বয়সই বা দাঁড়াত কোথায়? আমার এ কথা বলার অর্থ হল, নানা কারণেই নানা সাহিত্যিক নিদর্শন, চর্যাপদের যুগেরও বিনষ্ট হয়ে গেছে, সব তো আর পাওয়া যায়নি। ঐ যাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হচ্ছে, সে সময়ের রচিত সাহিত্যও যে নিশ্চিহ্ন হয়নি, সে বিষয়েও কি নিশ্চিত হওয়া যায়? পাশাপাশি এই কথাগুলোকে অযথার্থ প্রমাণ করার জন্য, মুসলমান লেখকেরাও প্রায় জীবন উৎসর্গ করে ফেললেন খুঁজে পেতে কিছু বের করা যায় কি না? এখন কিছু পাওয়া যাক আর না যাক, তুমি হিন্দু, আমি মুসলমান, তা ভাগটাই চলে এল সামনে। এ রকম ভাবেই, বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রসাহিত্যকে আর নিজেদের বলে ভাবার ক্ষেত্রেও তৈরী হতে থাকল দ্বিধা। সর্বোপরি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ছোবলে পড়ে তা হয়ে উঠেছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য।

এ সব তো গেল। অভিযোগের ফিরিস্তি যে আরও বাড়ানো যায় না, তাও নয়। তবে আরেকটি বিষয়, যা নিয়ে অনেকেই খড়গহস্ত হয়ে পড়েন, সেটিও, বোধ করি, আলোচিত হতে পারে। একবার রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনীর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯) শুরুর প্রায় এক যুগ আগে। ওরকম এক জন ফ্যাসিস্ট শাসকের সাথে দহরম-মহরম করে রবীন্দ্রনাথ মহাঅন্যায় করেছেন, এই অপবাদ এসে চেপেছে তাঁর ঘাড়ে। এখন কথা হল, মুসোলিনী হতে পারেন ফ্যাসিস্ট শাসক, তাঁর মিত্র হিটলার তো, সে অর্থে আর এক কাঠি বাড়া। এশিয়ার দেশ জাপান পর্যন্ত এই যুদ্ধে পক্ষাবলম্বন করেছিল তাঁদের। তথ্য হিসেবে এ সব ঠিকই আছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি, বোধ হয়, করা যেতে পারে, তা হল, কেন এই যুদ্ধ? আর যাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ করেছিল, তারাই বা কারা? এই যুদ্ধের আগে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড প্রভৃতি ইউরোপীয় এই দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার তো বটেই, আমেরিকান দেশগুলির অধিকাংশ ভাগাভাগি করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বাজারজাতকরণ ও তা থেকে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের গাণিতিক পরিণতিই এ ভাবে তাদের রূপান্তরিত করেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে। আমরা, তখনকার, ভারতবর্ষের অধিবাসীরাও ছিলাম এই রকম ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়ে। জার্মানী কিংবা জাপান যখন দেখল, সারা পৃথিবী জুড়ে যা করেকম্মে খাবার, তা ওরাই খাচ্ছে, তাদের আর পা ফেলবার জায়গাটুকুও নাই, তখন বল প্রয়োগ করা ছাড়া উপায় কি? আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই, তবে সহজ ভাবে যা বুঝি, তা হল, আসলে বিরাজমান পুঁজি আর বিকাশমান পুঁজির যে সংঘাত, তাই সৃষ্টি করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাতিগত সংঘর্ষের। ইতিহাসে বিজয়ীদের জয়গাথাই কীর্তিত হয়। হিটলার মুসোলিনীরা জয়ী হলে, তাদের নামই সেখানে লেখা থাকত সগৌরবে। না, এ কথাগুলো আমি তাঁদের ডিফেণ্ড করার জন্য বলছি না। যুদ্ধ সব সময়ই খারাপজ্জসর্র্ব অবস্থাতেই মানবতাবিরোধী। এ বিচারে তাঁরা অবশ্যই অপরাধী। তবে আমার কথা হল, তাঁদের এ অপরাধটাকে আমরা ওজন করছি ফ্রান্স ইংল্যাণ্ড কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যে দাঁড়িপাল্লা দিয়েছে, তার বাটখারায়। যুদ্ধ হচ্ছে রাজায় রাজায়, আর আমরা উলুখাগড়ারা একটা পক্ষ নিয়ে নিলাম, তা তো হয়না। আর পক্ষ যদি নিতেই হয়, তবে, বলতে পারেন এটা কুতর্ক, জার্মানী জাপান ইতালীর দিকে দাঁড়ানোর বিবেচনাটাই যৌক্তিক হয়ে উঠবে। কেন না, শত্র“র শত্র“ শত্র“, এই হিসেবে হলেও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাদের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। মনে করে দেখুন, নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ কাদের সশস্ত্র  সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল? অন্য দিকে যুদ্ধ শুরুর চৌদ্দ বছর আগে এক জনের আতিথ্য গ্রহণ কালে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই জ্যোতিষী ছিলেন না যে তার হাত দেখে জেনে যাবেন ভবিতব্য কি হবে? তা ছাড়া, আরেকটি বিষয় হল, যুদ্ধরত দেশগুলির শাসক সম্প্রদায়ের চরিত্র বিচার করলে, তাদের মধ্যে তেমন পার্থক্য করা মুশকিল। কিন্তু তাদেরও জাতিগত ঐতিহ্যের ব্যাপারটি যদি সামনে আনা যায়, সেখানে বৃটিশের কিংবা মার্কিনীদের সাথে জার্মান কিংবা ইটালিয়ানদের ফারাক দুস্তর। ইতালী থেকেই এক সময়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নতুন চিন্তার যে উন্মেষ ঘটেছিল, তার ভেতর দিয়েই তো আধুনিকতার সূত্রপাত। শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞানে জার্মানদের গুরুত্বও অপরিসীম। সে তুলনায় ইংরেজদের অর্জন, বোধ করি, তেমন উল্লেখের দাবী রাখে না। আর মার্কিনীরা তো ন্যাংটোজ্জএকবারেই ভুঁইফোড় জাতি।

আবার এটাও দেখা যায়, নানাবিধ অভিযোগ-অনুযোগের পাশাপাশি রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ নিয়ে সুড়সুড়ি দেয়ার কাজটিও অনেকে যেন কর্তব্যজ্ঞানেই নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেছেন। মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে আর কতটুকু লেখা হয়েছে, কিন্তু বৌদি কাদম্বিনী দেবী কিংবা আনা তরখর কিংবা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোজ্জএঁদের সম্পর্কে  উৎসাহের কোন শেষ নেই। পরের বাড়ীর পিঠা গালে লাগে মিঠা। বৈধী সম্পর্কের বাইরে মেয়েমানুষ নিয়ে আমাদের কৌতুহল অন্তহীন রবীন্দ্রনাথের মত মানুষদের জীবনে এ রকম একস্ট্রা ম্যারিটাল সম্পর্ক নিয়ে লেখালেখি করে চমক সৃষ্টি করাটা তো রীতিমত প্রতিযোগিতারও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ঠিক যে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের প্রচলিত ধরণটা এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভবের কাল থেকে। সে হিসেবে নারীরা কেউ আমাদের মাতা, কেউ কন্যা, কেউ জায়াজ্জএই রকম আর কি? এ সব সম্পর্কের সীমা আবার নানা সামাজিক অনুশাসন দ্বারা সুস্প®ট ভাবে চিহ্নিত। মাতা কিংবা কন্যাকে ভালবাসা আর স্ত্রীকে ভালবাসা, এই সামাজিক অনুশাসনের কারণেই এক নয় যৌনতার বিষয়টিও এই সামাজিক অনুশাসনই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনেও তা একই রকম। একষ্ট্রা ম্যারিটাল সেক্সজ্জআইনত একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ভালবাসার আকার-প্রকার না থাকলেও, তা সমাজ অননুমোদিত হলে গ্রহণযোগ্য হয় না। কিন্তু সংস্কার, বিধিনিষেধ, মূল্যবোধ, অনুশাসনের কথাই বলি আর আইনের ভয়ই দেখাই, জৈবিক প্রবৃত্তি সব সময় তা মেনে চলে না। এই না মেনে চলাটা একদিকে যেমন নিন্দা-সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরী করে, অন্য দিকে আবার তা মুখরোচক ব্যাপার হয়ে স্থায়িত্ব পেতে থাকে। বড় বড় মানুষজ্জযারা সাধারণ ভাবে শ্রদ্ধেয়, তারাও এ রকম অবৈধ প্রণয় কিংবা যৌনতায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বিষয়টা পৌনেঃপুনিক ভাবে নিয়ে আসাটাজ্জএকটা কিছু করে দেখাচ্ছি আর কি, এমন স্টাণ্টবাজিরই জন্ম দেয়। এই হিসাবে রবীন্দ্রনাথ তো এক নম্বর। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, যে কোন মহৎ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য আমাদের জানা দরকার। কিন্তু সেই তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যদি নিজেদের কল্পনা শক্তিকেও ব্যবহার করতে থাকি, তা হলে, বোধ করি বিপত্তির শেষ থাকে না। কাদম্বিনী দেবী যখন ঠাকুর পরিবারে বউ হয়ে আসেন, রবীন্দ্রনাথ তখন কিশোর। বাল্য বিবাহের কারণে কাদম্বিনী দেবীরও কৈশোর অতিক্রান্ত হবার কোন কারণ ছিল না। তাঁর এই বৌদিটির প্রতি অনুরাগের কথা তিনি গোপনও রাখেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই অনুরাগের মাত্রা নিয়ে। তবে তার ভেতর নিষিদ্ধ যদি কিছু থাকত, তা হলে, আমি যা বুঝি, গলা বাড়িয়ে তা বলার দরকার পড়ত না। সমাজ-সংসারের যা রীতি, তাতে অপরাধী কি কখনও অপরাধ স্বীকার করে? তার পর আনা তরখরের ব্যাপারটাও রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন। প্রেমজ বিষয় যদি কিছু ঘটেই থাকে, তা নিয়ে লালা ঝরানোর কি আছে? আর সত্তুরোর্ধ্ব বয়সে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে যদি বিজয়া বলেই ডেকেই থাকেন, তাতে রঙ চরানোরও তো কিছু দেখি না? রবীন্দ্রনাথের মত এক জন কবিকে অতিথি হিসেবে পাওয়াটা একটা বিরাট বিষয়। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে সে অতিথির সে সেবা করাটাই তো পরম সৌভাগ্য। এখানে উজাড় শব্দটি ব্যবহার করেছি বলে আবার অন্য রকম কিছু ভাববেন না। আর রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন, তার মধ্যে অস্বাভাবিকতারও তো কিছূ নেই। এখন যারা এটা করছেন, তারা বলতেই পারেন, আমাদের লক্ষ্য সত্য অনুসন্ধান। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সত্য অনুসন্ধানের বাস্তব ফল কি? যদি ধরেও নিই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিছানায় গেছেন, তাতে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতিই বা কি, আর বৃদ্ধিই বা কি? লালন হিন্দু ছিলেন কি মুসলমান ছিলেন, সেটা প্রতিপন্ন করার জন্য যাবতীয় মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হবে?জ্জএই রকম আরও বহু জিনিস আছে, যা হয়ে দাঁড়িয়েছে গবেষণার বিষয়। বহু লোককে বানিয়েও দিচ্ছে পণ্ডিত। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলেছেন, ‘পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল’ (সেকাল, ক্ষণিকা, ১৯০০) প্রথমে তো নির্ধারণ করতে হবে সাহিত্যের মূল্য বিচারে এগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক? মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নয়, তার কাজটাই থাকে মানুষের জন্য। কাজেই কার সঙ্গে কার বিয়ে হল আর না হল, কেইবা পতিতালয়ে গিয়ে সিফিলিস বানিয়ে ফেলেছিলেন, সাহিত্যের রস আস্বাদন কিংবা মূল্য বিচারে, আমার বিবেচনায়, তা একেবারেই গুরুত্বহীন। আরও একটা জিনিস, বোধ হয়, ভেবে দেখার আছে। তা হল, আমরা যে কথাই বলি না কেন, তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে বিরাজমান নৈতিকতা কিংবা সামাজিক মানদণ্ড কিংবা পাপ-পুণ্যের বোধ কিংবা রাষ্ট্রীয় আইনের ভীতি। কিন্তু এগুলি তো কোন স্থায়ী জিনিস নয়। বিবাহ নামক প্রথাটার কথাই ধরা যাক। এক সময় তো ও সবের বালাই ছিল না। এখন আবার তা মানুষ ভাঙতে সুরু করেছে লিভ টুগেদার-এর নাম করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পিতৃত্ব একটা অতি আবশ্যকীয় উপাদান। এখন এমন একটা অবস্থার কল্পনা করুন, যেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি স্পার্মব্যাংক। সেখান থেকে আনআইডেণ্টিফায়েড শুক্রাণু ও ডিম্বাণু এনে ল্যাবরোটারীতে বানানো হচ্ছে মানুষ। এই মানুষ তো কারও সাথে কোন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। তার তো বিবাহ করারও প্রয়োজন নেই। মানব প্রজন্মের এ হেন বাস্তবতাতে পরনারী কিংবা পরপুরুষ গমনজ্জকোনটাই কোন নৈতিকতাবিরোধী কিংবা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় নয়। আমরা যেমন সিন্ধু কিংবা সুমেরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে নানা কিছু লিখি, তারা তেমনই আমাদের সম্পর্কে লিখবে, এরা নারীগর্ভে সন্তান উৎপাদন করত। যা হোক, এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হল, মানুষের ব্যক্তিজীবন তার আয়ুস্কালের সীমায় আবদ্ধ। তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও সেই সময়েরই আওতাভুক্ত। সেই সময় কিংবা সীমা অতিক্রান্ত হবার পর, তা নিয়ে মেধা ও শ্রম ক্ষয় করাটাও একটা বাহুল্য বিষয়।

প্রমথ চৌধুরীর অনেক কথাই আমি মানি। তার ভেতর একটা হল, আমাদের সভ্যতাই বলি আর শিল্প-সহিত্য-সংস্কৃতিই বলি, সেখানে যারা কালোত্তীর্ণ হয়ে আমাদের মেধা ও মননের সাথে যুক্ত হয়ে আছেন, একটা স্থায়ী মূল্য পেয়েছেন, তাঁদের নিয়ে অযথা নিন্দা কিংবা প্রশংসা করা কোন কাজের কথা নয়। যে অমরতা তারা পেয়েছেন, তার কারণ অনুসন্ধান করাটাই জরুরী (ভারতচন্দ্র, শ্রাবণ ১৩৩৫)। তাঁর এ কথার সাথে আমি আরও যা যুক্ত করতে চাই, তা হল, তাঁরা যা করে গেছেন, তা তো আমাদের সামনে রয়েছেই। সেখান থেকে যেটুকু আমাদের প্রয়োজন, সে টুকুই আমরা আমাদের কাজে লাগাই। আমাদের মেধা ও মনন বিকাশের জন্য, আমাদের চিৎপ্রকর্ষের জন্য, আমাদের প্রগতি ও অগ্রগতির জন্য তা ব্যবহার করি। অর্থাৎ ভালটুকু আমরা নিই। আর তা না করে যদি কেবল ছিদ্রান্বেষণ করতে থাকি, তবে তাতে আমাদেরই অসৎ মনের পরিচয় ফুটে ওঠে না কি? আপনারা নিশ্চয়ই মানবেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এ কথাগুলি কতটা সত্য। তাঁকে আশ্রয় করে বাঙালী জাতির বেড়ে ওঠার পথ-পরিক্রমায়, সর্বমানবিক বোধের দীক্ষায় অযথা কালিমা লেপনের অর্থই হল নিজেদেরই পায়ে কুড়–ল মারা। আর একটি কথাও, বোধ করি, মানা দরকার। কায়কোবাদ তাঁর মহাকাব্য মহাশ্মশান (১৯০৪)-এর ভূমিকাতেও, বোধ করি, বহু ঘা খেয়েই, তা উল্লেখ করেছেন :

        সজ্জনা গুণমিচ্ছন্তি মধুমিচ্ছন্তি ষটপদাঃ।
        মক্ষিকা ব্রণমিচ্ছন্তি দোষ মিচ্ছন্তি পামরাঃ।

এর একটা বাংলা রূপান্তরও দেখেছি :

        সজ্জন গুণ খোঁজে, দোষ খোঁজে পামর।
        মক্ষিকা ব্রণ খোঁজে, মধু খোঁজে ভ্রমর।
এখন কথা হল, জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে না হয় দোষ অন্বেষণ করে, তা সংশোধনের একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, কিন্তু মৃত মানুষের বেলায় তার তো কোন পথ নাই, বরং খোঁজাখুঁজি বেশী করতে গেলে তা নিজেদের মধ্যেই সংক্রমিত হওয়ার আশংকাও একবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।  
সুতরাং রবীন্দ্রপ্রসঙ্গেও এই পামর হবার কি কোন প্রয়োজন আছে?

৪৮ ॥ বিহাস-রাজশাহী







হোসেনউদ্দীন হোসেন
সাহিত্যের সত্য : রবীন্দ্রনাথ


________________________________________________________


রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য ও সত্য সম্পর্কে একটি আলোচনায় অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, চিরন্তনের তিনটি স্বরূপ- সত্যম, জ্ঞান এবং অনন্তম। এই তিনটি স্বরূপকে আশ্রয় করে মানব অস্তিত্ব তিনটি রূপে প্রকাশিত। তিনটি রূপ হলো-ক) আমরা আছি, খ) আমরা জানি ও গ) আমরা প্রকাশ করি। মানুষের এই তিনটি দিক নিয়েই একটি অখণ্ড সত্য। এটা হল একটা দর্শন তত্ত্ব। এই দর্শনের মধ্যে রয়েছে মানব অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। ব্রহ্মের সত্য স্বরূপের একটি দিক হল-আমি আছি; তার জ্ঞান স্বরূপের আর একটি দিক হল-আমি জানি, এবং ব্রহ্মের অন্তস্বরূপের মধ্যে রয়েছে তৃতীয় দিকটি-আমি প্রকাশ করি। মানুষ এই তিনটি সত্য নিয়ে জীবনধারণ করছে। জীবনধারনের মূলে রয়েছে জীবনকে আনন্দময় করে তোলা। সংসারে দুঃখ-কষ্ট আছে, শোকও বেদনা আছে-তবুও মানুষ এই সংসারকে নরককুণ্ড বলে অভিহিত করে না। বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা নয়। জীবনের জন্য এমন কি  আছে যে, মানুষ তার অস্তিত্বকে কখনো ছোট করে দেখে না।

রবীন্দ্রনাথ এই সত্য উপলব্ধি করেছেন মানুষের জীবনযাপন নিরীক্ষণ করে। তিনি উচ্চবিত্তদের জীবনযাপন যেমন উপলব্ধি করেছেন, তেমনি নিম্নবিত্তদেরও জীবনযাপন উপলব্ধি করেছেন। শ্রমজীবী মানুষকেও তিনি খাটো করে দেখেন নি। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল এমন তীক্ষè যে, কোনো কিছু তার চোখ থেকে এড়িয়ে যায় নি। যারা উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তাদের জীবনযাপনের মধ্যেও তিনি উপলব্ধি করেছেন এক ধরনের আনন্দ প্রকাশ :

টিটাগড়ের পাটকলের কারখানায় যে মজুরেরা খেটে মরে তারা মজুরি পায়, কিন্তু তাদের হৃদয়ের জন্যে তো কারো মাথা ব্যথা নেই। তাতে তো কল বেশ ভালই চলে। যে মালিকেরা শতকরা ৪০০ টাকা হারে মুনাফা নিয়ে থাকে তার তো মনোহরনের জন্য এক পয়সাও অপব্যয় করে না, কিন্তু জগতেতো দেখেছি, সেই মনোহরনের আয়োজনের অন্ত নেই। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, এ কেবল ভোগদেবের মুগ্ধবোধের সূত্রজাল নয়, এযে দেখি কাব্য। অর্থাৎ দেখছি, ব্যাকরনটা রয়েছে দাসীর মতো পিছনে, আর রসের লক্ষী রয়েছেন সামনেই। তা হলে কি এর প্রকাশের মধ্যে দণ্ডির দণ্ডই রয়েছে, না রয়েছে কবির আনন্দ?

এই মন্তব্যের মধ্যেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানুষ সম্পর্কে ধারণা। দুঃখ, যন্ত্রনা ও শোক থাকলেও মানুষের বেঁচে থাকার মধ্যে রয়েছে একটা আনন্দ। মানুষের ব্যক্তি রূপটি হচ্ছে তার নিজস্ব, সেটা তার নিজের মধ্যেই একান্ত আবদ্ধ। সে নিজেকে নিজের মধ্যে প্রকাশ করতে পারে না। যখন তার পরিচয় কেউ জিজ্ঞাসা করবে, তখনই একটা বড় সত্যের দ্বারা সে নিজের তথ্যগত পরিচয় দেবে-আমি অমুক। এই অমুক কথাটা সত্যের উপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হচ্ছে যে, তথ্য যাকে অবলম্বন করে আছে, সেটাই হচ্ছে সত্য।
সাহিত্যের কাজ তথ্যকে নিয়ে নয় তথ্যের পাত্রকে নির্ভর করে যে সত্য-তাকে নিয়েই। চিরকাল মানুষ এই সত্যের স্বাদ গ্রহণ করেছে। স্বাদ হচ্ছে একের স্বাদ, অসীমের স্বাদ। ব্যক্তি মানুষ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্যাপক থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি মানুষ, এটা হল তার অসীমের অভিমুখী কথা; এখানে ‘আমি মানুষ’ বিরাট একের সঙ্গে যুক্ত। কেননা, সত্যের পূর্ণরূপ যখন আমরা দেখি তখন তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্বন্ধের দ্বারা আকৃষ্ট হই না-সত্যগত সম্বন্ধের দ্বারা আকৃষ্ট হই।

সাহিত্যশিল্পে কোন বস্তু যে সত্য তা নির্ণয় হয় রসের মাধ্যমে। এই কারণে রসের ভূমিকা এখানে বিরাট এবং ব্যাপক। বস্তু যদি এমন একটি রূপরেখায় গীতের সুষমাযুক্ত ঐক্য লাভ করে, যাতে করে মানুষের চিত্ত আনন্দের মূল্যে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে, তা’হলেই তার পরিচয় সম্পূর্ন হয়। তা যদি না হয়, অথচ যদি তথ্য হিসাবে সে বস্তু একেবারে নিখুঁত হয়, তাহলে অরসিক তাকে বরমাল্য দিলেও রসজ্ঞ তাকে বর্জন করেন।

রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে স্পষ্টই বলেছেন যে, রূপের মহলে রসের সত্যকে প্রকাশ করতে গেলে তথ্যের দাস্খত থেকে মুক্তি নিতে হয়। রসবস্তু এবং তথ্যবস্তু ভিন্ন। তথ্যজগতের আলোকরশ্মি যেখানে এসে দেয়ালে বাঁধা পড়ে, রসজগতের আলোকরশ্মি সেই দেয়াল অনায়াসে অতিক্রম করতে পারে। সাহিত্যের যেমন রসবস্তু আছে-তেমনি আছে সুন্দরের বিস্তীর্ন ক্ষেত্র। সাহিত্য সুন্দর হয়ে ওঠে রস আছে বলেই। এই রস বস্তুটি নিয়েই রবীন্দ্রনাথের আমলে তার সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে নানাজনে নানারকম প্রশ্ন তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এর জবাবে শুধু বলেছিলেন : ‘দাড়িপাল্লায় চড়াইয়া রস জিনিসটার বস্তু পরিমাণ করা যায় না এ কথা সত্য, কিন্তু রসপদার্থ কোন একটা বস্তুকে আশ্রয় করিয়াতো প্রকাশ পায়। সেইখানেই আমরা বাস্তবতার বিচার করিবার সুযোগ পাইয়া থাকি। নিশ্চয়ই রসের একটা আধার আছে। সেটা মাপকাঠির আয়ত্তাধীন সন্দেহ নাই। কিন্তু সেইটাই বস্তুপিণ্ড ওজন করিয়া কি সাহিত্যের দর যাচাই হয়।’ উপরিউক্ত সাহিত্য বিচারকদের মতে বাস্তবতা জিনিসটা কী, তার একটা সূত্র রবীন্দ্রনাথ ধরতে পেরেছিলেন। তারা বাস্তবতা বলতে বুঝতে চেয়েছেন যে রচনার তথ্য সামগ্রী থাকা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার মধ্যে তারা কেবলমাত্র বাস্তবতার একটু উপকরণ খুঁজে পেয়েছিলেন ‘গোরা’ উপন্যাসে।

‘গোরা’ উপন্যাসে কী বস্তু আছে তা সবচেয়ে কম বুঝতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন যে, প্রচলিত হিন্দুয়ানির ভালো ব্যাখ্যা ওই উপন্যাসটিতে আছে। এর থেকে তিনি আন্দাজ করে নিয়েছিলেন ওটাই একটা সাহিত্য সমালোচকদের ধারণা মতে বাস্তবতার লক্ষণ।
উল্লেখ্য যে, তৎকালে সারা ভারতবর্ষে হিন্দু তার হিন্দুত্ব নিয়ে ভয়ঙ্করভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। বিশ্ব রচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি। এটাই ছিল তাদের একমাত্র প্রমান করার উন্মাদনা। এই ধর্মীয় উন্মাদনা ‘গোরা’ উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন বলেই ‘গোরার’ মধ্যে সাহিত্য সমালোচকরা বাস্তবতার লক্ষণ খুঁজে পেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস রচনার পশ্চাতে হিন্দুর হিন্দুত্বকে বড় করে তুলে ধরার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু সমালোচকরা সেইটিকেই বড় করে দেখেছেন এবং বাস্তবধর্মী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আসলে এই উপন্যাসে সত্যের চেয়ে তথ্যকে তারা প্রাধান্য দিয়েছেন অতিশয়। যার ফলে সাহিত্যের জন্য যে সত্য, সেই সত্য তাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে নি। খামাখা সাহিত্য সমালোচনার নামে সাহিত্যকে বিচার না করে সামাজিকভাবে বিচার সৃষ্টি করে তর্ক তুলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেছিলেন :
সেটা ছিল সামাজিক বাস্তবতার তর্ক-যদি প্রতিকার করিতে পারো, করিয়া দাও, কাহারও আপত্তি হইবে না। তানসেন তাই বলিয়া মেঠোসুর তৈরি করিতে বসিবেন না। তাহার সৃষ্টি আনন্দের সৃষ্টি, সে যাহা তাহাই, আর কোন মতলবে সে আর কিছু হইতে পারেই না। যাহারা রসপিপাসু তাহারা যতœ করিয়া শিক্ষা করিয়া সেই ধ্র“পদগুলির নিগুঢ় মধু কোষের মধ্যে প্রবেশ করিবে। অবশ্য লোক সাধারণ যতক্ষণ সেই মধু কোষের পথ না জানিবে ততক্ষণ তানসেনের গান তাহাদের কাছে সম্পূর্ন অবাস্তব, এই কথা মানিতেই হইবে। তাই বলিতেছিলাম, কোথায় কোন বস্তুর খোঁজ করিতে হইবে, কেমন করিয়া খোঁজ করিতে হইবে, কে তাহার খোঁজ পাইবার অধিকারী, সেটাতো নিজের খেয়ালমত এক কথায় প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায় না।
তিনি আরো বলেছেন যে উপলব্ধিই হচ্ছে সাহিত্যের একমাত্র অবলম্বন। কবি যদি একটা  বেদনাময় চৈতন্য নিয়ে জন্মে থাকেন, যদি তিনি নিজের প্রকৃতি নিয়ে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা করে থাকেন, যদি শিক্ষা অভ্যাস প্রথা শাস্ত্র প্রভৃতি জড় আবরণের ভিতর দিয়ে কেবলমাত্র দশের নিয়মে তিনি বিশ্বের সঙ্গে ব্যবহার না করেন, তবে তিনি নিখিলের সংশ্রবে যা অনুভব করবেন, তার একান্ত বাস্তবতা সম্বন্ধে তার মনে কোনও সন্দেহ থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের এই ধারণাটা ছিল দার্শনিক। তিনি সাহিত্যের বস্তুকে হাটের বস্তু বলে মনে করেন নি। সাহিত্যের বস্তু হাটের পণ্যের মতো দাড়িপাল্লায় মেপে দরাদরি করার জিনিস নয়। তিনি এ সম্পর্কে স্পষ্টই বলেছেন :

বাস্তবের হট্টগোল নিয়ে যারা মেতে থাকেন তাদের কাব্য হবে হাটের কাব্য। যারা প্রকৃতই কবি তাদের অন্তরের মধ্যে ধ্র“ব আদর্শ রয়েছে, সে আদর্শ হিন্দুর নয়-মুসলমানের নয়-এমনকি লোকহিত্যের ও একাডেমিক আদর্শ নয়।

সাহিত্যের সত্য হচ্ছে অনির্বচনীয় ও আনন্দময়। সাহিত্যের বাস্তবতার মধ্যে সাহিত্যিকের নিজের যে প্রমাণ, তিনি জানেন, বিশ্বের মধ্যেই সেই প্রমাণ রয়েছে। সেই প্রমানের অনুভূতি সকলেরই থাকে না-যার থাকে না তার কাছে মিথ্যাটা মিথ্যা। যে লোক চোখ বুজে থাকে তার কাছে আলো যেমন মিথ্যে-এটাও তেমনি মিথ্যে। তথ্যের গণ্ডি থেকে মানুষ যখন সত্যের অসীমতায় প্রবেশ করে, তখন তার মূল্যও পরিবর্তন হয়ে যায়। তুচ্ছ জিনিস হয়ে ওঠে অমূল্য। তখন সেই জিনিস আর তুচ্ছ থাকে না। রূপান্তরিত হয় একটি অখণ্ড সত্যে। এই অখণ্ড সত্যের ক্ষয় নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

শুধু কেবল মানুষ কেন, অজীব সামগ্রীকে যখন আমরা কাব্য কলার রথে তুলে তথ্য সীমার বাইরে নিয়ে যাই তখন সত্যের মূল্যে মূল্যবান হয়ে ওঠে। কলকাতায় আমার এক কাঠা জমির দাম পাঁচ দশ হাজার টাকা হতে পারে, কিন্তু সত্যের রাজত্বে সেই দামকে আমরা দাম বলে মানিনে-সে দাম সেখানে টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায়। বৈষয়িক মূল্য সেখানে পরিহাসের দ্বারা অপমানিত। নিজলোকে রসলোকে তথ্য বন্ধন থেকে মানুষের এই যে মুক্তি, একি কম মুক্তি। এই মুক্তির কথা আপনাকে আপনি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য মানুষ গান গেয়েছে; ছবি এঁকেছে, আপন সত্য ঐশ্বর্যকে হাটবাজার থেকে বাঁচিয়ে এনে সুন্দরের নিত্য ভাণ্ডারে সাজিয়ে রেখেছে; তার নি-কড়িয়া ধনকে নি-কড়িয়া বাঁশীর সুরে গেঁথে রেখেছে। আপনাকে আপনি বারবার বলেছে ঐ আনন্দলোকেই তোমার সত্য প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তা বৈষয়িক লোকের চিন্তা নয়-তার চিন্তা ভাবলোকের। একমাত্র ভাবুক মানুষ ছাড়া-তার বক্তব্য বুঝা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তিনিই বুঝেছিলেন যে সঙ্গীত কোন একটি রাগিনীতে যতই রমনীয় ও সম্পূর্ণরূপ গ্রহণ করুক না কেন, সাধারণ ভাষায় এবং বাহিরের দিক থেকে অসীম বলা যায় না। রূপের সীমা আছে। কিন্তু রূপ যখন সেই সীমামাত্রকে দেখায় তখন সত্যকে দেখায় না। তার সীমাই যখন প্রদীপের মতো অসীমের আলো জ্বালিয়ে ধরে তখনই সত্য প্রকাশ পায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালীন পৃথিবীর যন্ত্রসভ্যতার যন্ত্রনা দেখে গভীরভাবে আঁতকে উঠেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে এই দানবিক সভ্যতা পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে কলুষময় করে তুলেছে। কারখানা ঘরের চোঙাগুলোকে ধূমকেতুর ধ্বজ-দণ্ড বানিয়ে আলোকের আঙিনায় কালি লেপে দিচ্ছে, সে বে-আব্র“ সভ্যতা বেহায়া হয়ে, আজ দেশে-বিদেশে আপন দল জমিয়ে ঢাক বাজিয়ে বেড়াচ্ছে। নিউইয়র্ক থেকে টোকিওর ঘাটে ঘাটে। ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে তার উদ্ধত যন্ত্রগুলো উৎকট শৃঙ্গ ধ্বনি দ্বারা সৃষ্টির মঙ্গল শঙ্খধ্বনিকে ব্যঙ্গ করছে। উলঙ্গ শক্তির এই দৃপ্ত আত্মম্ভরিতা আপন কলুষ কুৎসিত মুষ্ঠিতে অমৃতলোকের সম্মান লুট করে নিচ্ছে।

মানব জগতের এই চরম বিপর্যয় দেখে রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন যে এই সভ্যতা মানবিক নয়। এই সভ্যতা মানুষকে মজুর বানাচ্ছে। মিস্ত্রি বানাচ্ছে, মহাজন বানাচ্ছে, লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করছে। মানুষ নির্মান করছে ব্যবসার প্রয়োজনে। এই নির্মাণের পশ্চাদে আত্মার প্রেরণা নেই। ব্যবসার প্রয়োজন যখন অত্যন্ত বেশি হয়ে ওঠে, তখন আত্মার বাণী নিভৃতে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সবকিছু তখন হয়ে যায় হাটের পণ্য।

সাহিত্য সৃষ্টি হয় আত্মার প্রেরণায়। এটা হলো দিব্যধামের সাধনার বস্তু। সাহিত্যের কর্ম হল এই যে, সাহিত্য দিব্যধামের পথের চিহ্ন কখনো মুছে দেয় না এবং সাহিত্যের সৃষ্টি সম্পদকে হাটের পণ্যেও রূপান্তরিত করে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ, বাইরের প্রকৃতির তথ্য রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে তাকে আত্মার চরম সম্বন্ধে নিয়ে যাওয়াই হল তার প্রধানতম কাজ।
এই সম্বন্ধ সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, মঙ্গলের সম্বন্ধ, প্রীতির সম্বন্ধ এবং মহামিলনের সম্বন্ধ।







কামরুল ইসলাম
কেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ

___________________________________________________________


রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। নোবেলপ্রাপ্তির পর এই একশ বছরে বাংলা সাহিত্য অনেক দূর এগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে পড়েছেন ইউরোপে, আমেরিকায়, জাপানে, চীনে আফ্রিকায় এবং আরো অনেক অনেক জায়গায়। রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি বাঙালির জন্য ছিল খুবই গৌরবের বিষয়। যে কবি বাঙালির জন্য এই বিরল সম্মান বয়ে এনেছিলেন তাকে যে গালমন্দ, নিন্দা এবং অপমান সইতে হয়েছিল তা কালক্রমে শুধু বাষ্পায়িত হয়ে উবেই যায় নি, তিনি যে কত বড় মাপের প্রতিভা ছিলেন সে বিষয়টিও সময়ের সাথে সাথে আরো স্পষ্ট  হয়েছে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে আমরা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে দেখি : তিনি যে একজন খুব বড়ো কবি তা আমরা আগেই জেনে গিয়েছি, কিন্তু যে কথা আজও আমরা ভালো করে জানি না- কিংবা বুঝি না- সেকথা এই যে বাংলাদেশের পক্ষে বড্ড বেশী বড়ো তিনি, আমাদের মনের মাপজোকের মধ্যে কুলোয় না তাঁকে, আমাদের সহ্যশক্তির সীমা তিনি ছাড়িয়ে যান। (বুদ্ধদেব বসু  ॥ সাহিত্যচর্চা)

রবীন্দ্রনাথকে অনাধুনিক বলে গালমন্দ পাড়ার রেওয়াজ এখনো ওপার বাংলার কিছু আধুনিকবাদীদের আলোচনায়, লেখায় দেখা যায়। পাশ্চাত্যের আধুনিকবাদী চেতনা দিয়ে রবীন্দনাথকে মাপতে গেলে ভুল করা হবে। রবীন্দ্রনাথ দেশ ও শেকড়ের দিকে তাকিয়ে যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন তা নিশ্চিত করে পশ্চিমী আধুনিকবাদী আন্দোলনের সাথে মেলে না। আর এই না মেলার মধ্যেই রবীন্দ্র্র-আধুনিকতার স্বকীয়তা, আর যে কারণে অনেক তথাকথিত আধুনিকবাদী কবিকে আমরা আর তেমনভাবে পাঠ না করলেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ৩০-এর দশকে বাংলা কবিতার আধুনিকায়নে যে পঞ্চপাণ্ডবীয় আধুনিকবাদী আন্দোলন এবং রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে নতুন কবিতা লেখার প্রয়াস, সে বিষয়ে এখানে আমরা বিশদ আলোচনা করতে চাই না। কারণ, এটি ভিন্ন বিষয়।  সেইসব তরুণ বিদ্রোহীরা রবীন্দ্রনাথকে শেষমেশ গুরুর স্থানেই রেখেছিলেন অবনত মস্তকে। বুদ্ধদেব বসু তাকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ এবং বই লিখে তার তরুণ বয়সের পাপকে অনেকখানি মোচন করেছিলেন। অন্যেরাও সে বিষয়ে পিছিয়ে ছিলেন না।

রবীন্দ্রনাথ দেশীয় ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে যে ক্লাসিক আধুনিকতার কথা ভেবেছেন সেটিকে যারা পাত্তা না দিয়ে দেশ-ঐতিহ্য-শেকড়হীন পশ্চিমী সাহিত্যতত্ত্ব ও মাল-মসলায় মননকে শাণিত করে শিল্প-সাহিত্য করতে উদ্যমী হলেন তাদের শিল্পচর্চা বিষয়ে আজকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের উপলব্ধির জগতে প্রকৃত সত্যের বিষয়টি উন্মোচিত হচ্ছে ক্রমশ। সুতরাং, এই নিঃসঙ্গ বাউল  ব্যাপক বিস্তৃতি নিয়ে যেভাবে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছেন আমাদের মন ও মননের জগতে, সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত সত্তার দিক-দিগন্তের ব্যাপ্তিকে বোঝা যাবে সহজে। রবীন্দ্রনাথ আজ আমাদের কাছে এক আলোময় উঠোন। নোবেলপ্রাপ্তির একশ বছরে তিনি আস্তে আস্তে যেভাবে তার বহুমাত্রিক সৃজনপ্রতিভার আলো চারদিক ছড়িয়ে একটি বিশাল অবয়ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা শুধু বিস্ময়করই নয়,  একটি আলোময় চিরায়ত পথের বৈভবও, বাঙালির দূর বাতিঘরের দিকে।

নোবেলপ্রাপ্তির একশ বছরে (১৯১৩-২০১৩) আমরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে গ্রহণ করেছি কিংবা রবীন্দ্রনাথ আমাদের কতটা কাছাকাছি এসেছেন সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে এজন্যই যে তিনি আমাদের ‘সিদ্ধিদাতা গনেশ’ এবং তার অফুরন্ত ভাণ্ডারে এতসব মাল-মসলা রয়েছে যে তা নিয়ে নতুন নতুন ভাবে তাকে গ্রহণ করবার প্রস্তুতি নিতে হলে এই একশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথকে আজকের কালচেতনায় ভাবতে হবে।

ইউরোপে বলতে গেলে তখনো কেউ তার নামই শোনে নি, আর সেই নাম না-শোনা কবিই পেলেন নোবেল পুরস্কার। তখন পশ্চিমের আটাশজন নামজাদা লেখক নোবেল কমিটির লিস্টে ছিলেন এবং এদের মধ্যেই যে-কেউ পুরস্কার পেয়ে যাবেন, সে রকমই ভাবা হচ্ছিল। এবং মজার ব্যাপার হলো ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার-এর ৯৭ জন সদস্যই টমাস হার্ডির নাম প্রস্তাব করেছিলেন এবং মাত্র একজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব। তখনও ঐ একটি মাত্র বই গীতাঞ্জলিই সম্বল। যদিও পুরস্কার ঘোষণার সময় আরো তিনটি কবিতার বই বেশ তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করা হয়েছিল, সেগুলোর মান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেও বিব্রত ছিলেন এবং  এইসব প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথের কবিকৃতিকে অনেকখানিই ম্লান করে দিয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘ লন্ডনের যে সাহিত্যিক গোষ্ঠীকে বলা হয ‘গীতাঞ্জলি’র আবিষ্কারক ও প্রবর্তক,তাঁরা যে অনতিপরেই আমাদের কবির বিষয়ে উৎসাহ হারিয়েছিলেন, অনুবাদের বিবর্ধমান ম্লানিমা তার একটি প্রধান কারণ,সন্দেহ নেই।’(কবি রবীন্দ্রনাথ)

বলতে গেলে  অনেক মানুষের অনেক খাটাখাটুনির ফসলই ছিল এই দুর্লভ সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। নোবেল কমিটির অন্যতম সদস্য হ্যালস্ট্রম রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে যে পরিশ্রম করেছিলেন তা কখনো স্মরণের আড়ালে চলে যাবে না। তিনি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে কয়েকটি পর্বে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন তার কিছু অংশ থেকে জানা যাবে তার রবীন্দ্রপ্রীতির নিদর্শন।

রবীন্দ্রনাথ খুব ভয়ে ভয়েই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেছিলেন। ইন্দিরা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি তা ব্যক্তও করেছেন :

গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জ্জমার কথা লিখেছিস। ওটা যে কেমন করে লিখলুম এবং কেমন করে লোকের এত ভালো লেগে গেল,সে কথা আমি আজ পর্যন্ত ভেবেই পেলুম না।আমি যে ইংরেজি লিখতে পারিনে এ কথাটা এমনি সাদা যে এ সম্বন্ধে লজ্জা করবার মত অভিমানটুকুও আমার কোনোদিন ছিল না। যদি আমাকে কেউ চা খাবার নিমন্ত্রণ করে ইংরেজিতে চিঠি লিখত তাহলে তার জবাব দিতে আমার ভরসা হত না...-গেল বারে যখন জাহাজে চড়বার দিন মাথা ঘুরে পড়লুম,বিদায় নেবার বিষম তাড়ায় যাত্রা বন্ধ হয়ে গেল,তখন শিলাইদহে বিশ্রাম নিতে গেলুম।... তখন চৈত্রমাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলাকার সকল ক’টা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল...এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না- হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে চায়,ওটা আমার চিরকালের অভ্যাস,জানিসত। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখার মত বল আমার ছিল না। সেইজন্যই ঐ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরেজিতে তরজমা করতে বসে গেলুম...। (চিঠিপত্র : ৫)

গীতাঞ্জলির অনুবাদ নিয়ে রবীন্দ্র-নিন্দুকেরা তাঁকে সুস্থির থাকতে দেননি। তারা প্রচার চালিয়েছে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এই অনুবাদ সম্ভব নয়, এটি ইয়েটস অথবা এন্ড্রুজ  করেছেন। ইয়েটসও এ সব প্রচার-প্রচারণাকে উস্কে দেবার মতো কথা বলেছেন কখনো কখনো। কারণ, ইয়েটস যে উচ্ছ্বাসে সে সময় গীতাঞ্জালির ভূমিকা লিখেছিলেন, পরবর্তীতে যে কারণেই হোক সে উচ্ছ্বাস আর তার ছিল না। তবে একথা ঠিক যে, ইয়েটস অল্প সামান্য হলেও সংশোধন-পরিমার্জন করেছিলেন যা রবীন্দ্রনাথের করা ইংরেজি অনুবাদকে তেমনভাবে নাড়া দেইনি। রোটেনস্টাইনও তাঁর স্মৃতিকথায় জোর দিয়েই বলেছেন ইংরেজি গীতাঞ্জলি যেটা প্রথম ছাপা হয়েছিল তা রবীন্দ্রনাথেরই অনুবাদ, যদিও ইয়েটস অনেক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন।

গীতাঞ্জলির অনুবাদের পাণ্ডুলিপি টিউব রেলে ব্লুমসবেরি যাবার সময় রথীন্দ্রনাথ অ্যাটাচিসহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরে অবশ্য রেলওয়ের লস্ট প্রপার্টি অপিসে তা পাওয়া গিয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে বলছেন :

পরের দিন বাবা যখন রোটেনস্টাইনের বাড়ি যাবেন,অ্যাটাচির খোঁজ পড়ল, আর তখনই বোঝা গেল সেটি টিউবে ফেলে আসা হয়েছে। আমার অবস্থা অনুমেয়; শুকনো মুখে আমি চলে গেলাম টিউব রেলের লস্ট প্রপার্টি অফিসে। সেখানে যেতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হারানো ধন ফেরত পাওয়ার পর আমার প্রাণে যে গভীর স্বস্তি হয়েছিল- সে আমি কখনো ভুলব না।’ ( প্রশান্ত কুমার পাল)

সেসময় ইংল্যান্ডে পৌঁছে (১৬ জুন) রবীন্দ্রনাথ পুত্রসহ হোটেলে ওঠেন এবং পরে চিত্রকর রোটেনস্টাইনের বাড়িতে যান। রোটেনস্টইনের বাড়িতে যাবার  পর তিনি অনুবাদের পাণ্ডুলিপিটি তার হাতে দিয়ে দেন এবং আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে থাকেন রোটেনস্টাইনের মন্তব্যের জন্যে।

গীতাঞ্জলির তিনটি কবিতা ও তার ইংরেজি অনুবাদ আমরা এখানে একটু দেখে নিতে চাই :

১.
মেঘের পরে মেঘ জমেছে , আঁধার করে আসে
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
     কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,
     আজ আমি যে বসে আছি তোমারই আশ্বাসে।
তুমি যদি না দেখা দাও,কর আমায় হেলা,
কেমন  করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
       দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি,
       পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে। [গীতাঞ্জলি ১৬]


আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।

কত যে গিরি কত যে নদীতীরে
বেড়ালে বহি ছোট এ বাঁশিটিরে,
কত যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব।

তোমারি ঐ অমৃত পরশে
আমার হিয়াখানি
হারাল সীমা বিপুল হরষে
উথলে উঠে বাণী।

আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবসবিভাবরী,
হল না সারা কত না যুগ  ধরি,
কেবলি আমি লব। [গীতিমাল্যর ২৩ নম্বর কবিতা পরে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে অন্তভুক্ত]


৩.
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার।

আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম-
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,চাই যে বারে বার।

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন নদীর পারে গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার। [গীতাঞ্জলি ১০৩]



এই তিনটি কবিতা বা গানের  রবীন্দ্রনাথকৃত ইংরেজি অনুবাদ দেখে সঙ্গকারণেই আমার মনে হয়েছে এই অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের নিজের, যা তার মূল বাংলা কবিতার মৌল অভিগমনকে কোথাও কোথাও ক্ষুণœ করেছে। ইয়েটস-এর কবিতার সাথে  এবং তার ইরেজি ভাষার সাথে যারা পরিচিত তারা জানবেন যে এই অনুবাদ তার নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের সম্মতি নিয়েই দু-একটি শব্দ পরিবর্তন করেছিলেন, তবে একথাও ঠিক যে কখনো কখনো তিনি রবীন্দ্রনাথের মতামতেরও ধার ধারেননি, যদিও সেইসব সামান্য পরিবর্তন কেবল উপেক্ষাই করা যায়। যারা সে সময় বলেছিলেন

: ঃযব ঊহমষরংয এরঃধহলধষর ধিং ঢ়ৎধপঃরপধষষু ধ ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ ণবধঃং

তারা হয়ত আজ নেই, কিন্তু তাদের কিছু কিছু ভূতের যে কালেভদ্রে দেখা পাওয়া যায় না, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা এক পত্রে ইয়েটস-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় ইয়েটস তার  ইংরেজি অনুবাদের দিকে প্রশংসাসূচক দৃষ্টিই নিবদ্ধ করেছেন। সেটি নিছক সৌজন্যমূলক ছিল কিনা, সেবিষয়ে যুক্তি-তর্কে যাবার কোনো প্রয়োজন দেখি না।
কাল রাত্রে এখানকার কবি ণবধঃং-এর সঙ্গে একত্রে আহার করেছি। তিনি আমার কবিতার কতকগুলি তর্জ্জমা কাল পড়লেন। খুব সুন্দর করে সুর করে তিনি পড়লেন। আমার নিজের ইংরেজির উপর কিছুমাত্র ভরসা ছিল না- তিনি বল্লেন, যদি কেউ বলে এ লেখাকে কেউ আরো রসঢ়ৎড়াব করতে পারে সে সাহিত্যের কিছু জানে না।... আমার এই পদ্য তর্জ্জমাগুলো ণবধঃং নিজে ঊফরঃ করে একটি রহঃৎড়ফঁপঃরড়হ লিখে ছাপাবার ব্যবস্থা করবেন। [পাল]

রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়ে নানারকম মন্তব্য আমরা শুনেছি। টমসন লিখেছেন :

ওঃ রং ড়হব ড়ভ ঃযব সড়ংঃ ংঁৎঢ়ৎরংরহম ঃযরহমং রহ ঃযব ড়িৎষফ’ং ষরঃবৎধঃঁৎব ঃযধঃ ংঁপয ধ সধংঃবৎু ড়াবৎ ধহ ধষরবহ ঃড়হমঁব বাবৎ পধসব ঃড় ধহু সধহ. নিরোদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন : রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরপ্রেম যে আসলে খ্রষ্টধর্ম-সম্ভূত ও পাশ্চাত্য তাহা আমি দেখিয়াছি।সুতরাং এ বিষযে আর কিছু বলিব না। তবে ইয়েটসও গীতাঞ্জলি সম্বন্ধে বলিলেন : ণবঃ বি ধৎব হড়ঃ সড়াবফ নবপধঁংব ড়ভ রঃং ংঃৎধহমবহবংং ,নঁঃ নবপধঁংব বি যধাব সবঃ ড়ঁৎ ড়হি রসধমব.

এই প্রসংগে তিনি খ্রীষ্টীয় সাধক সেন্ট বার্নাড, টমাস-এ-কেম্পিস ও সেন্ট জন অফ দি ক্রসেরও উল্লেখ করিলেন। ইহাই সত্য অনুভূতি। [আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ]

ইয়েটস, পাউন্ডসহ অনেকেই সে সময় ইংরেজি গীতাঞ্জলির যে প্রশংসা করেছিলেন তা কেবল ঐ গানগুলোর খৃষ্টীয় ভাবরসের গন্ধ পেয়ে কিনা- তাদের পরবর্তী আচরণ দেখে সেরকমই অনুমিত হয় অনেকটা। কারণ, পরবর্তীকালের পশ্চিমী জীবনধারনে বেশির ভাগ মানুষের কাছেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। অবশ্য এও সত্য যে, গীতাঞ্জলির পরে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ বই আকারে বের হলে সে গুলোকে ইয়েটস ‘সেন্টিমেন্টাল রাবিশ’ বলে অভিহিত করেছিলেন যেমন, তেমনি রবীন্দ্রসাহিত্যের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সমালোচক ই জে টমসনও (জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব : ঐরং ষরভব ধহফ ড়িৎশ) রবীন্দ্রনাথের তড়িঘড়ি করে করা তাঁর অনেক উঁচু মানের কবিতার দুর্বল অনুবাদকে তার খ্যাতির ধসের অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, ইংরেজিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে কবি এমন সব জিনিস তৈরি করলেন যা তার মূল রচনার সাথে মেলে না।

রবীন্দ্রনাথের ঐ তিনটি বাংলা কবিতা বা গানের  যে আবেদন, যে পরিব্যাপ্তি তা ইংরেজিতে যে সেভাবে আসে নি, সে কথা বলা কোনোক্রমেই অসঙ্গত হবে না। বাংলা গানের যে ভাবের সাথে আমাদের সখ্য গড়ে ওঠে অনিরুদ্ধভাবে, ইংরেজি পড়ে ততখানি হয় না এবং না হওয়াই স্বাভাবিক। কোনো অনুবাদকর্ম সম্পাদনের জন্য যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয় গীতাঞ্জলি অনুবাদের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তারপরও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে ভীতি কাজ করেছে অনুবাদের সময় সে বিষয়টিও মনে রাখা দরকার। আর ইয়েটস-পাউন্ড অথবা ইংরেজিভাষী অন্য কোনো কবি বা সমালোচকের বিষয়টি আমাদের একটু অন্যভাবেই ভাবতে হবে এই জন্য যে, তারা তো মূলত বাংলা গীতাঞ্জলির ভাবের সাথে পরিচিত ছিলেন না, যেটুকু তারা ইংরেজি অনুবাদে বুঝেছিলেন, তাতেই তারা মুগ্ধ হয়েছিলেন।
নিরোদ সি চৌধুরীসহ যারা গীতাঞ্জলিতে খৃষ্টধর্মের বিষয়টি লক্ষ করেছেন কিংবা ইয়েটস যে ভূমিকা লিখেছিলেন সেখানেও সেই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়Ñএই খৃষ্টধর্মের প্রভাবকে রবীন্দ্রনাথ নাকচ করে দিয়ে লিখেছিলেন : ‘এই জাতীয় ভাব ইংরেজ আমলের পূর্বে এই দেশে ছিল, কবীরের মধ্যে ছিল।’ এন্ড্রুজ কিংবা টমসন অনেকেই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নিউ টেস্টামেন্ট কিংবা খৃষ্টীয় ভাবের কথা জোরেসোরেই বলেছেন। রবীন্দ্র নিন্দুকেরা সেইসব সূত্র ধরে এ বিষয়ে আরো ব্যাপক প্রচার চালাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন একসময়।

রোটেনস্টাইনের বাড়িতে এজরা পাউন্ডের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের পর  এজরা পাউন্ড এই বাঙালি কবির গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে হ্যারিয়েট মনরোর ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে ‘পোয়েট্রি’র তৃতীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ছয়টি কবিতা প্রকাশিত হয় এবং মার্কিন মুলুকেও তার কবিতার দিকে মানুষের নজর পড়ে। রবীন্দ্রনাথেরও ভাবনা  ছিল যে, মার্কিন দেশের মানুষেরা তার কবিতা বিষয়ে আগ্রহ দেখাক। এজরা পাউন্ড মনরোকে সে সময় যে উচ্ছ্বাসভরা চিঠি লিখেছিলেন তা থেকে বোঝা যায় সে সময় কীভাবে রবীন্দ্রনাথ  পশ্চিমী কবিদের কাছে এক অনন্য কবি হিসেবে আদৃত ছিলেন। আমরা এখানে এজরা পাউন্ডের মুখেই সেকথা শুনতে চাই। তিনি সেই সংখ্যার উপসম্পাদকীয়তে লিখলেন :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা কবিতার স্বকৃত অনুবাদের প্রকাশ ইংরেজি কবিতার ও বিশ্বকবিতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমার একথা মোটেই সাংবাদিকসুলভ চটুলতা নয়।কাব্য শিল্প একটি গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাকে হালকাভাবে বা সস্তা বাহবা পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা ঠিক নয়।...

রবীন্দ্রনাথের যে ছযটি কবিতা (এই পত্রিকায় ) মুদ্রিত হলো, তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিতব্য তাঁর লিরিক কবিতার একটি সংকলন থেকে নেওয়া। এই ছয়টি না হয়ে আর যে কোনো কবিতাই আমরা নির্বাচন করতে পারতাম । এমন নয় যে এই কবিতাগুলো সবচেয়ে সেরা, বড়জোর তাদের বলা যায় প্রতিনিধিত্বমূলক। এই কবিতাগুলো তাদের মূলভাষায় সম্ভবত সবচেয়ে সম্পূর্ণ ও সবচেয়ে সূক্ষ্ম ছন্দে নির্মিত।...

রবীন্দ্রনাথের এই এক শ কবিতা যা নয়া গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, তা গান হিসেবে রচিত। রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলার মহান কবিই নন, তিনি তাদের একজন প্রধান সংগীতকারও বটে।...
বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগ শুরু হলো, আমার বিবেচনায় তা এক নতুন যুগের সূচনা। এ কথা একদম স্পষ্ট যে এই ক্ষুদ্র কবিতাসমূহ বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে আমাদের এযাবৎকালের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভেঙে গুঁড়িযে দেবে। এতদিন প্রাচ্যের মানুষের এই ধর্মকে আমরা নেতিবাচক ও খৃষ্টবিরোধী বলে বিবেচনা করে এসেছি।... এই বাঙালি কবি আমাদের শেখালেন স্থৈর্য, লোহা যন্ত্রদানবের এই যুগে যা খুবই জরুরি। তার কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে মানুষ ও দেবতার এবং মানুষ ও প্রকৃতির ভেতর এক নম্র সৌহার্দ্য বার্তা।... প্রাচ্যের এই মনোভাবে এক গভীরতর স্থৈর্য ও প্রবলতর বিশ্বাস রয়েছে, যা আমরা প্রতীচ্যের মানুষেরা এখনো অর্জনে সক্ষম হইনি। একমাত্র শিল্পই সেই মাধ্যম, যার ভেতর দিয়ে এক দেশের মানুষ বহু দূর কোনো মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের লন্ডন সফরের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সেই সৌভ্রাতৃত্ব এখন অনেক নিকটতর, একথা আমি নিদ্বিধায় উচ্চারণ করছি। [পোয়েট্রি ॥ ডিসেম্বর ১৯১২; বাংলা তরজমা : হাসান ফেরদৌস]

রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের পর থেকে পাউন্ড তার প্রতি অতিশয় ভক্তির উচ্ছ্বাস দেখাতে থাকেন। সে সময়ে তিনি তার ইমেজিস্ট ধ্যান-ধারণা নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলেন এবং তখনকার ইউরোপীয় কবিতার একঘেয়েমিতেও কিছুটা ক্লান্ত। ঠিক এ সময়ে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির গানগুলোর মধ্যে যে সাবলাইম অনুভূতির প্রকাশ দেখেছিলেন যা প্রেম ও ভক্তির যুগলস্রোতে আচ্ছন্ন, যা তখন ইউরোপীয় কবিতায় অভাবনীয় ছিলÑ এই বাণীর অমেয়ধারায় আত্মার শুকনো জমিনে বৃষ্টিপাতের প্রশান্তি লাভ করেছিলেন। তা ছাড়া প্রাচ্যবাদী ধ্যান-ধারণার মৌলিক উৎকর্ষের মধ্যে তারা যে নতুনত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং তাকে অবলীলাচিত্তে গ্রহণ করতে প্রাথমিকভাবে গভীর মনোযোগী ছিলেন। সে সময়ে ইয়েটস প্রাচ্য-দর্শন বিষয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। পাউন্ড তখন ইয়েটস-এর সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ করলেও তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী কবি ও কবিতার নতুনত্বের অনুসন্ধানী ডুবুরী। পশ্চিমী আধুনিকবাদী কবিতা আন্দোলনে তার ভূমিকা ও শ্রমকে আলাদাভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। যাকে ইয়েটস মনে মনে হিংসাও করতেন। ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে পাউন্ড হ্যারিয়েট মনরোকে যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠালেন তখন তার সাথে যে উচ্ছ্বাস ভরা চিঠি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা-মূল্যায়নে তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তিনি লিখলেন :
পত্রিকার আগামী সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের জন্য জায়গা খালি রাখুন।এই কবি পুরো বাঙালি জাতিকে পরিচিত করিয়েছেন,তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ খুবই চমৎকার। ইয়েটস তাঁর কবিতাগ্রন্থের ভূমিকা লিখছেন।আর আমরা হবো তার কবিতার স্বত্বাধিকারী । আমি গেল কয়েক সপ্তাহ ধরেই জানি,এই কবি হবেন এবারের শীতে সবচেযে বড় ঘটনা।ইয়েটস আমাকে বলেছেন, তিনি আমাদের যে কারও চেয়ে ভালো কবি।তাঁর কবিতা পড়ে আমি চমকে গেছি, মনে হযেছে(এরপর)আমাদের কারোর আর লেখালেখির প্রয়োজন কী! লন্ডনে সাহিত্যিক মহলে তাঁকে নিয়ে একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড চলছে,আলাপ-আলোচনার তিনিই একমাত্র বিষয়।আমরা মানে ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকা-কমপক্ষে তার ছয-ছয়টা কবিতা প্রকাশের জন্য পেয়েছি।আর কেউ পায়নি,পাবেও না কোনো কিছু।আর একথার মানে হলো আমাদের (অর্থাৎ পোয়েট্রি পত্রিকাকে)এখনই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করে উপায় নেই। [হ্যারিয়েট মনরো, এ পোয়েটস লাইফ, বাংলা তরজমা ॥ হা. ফে.]

এসব থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইউরোপ-আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের কবি-পরিচিতি এবং একজন উৎকৃষ্ট কবি হিসেবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এজরা পাউন্ড যে আলোচনা-সমালোচনা লিখেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল এবং এজরা পাউন্ড বাঙালি, বাঙালির ভাষাা সংস্কৃতি এবং শিল্প-সাহিত্য বিষয়েও উচ্চ ধারণা পোষণ করেছেন সে সময়। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডনে ইয়েটস এবং এজরা পাউন্ডের সঙ্গে নানা সময়ে আড্ডা দেবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং এই দুই কবি রথীন্দ্রনাথের সাথে আলাচারিতায় আগ্রহী ছিলেন কেবল প্রাচ্য  রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে জানার কৌতুহলেই।
রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিকথায় লিখেছেন : ‘এজরা পাউন্ড অনন্যসাধারণ একটা মানুষ, এমন মানুষ আর নেই। কবিতা ব্যাপারটিকে তিনি খুবই সিরিয়াসলি গ্রহণ করতেন নিজের কাব্য সম্বন্ধে, বিশেষত কাব্যরচনার প্রচলিত নিয়মকানুন ভেঙে ফেলায় নিজের কৃতিত্ব বিষয়ে, তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। একধরনের অহমিকা তাঁর ছিল, তা সত্ত্বেও লোকটাকে পছন্দ না করে উপায় ছিল না।... তিনি পিতার প্রতি অনুরক্ত ছিলেনএবং তাঁকে গুরুর মতো ভক্তি করতেন।

২.
রবীন্দ্রনাথর বন্ধুভাগ্য ভালো ছিল। শিল্পী রোটেনস্টাইনের সাথে তার পরিচয় না হলে ইউরোপে রবীন্দ্র-পরিচিতির ক্ষেত্রটি কেমন হতো, এমনকি নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টিও কতদিনে কীভাবে হতো, এই নিয়ে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। রোটেনস্টাইন সম্পর্কে নিরোদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন :
এই বন্ধু তখনকার দিনের বিখ্যাত চিত্রকর রোটেনস্টাইন। ইনি যে কেবল চিত্রকর ছিলেন তাহাই নয়, আর্টিস্ট ও সাহিত্যিক সমাজের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল-যেমন, ফ্রান্সে দোপাজ, পিসারো, তুলুজলোত্রেক, ব্রিটেনে অস্কার ওয়াইল্ড, অব্রে বিয়ার্ডসলী, ম্যাক্স বীরবম, হুইসলার, সার্জেন্ট, ইয়েটস প্রভৃতি। [আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ]

রোটেনস্টাইন গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপির তিনটি টাইপ-কপি ইয়েটস, ব্রাডলি এবং স্টপফোর্ড ব্র“ককে দিয়েছিলেন। সে ১৯১২ সালের জুন মাসের কথা। রোটেনস্টাইন নিজ বাড়িতে গীতাঞ্জলি ( এরঃধহলধষর: ঝড়হম ঙভভবৎরহমং) পাঠের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই আসরে কবি এজরা পাউন্ডসহ পশ্চিমের অনেক রথি-মহারথি উপস্থিত ছিলেন।  রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালের খুব কাছের বন্ধু এন্ড্রুজও উপস্থিত ছিলেন।। ইয়েটস গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শুনিয়েছিলেন সেদিন। কবিতাগুলা শোনার পর ব্রাডলি লিখেছিলেন : 

ওঃ রং ষরশব ষরংঃবহরহম ঃড় সঁংরপ যিরপয ংঢ়বধশং ভড়ৎ ড়হব যিরপয ড়হব ভববষং যরং ফববঢ়বংঃ রহ ড়হবংবষভ ধহফ রহ বাবৎুঃযরহম বষংব ধহফ পধহ ংড় ংবষফড়স ভরহফ ধহু ড়ঁঃষবঃ, ঃযড়ঁময রঃ ধষড়হব ঃযধঃ পড়ঁহঃং রহ ঃযব বহফ, মরাবং ধ সবধহরহম ঃড় ধহু ড়ঃযবৎ বীঢ়ৎবংংরড়হ. [পাল]

সেই কবিতা পাঠের আসরে সেদিন ইউরোপীয় সাহিত্যের দিকপালরা একধরনের ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো শোনার পর সবাই একটা অন্যরকম ভাবনার জগতে  চলে যান। পরে রবীন্দ্রনাথকৃত ইংরেজি অনুবাদ ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং ১৯১৩ সালের মার্চে ‘ফোর্টনাইটলি’ পত্রিকায় এজরা পাউণ্ড গীতাঞ্জলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন এবং বলতে গেলে তার এই সপ্রশংস আলোচনা নোবেল কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এজরা পাউন্ড লিখেছিলেন :

ঞযবৎব রং রহ যরস ঃযব ংঃরষষহবংং ড়ভ হধঃঁৎব. ঞযব ঢ়ড়বসং ফড় হড়ঃ ংববস ঃড় যধাব নববহ ঢ়ৎড়ফঁপবফ নু ংঃড়ৎস ড়ৎ নু রমহরঃরড়হ, নঁঃ ংববস ঃড় ংযড়ি ঃযব হড়ৎসধষ যধনরঃ ড়ভ যরং সরহফ. ঐব রং ধঃ ড়হব রিঃয হধঃঁৎব, ধহফ ভরহফং হড় পড়হঃৎধফরপঃরড়হং. অহফ ঃযরং রং রহ ংযধৎঢ় পড়হঃৎধংঃ রিঃয ঃযব ডবংঃবৎহ সড়ফব, যিবৎব সধহ সঁংঃ নব ংযড়হি ধঃঃবসঢ়ঃরহম ঃড় সধংঃবৎ হধঃঁৎব রভ বি ধৎব ঃড় যধাব "মৎবধঃ ফৎধসধ." (ঊুৎধ চড়ঁহফ রহ ঋড়ৎঃহরমযঃষু জবারব,ি ১ গধৎপয ১৯১৩)

গীতাঞ্জলির ভূমিকায় ইয়েটস লিখেছিলেন :
ঞযবংব ষুৎরপং - যিরপয ধৎব রহ ঃযব ড়ৎরমরহধষ, সু ওহফরধহং ঃবষষ সব, ভঁষষ ড়ভ ংঁনঃষবঃু ড়ভ ৎযুঃযস, ড়ভ ঁহঃৎধহংষধঃধনষব ফবষরপধপরবং ড়ভ পড়ষড়ঁৎ, ড়ভ সবঃৎরপধষ রহাবহঃরড়হ - ফরংঢ়ষধু রহ ঃযবরৎ ঃযড়ঁমযঃ ধ ড়িৎষফ ও যধাব ফৎবধসবফ ড়ভ ধষষ সু ষরভব ষড়হম. (পাল)

কবি স্টার্জ মুর ইয়েটস-এর কাছে গীতাঞ্জলির কবিতা শুনে এক বন্ধুকে লিখলেন :
ণবধঃং ধহফ জড়ঃযবহংঃবরহ যধফ ধ ইবহমধষর ঢ়ড়বঃ ড়হ ারবি ঃযব ষধংঃ ফধু.ও ধিং রহ খড়হফড়হ. ও ধিং ঢ়ৎরারষবমবফ ঃড় সববঃ যরস রহ ণবধঃং’ং ৎড়ড়সং ধহফ ঃযবহ ঃড় যবধৎ ঃযব ঃৎধহংষধঃরড়হং ড়ভ যরং ঢ়ড়বসং সধফব নু যরসংবষভ ধহফ ৎবধফ নু ণবধঃং রহ জড়ঃযবহংঃবরহ’ং ফৎধরিহম ৎড়ড়স.ওঃ’ং ঁহরয়ঁব ংঁনলবপঃ রং  ঞযব ষড়াব ড়ভ এড়ফ. (পাল)

১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর রয়টার সুইডিশ একাডেমি খবরটি প্রচার করে। যে স্টার্জ মুর পরবর্তীতে রবীন্দ্রবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেনতিনি সুইডিশ একাডেমিতে লিখিছিলেন :

ঝরৎ,থঅং ধ ভবষষড়ি ড়ভ ঃযব ৎড়ুধষ ঝড়পরবঃু ড়ভ ষরঃবঃঁৎব ড়ভ ঃযব টহরঃবফ করহমফড়স ও যধাব ঃযব যড়হড়ৎ ঃড় ঢ়ৎড়ঢ়ড়ংব ঃযব হধসব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব ধং ধ ঢ়বৎংড়হ বিষষ য়ঁধষরভরবফ রহ সু ড়ঢ়রহরড়হ ঃড় নব ধধিৎফবফ ঃযব ঘড়নবষ চৎরুব রহ খরঃবৎধঃঁৎব. (পাল)

সুইডিস একাডেমির নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান হ্যারাল্ড হারানে যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তাতে রবীন্দ্রনাথ এবং তার কবিতার প্রতি শুভ দৃষ্টির পরিচয় মেলে। মূলত গীতাঞ্জলি এবং ইংরেজিতে অনূদিত অল্প কিছু লেখার সাথে ইউরোপের রথি-মহারথিরা পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার যে মাপের কবি ছিলেন, তার ইংরেজি অনুবাদে কবিতার সেই  রূপ-লাবণ্য ফুটে না-ওঠা অস্বাভাবিক ছিল না। ফলে সেসময়ের আধুনিকবাদী কবিতা আন্দোলনের কর্ণধাররা রবীন্দ্রনাথের প্রতি শেষমেশ যে অনীহা দেখিযেছিলেন তা নিয়ে অনেক দূর ব্যাখ্যায় যাওয়ার তেমন কোনো দরকার নেই বলেই আমার মনে হয়। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অনেক উল্লেখযোগ্য রচনা ছিল তাদের জানা-শোনার বাইরে। ফলে, রবীন্দ্রনাথকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা তাদের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। তাদের মুখ ফেরানোয় রবীন্দ্রনাথ ছোট হয়ে যাননি। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এরা কেউই ছিলেন না, আর বলতে দ্বিধা নেই যে, তথাকথিত ইউরোপীয় আধুনিকতার দিকে পা না বাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ঠিক কাজটিই করেছিলেন, সেটি ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ এমন এক প্রতিভা যিনি নিয়ত নিজেকে অতিক্রম করেছেন। তার কবিতা ও গানের নানা পর্বে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বলাকা কাব্যে এসে কবি জীবনের কবি হয়ে উঠেছেন। এরপর ক্ষণিকায় এসে দেখা গেল জীবনের আরো বাস্তব রূপ,পরবর্তী কাব্যগুলোতে ক্রমশ সেই বাস্তবতা আরো বিস্তৃত হয়েছে। ১৮৯০ সালে শিলাইদহে আসার পর রবীন্দ্রনাথ গণমানুষের সাথে সপৃক্ত হন এবং এই স¤পৃক্ততার প্রভাব সর্বাধিক ছোটগল্পে এবং তার গানে ও কবিতায়ও পড়েছে। গীতাঞ্জলি পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ এক আলোময় ভুবনে প্রবেশ করেন। গীতাঞ্জলিতে তিনি ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্কের একটি সাঁকো তৈরি করেছেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব বলছেন:

গীতাঞ্জলিতে দেখি রবীন্দ্রনাথ সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে খেয়া পার হয়ে পৌঁছেছেন সেই ঘোমটা পরা ছায়ায় ঢাকা তীরে যার সোনালি তটরেখার দিকে তিনি বেশ-কিছুকাল ধরে তাকিয়ে ছিলেন দোদুল্যমান চিত্তে। তার নিজেরই মনের কুয়াশায ঢাকা ছিল এ-দেশ। খেয়া নৌকা থেকে নেমে দেখেন ছায়ার ঘোমটা সরে গেছে, চারিদিক আলোয় আলোকময়,সবই সুন্দর সবই মধুর,সবই আনন্দে ভরপুর। [পান্থজনের সখা]

গীতাঞ্জলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো যেখানে ঈশ্বর নেই সেখানেও রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তির সঞ্চার করেছেন এবং নাস্তিকের অন্তরেও জাগাতে পেরেছেন ঈশ্বরের প্রেমময় ছায়া। ঈশ্বরও রক্ত-মাংসের মানবী হয়ে ওঠেন তার গানে। যে কারণে নীরদচন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে হিন্দুর সনাতন  অর্ধনারীশ্বর বলে অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথর দুঃখের গান নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব যেভাবে তার গানের সর্বপ্লাবী অভিঘাতের বিশ্লষণধর্মী আলোচনা করেছেন, সেরকম আলোচনা আর কারো লেখায় আমরা পাইনি। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী কিংবা কবিতার অন্তর্গত ভাবের সাজুয্য এবং অন্যকে সঞ্চালিত করার ক্ষমতা এবং গানের অদৃশ্য মর্মবাণীর গৌরবকে এত সাবলিলভাবে দেখানোর ক্ষমতা তিনিই কেবল দেখাতে পারেন বলে আমার মনে হয়েছে।

৩.
আর্জেনটাইন সুন্দরী তরুণী ভিক্টোরিয়া ওকা¤েপা তার মানসিক সংকটের দিনে গীতাঞ্জলি পড়ে  প্রশান্ত আকাশের সন্ধান পেয়েছিলেন, সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ একবার নিরূপায় হয়েই অনেকটা ওকাম্পোর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তখন ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের  সাহিত্য পড়ে অনেকটা রবীন্দ্র-ভাবনায আচ্চন্ন এবং ঠিক সেসময়েই রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি তাকে  যারপরনাই আনন্দিত করেছিল। প্রায় দুমাস রবীন্দ্রনাথ এখানে আবস্থান করেছিলেন এবং ভিক্টোরিয়ার সেবায় অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ওকাম্পো লিখেছেন, ‘কবির রোগক্লিষ্ট পাণ্ডুর মুখের  দিকে চেয়ে আমার হৃদয়ে তখন রক্ত ঝরছিল।’ ওকাম্পো তার শেষ জীবনের স্মৃতিচারণেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার উষ্ণ সান্নিধ্যের কথা বলেছেন। গীতাঞ্জলি পড়ে ওকাম্পো কেঁদেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি হৃদয়ের উষ্ণ বাঁধন দিয়েই ভালোবেসে ফেলেছিলেন অনেকটা, কিন্তু কবির সেদিকে কোনো আবেগঘন সাড়া ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ ৩৪ বছর বয়সে লিখেছিলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’  এই গানটি। কবি জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন :

কোন রহস্যসিন্ধুর পরপারে ঘাটের উপরে তাহার বাড়ি, তাহাকেই শারতপ্রাতে মাধবীরাত্রিতে ক্ষণে ক্ষণে দেখিতে পাই, হৃদয়ের মাঝখানেও মাঝে মাঝে তাহার আভাস পাওয়া গেছে, আকাশে কান পাতিয়া তাহার কণ্ঠস্বর কখনো বা শুনিয়াছি। সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিশ্ববিমোহিনী বিদেশিনীর দ্বারে আমার গানের সুর আমাকে আনিয়া উপস্থিত করিল এবং আমি কহিলাম :

ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
এসেছি তোমারি দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে,ওগো বিদেশিনি।’
১৯২৪ সালে ৬৩ বছর বয়সে এসে তিনি সেই বিদেশিনীর দেখা পেয়েছিলেন। প্রায় ঊননব্বই বছর বয়সে ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ওকা¤েপার দেহাবসান হয়েছিল। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রবীন্দ্র-স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেঁচে ছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সময় জহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি রবীন্দ্রনাথহীন ভারতবর্ষে আসেন নি। 

আমরা আগেই বলেছি ওকাম্পো গীতাঞ্জলি পড়ে এতটাই আভিভূত হয়েছিলেন  যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ঈশ্বরকে প্রায় কাছাকাছি ভাবতে শুরু করেছিলেন। শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, সমস্ত ইউরোপের এক আত্মিক মহাসংকটের কালে গীতাঞ্জলির শান্ত-সমাহিত সংগীতের বাণী ছিল একটি অন্যরকম প্রশান্তির জায়গা। ইয়েটস আগে থেকে ভারতীয় দর্শন, মরমীবাদ ইত্যাদি বিষয়ে অবগত ছিলন; অতঃপর রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি হাতে পেয়ে ভারত সম্পর্কে তার প্রাপ্তির অনেকটাই পূর্ণ হলো বলে তিনি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে অনেকটা উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলেন।

ওকা¤েপার সেই বাগানবাড়িতে অবস্থানকালে ওকাম্পো তাকে অনেক পাশ্চাত্য সংগীত শুনিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথও তার নিজের গান তাকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মুখে গান শুনে ওকা¤েপা বাংলা গানের ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংগীত খুব একটা পছন্দ না করলেও তিনি সেইসব সংগীতের কলকব্জাগুলো বুঝতেন এবং তার নিজের গানে সেসবের প্রভাবও পড়েছে। বেঠোফেনের প্রতি তার কিছুটা দুর্বলতা ছিল, তার ক¤েপাজিশন তিনি শুনতেন। রবীন্দ্রনাথ সংগীত বিষয়ে রমাঁ রলাঁ, বেনেদিত্ত ক্রোচেসহ অনেক পাশ্চাত্য মনীষীর সাথে বহুবার আলাপ-আলোচনা করেছেন নানা সময়ে।

৪.
গীতাঞ্জলির কাছে আমাদের বারে বারে ফিরে যেতে হয়। আমাদের দুঃখ-বেদনা, হতাশায় এই সংগীতমালার প্রাণদায়ী শক্তি আমাদের ভেতরে আলোময় আকাশের ছায়া ফেলে যায়, আমাদের বাহিত করে জীবন পথের সেই নিভৃত বারান্দায়, যেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সেইসব আলোর মশাল যা মানবিক ঔদার্যে বয়ে চলেছে অনাগত কালের দিকে। রবীন্দ্রনাথের পরে গীতাঞ্জলির অনেক ইংরেজি তরজমা অনেকেই করেছেন এবং তা আরো চৌকশ আরো পরিশীলিত ভাবে হয়েছে, কিন্তু ঠাকুরকৃত অনুবাদে যে রবীন্দ্র-সুগন্ধ, যে ঐতিহ্যের টান অনুভূত হয়, অন্য কারো অনুবাদে সে রকমটি হয় না। তবে আজকে আমাদের আর ঐ ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে কোনো বিতর্ক বা ভাবনার প্রয়োজন নেই এ কারণে যে, সঙ অফারিঙস নয়, গীতাঞ্জলিই আমাদের আরাধ্য এবং বাঙালি হিসেবে তার এই অনবদ্য বাংলা কবিতা বা গানের মধ্যে আমরা জীবনকে কতভাবেই না নিয়ে যেতে পারি এবং এই পারাটার মধ্যেই রবীন্দ্র-সৃষ্টির সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথকে যারা শুধু অধ্যাত্মবাদী, ভাববিলাসী রোমান্টিক দিকবলয়ের কবি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত কিংবা সাম্প্রদায়িক জ্বরে আক্রান্ত মায়োপিক দৃষ্টির জাতক, তারা রবীন্দ্রমানস থেকে হয় অনেক দুরে বসবাস করেন, না হয় স্বার্থকেন্দ্রিক মোহগ্রস্ততায় মাটি ও মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেন। একথা আরও স্পষ্ট যে, খণ্ডিত, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে যারা রবীন্দ্রনাথকে মাপতে গিয়েছেন, তারা যুগে যুগেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

৩০-এর দশকের রবীন্দ্রবিরোধীতা অবশ্য একটু আলাদা ঢঙের। কল্লোলীয়দের নতুন কবিতা আন্দোলনের এই সময়টাতে রবীন্দ্রবিরোধীতা অনেকখানিই রবীন্দ্রনাথকে গুরু হিসেবে মেনে নিয়েই হয়েছে। এটা রবীন্দ্রনাথকে অবমূল্যায়নের উদ্দেশ্য নয়; বরং বলা যায় সময়ের ডাকে, নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ৩০-এর প্রধান পাঁচজন কবি সবারই ছিলো অপরিশীম শ্রদ্ধা ও ভক্তি। তাদের বিদ্রোহটা ছিলো মূলত নতুন কবিতা লেখার বিবেচ্য পথে, ভক্তি ও শ্রদ্ধার আড়ালে। এটি গতানুগতিক অর্থে কোন বিরোধিতা নয়।

মার্কসবাদীদের কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। বিশেষ করে ৪০-এর দশকে এই সমালোচনা আরও তুঙ্গে ওঠে এবং তারা (মার্কসবাদীরা) অনেকেই তাঁকে কবি হিসেবে মেনে নিতেও ছিলেন নারাজ। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসংগে লিখেছেন, ‘মার্কসিজম এর ছোঁয়াচ যদি কারো কবিতায় লাগে, অর্থাৎ কাব্যের জাত রেখে লাগে, তাহলে আপত্তির কথা নেই, কিন্তু যদি না-ই লাগে তাহলে কি জাত তুলে গাল দেওয়া শোভা পায়?’ [চিঠিপত্র] তিনি মার্কসিজমকে অস্বীকার করেন নি (রাশিয়ার চিঠিতে তিনি এ প্রসংগে লিখেছেন); মানুষের সর্বপ্লাবী বেদনা তাঁকেও আপ্লুত করেছে, তবে তিনি কবিতাকে শিল্প হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন, নিছক শ্লোগান হিসেবে নয়। আর একারণেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় অথবা মায়াকোভস্কিরা বড় মাপের কবি হয়েও যখন অতিশয় প্রত্যাশা ও উচ্চৈঃস্বরের আধিক্যে তাঁদের কবিতা সময়ের পরিবর্তনে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তখনো রবীন্দ্রনাথ টিকে থাকেন সাবলিল অহংকারে, কালজয়ী কবি হিসেবে।

৬০-এর দশকে রবীন্দ্রবিরোধীতা তুঙ্গে ওঠে। বিশেষ করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে এই বিরোধীতা আরো ঘনীভূত হয় (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে) এবং এই দশকের শেষের দিকে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত সরকারিভাবে নিষিদ্ধের পাঁয়তারা চলে। আমরা আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বিরুদ্ধস্রোতেই বেশি শক্তিশালী হয়েছেন এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে একটি বিশেষ গোষ্ঠী যখন রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমের ভাষাকে হিন্দুর ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নির্বাসিত করতে সচেষ্ট, তখনো রবীন্দ্রনাথ এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিসমূহের বিপরীতে বাঙালির সার্বজনীন বোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে যান অনন্য সাহসে। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসংগীত, তাঁর কবিতা, ছোটগল্প এবং তাঁর ধর্মভাবনা-সমাজভাবনা আমাদের অন্তর্দেশ স্পর্শ করে, আমাদের সাহস যোগায় অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালি সংস্কৃতির চির ঐতিহ্য রক্ষায় শৈল্পিক সাহসে এগিয়ে যেতে।

আজকে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন, রবীন্দ্রসংগীত মেলা, রবীন্দ্র-চিন্তা-ভাবনা নিয়ে নানা ধরনের সেমিনার-সিম্পোজিয়াম রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বহুকৌণিক পরিসরে। ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিকা’ গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন যে, ‘রবীন্দ্র-প্রতিভার গতি বিকাশ ও পরিণতি মন্থর।... ধীরে ধীরে বাড়ে, ফলে ফুলে পল্লবে নিজেকে সমৃদ্ধ করে...।’ আর এ প্রসংগে একথাও সত্য যে, রবীন্দ্রপ্রতিভা সময়ের চাহিদায় বেড়ে ওঠে নিবিড় প্রত্যয়ে, বাস্তবতার কালধর্ম বুঝে। আমরা যখন বিপদে পড়ে পথ খুঁজে পাই না, বহুবিধ সংকটে ব্যক্তিগতভাবে জাতিগতভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ি, তখন কবিগুরুর দিকে মুখ ফেরাই, তাঁর অমর কাব্য-সংগীতের অমেয়ধারায় সিক্ত হই, ফিরে পাই দাঁড়াবার সাহস। এই সন্ত্রাসী ধূসর প্রান্তরে যখন বারুদের গন্ধ আর রক্ত-লাশের উলঙ্গ তাণ্ডবে আমরা নিরাপত্তাহীন সামগ্রিকতায় অন্বিষ্ট, তখন রবীন্দ্রসৃষ্টিচেতনে খুঁজে পাই বাঁচার মন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে-সংগীতে রয়েছে একধরনের মেডিসিনাল শক্তি, যা আমাদের আশায় বলিয়ান করে, আত্মার ধূসর জগতে বয়ে আনে প্রভাতসূর্যের হাসি।

তাঁর নোবেল প্রাপ্তির একশ বছর পরে আজ আমরা যখন ভাবতে বসি, আমাদের চোখের সামনে যে মানুষটির ছায়া ভেসে ওঠে, তিনি তাঁর আরাধ্য জীবনদেবতাকে শেষমেশ স্বদেশের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন- সেইটুকু সত্যের বাইরেও তাঁকে নিয়ে অনেকভাবেই ভাবা যায়, কারণ, তিনি পরিবতর্নের আবর্তে কখনো কখনো আমাদের চেনা-জানার জগতের বাইরে চলে যান, আমরা বিভ্রান্ত হই। আবার সেই বিভ্রান্তি কেটে গেলে তাঁকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এই হলো রবীন্দ্রনাথ-আমাদের খুব কাছের মানুষ- বেদনা বিছায়ে যিনি পরমেশ্বরকে আবাহন করেন কেবল সত্য-সুন্দরের মধ্যে নিজেকে সমর্পনের জন্য নয়, সমগ্র মানবচিত্তকে  অনন্ত প্রেমের জল-হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে মহাকালের দিকে। আর সে কারণেই তিনি বিশ্বকবি, বিশ্বমানবের কবি। তাঁর কাছে আমাদের বারে বারে ফিরে যেতে হয়।





খোরশেদ আলম
জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ এবং রবীন্দ্র-ভ্রমণ ও চিঠিপত্র

___________________________________________________________


আত্মশক্তি, কালান্তর কিংবা সভ্যতার সঙ্কট নামক প্রবন্ধগ্রন্থসমূহে জাতি-জাতিগঠন-রাষ্ট্র-রাজনীতি-সভ্যতা প্রভৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিস্তর কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র কিংবা ভ্রমণকাহিনিÑএসবে আটঘাট বেধে শক্ত কথা বলার দরকার পড়ে না। তবুও যাঁকে আজানু রোমান্টিক-কল্পনাপ্রবণ আর ঋষিত্বের (শ্মশ্রুমণ্ডিত বলেই বেশি চোখে ধরে কীনা!) তিলক আমরা পরিয়ে দিয়েছিলাম সে-ই ভাবপ্রবণ মানুষটিই কতটা জাতিক-আন্তর্জাতিক সঙ্কটে হৃদয়ভরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে লেখা তাঁর ব্যক্তিগতপত্র ও ভ্রমণকাহিনি।   

জাতি-জাতীয়তা-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে রবীন্দ্র-ভাবনা বর্তমান যুগসঙ্কটেও সচল বা সমসাময়িক। একজন রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি আন্তরিক সমাধান দিতে চেয়েছিলেন মানুষে-মানুষে ভাল থাকার কৌশলী উপায় আবিষ্কার করে। একজন কবি বা সাহিত্যিক তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তাঁকে যুগান্তরের মানব-সম্প্রদায় তাহলে স্মরণ করে কীসের ভিত্তিতে? যদিও সমাজ-রাষ্ট্র সবসময় (অপ)শক্তিমানদের নিয়ম ও দখলদারিত্বেই চলে। সাহিত্যিকের অস্ত্র তাঁর কলম। সময়-অসময় লাঠি উচানো তাঁর কাজ নয়, শোভনও নয়। তবু একজন সাহিত্যিক সমাজের সত্যদ্রষ্টা হেতু তার গোপন-প্রচালকও।

আলোচনার প্রথমে দেখা যাক, জাতীয়তাবাদ বিষয়ক রবীন্দ্রনাথের ভাবনাগুলো কী। তারপর তাঁর ব্যক্তিগত চিঠি ও ভ্রমণকাহিনি নিয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে। ‘জাতি’ বলতে বাংলায় যা বোঝানো হয় তাকে ইংরেজিতে বলে ঘধঃরড়হ. অন্যদিকে ঝঃধঃব মানে ‘রাষ্ট্র’। ঘধঃরড়হ ও ঝঃধঃব আজকের যুগে পারস্পরিকভাবে এমন গ্রন্থিবদ্ধ যে, এ-দুটো শব্দকে প্রায়শই আলাদা করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নেশন কী’ প্রবন্ধে ‘জাতি’ বা ঘধঃরড়হ শব্দের পরিবর্তে জধপব ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কারণটি কিঞ্চিৎ অগ্রসর হলে স্পষ্ট হবে।

ঊসঢ়রৎব শব্দটি রাজ্য, সাম্রাজ্য কিংবা আধুনিক যুগে যাকে রাষ্ট্র বলে তার পূর্বরূপ। আবার কেউ কেউ জাতি ও রাষ্ট্র শব্দ দুটোকে একসঙ্গে জাতি-রাষ্ট্র বলেন। ফলে শব্দ বিভ্রাটের এ-বিষয়টিকে পরিষ্কার করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে--বাংলায় ঘধঃরড়হ শব্দের যথার্থ সমার্থক শব্দ নেই। তাই তিনি জাতি অর্থে ‘রেস’ শব্দটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। ফরাসি চিন্তাবিদ রেঁনার যুক্তি ছিল : “প্রাচীনকালে ‘নেশন’ ছিল না।” তাঁর মতে “ইজিপ্ট চীন প্রাচীন কালডিয়া ‘নেশন’ জানিত না। অসিরীয়, পারসিক ও আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যকে কোনো নেশনের সাম্রাজ্য বলা যায় না।”(‘নেশন কী’) রেঁনা আরো জানিয়েছেন : রোম সাম্রাজ্য নাকি নেশনের কাছাকাছি গিয়েছিল। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ঘধঃরড়হ অভিধাটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক আর সেটা এসেছে রোম সাম্রাজ্যেরও পরে। ঊসঢ়রৎব শব্দটি পুরনো; একে বদলে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের খণ্ড খণ্ড বিভাজন ঘধঃরড়হ শব্দটি তৈরি করে। ফলে আধুনিক রাষ্ট্র-ধারণারই অপর নাম হয় ঘধঃরড়হ. অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ‘ঘধঃরড়হ’ ও ‘জাতি’ শব্দ দুটো এক অর্থে নিতেও সম্মত হন নি। পুরনো দিনের ধর্ম, ঐতিহ্য ও রাজ-রাজড়াদের সময়কে ঘিরে তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ জাতি’র ধারণা ইউরোপ তৈরি করেছিল। তাকেই তারা কখনো বলেছে ‘নেশন’। যেমন : হিটলারের জার্মান নেশন। এসব খণ্ডন করে রবীন্দ্রনাথ অগ্রসর মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। পূর্বতন ‘ঊসঢ়রৎব’-এ টিউটন, কেল্ট, নরম্যান ইত্যাদি নামগুলো ধর্ম, ভাষা তথা জাতিগত বিশুদ্ধতার নামান্তর রূপে দাঁড় করান যায়। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে¬ হিন্দুস্তানি, পাকিস্তানি কিংবা গোরা, বাঙালি এসব কিছুই বর্ণ-সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতি-পরিচয়ের ব্যাপার। কারণ শুধুমাত্র ধর্ম, ভাষা, বর্ণ ইত্যাদির মাধ্যমে আলাদাকরণ নীতিই এখানে জাতি হিসেবে চিহ্নিত হবার পেছনে উল্লেখযোগ্য দায়ী ফ্যাক্টর। সে জন্য রবীন্দ্রনাথও জাতি বলতে প্রথমে ‘রেস’ শব্দ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ফরাসি চিন্তাবিদ রেঁনার মতে উপনীত হয়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই ‘জাতি’ ‘নেশন’ ‘রেস’ ‘রাষ্ট্র’ ইত্যাদি ধারণাগুলো সুগ্রথিত রূপ লাভ করে। আসলে নেশন একটি ‘সজীবসত্তা’ তথা ‘মানস পদার্থ’ যেখানে মানুষের মানবিক সত্তা বা গুণসমূহের বিচার-বিশ্লেষণসমেত তাকে একটি ‘সেক্যুলার’ রূপদানের চেষ্টা করা হয়। বর্ণ, ধর্ম, ভাষার ঐক্য সেখানে মুখ্য বিষয় না হয়ে ‘একত্রে দুঃখ পাওয়া, আনন্দ করা, আশা করা’এ-বিষয়গুলো গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। কাজেই জাতীয়তাবাদ আসলে একটি অনুভূতিগত বিষয়, যার শাব্দিক বা অন্য কোন মূর্ত্যরূপ প্রদান করা আপাতভাবে অসম্ভব। অনেকগুলো সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গের সফল বাস্তবায়ন ঘটলেই কেবল এর সার্থক প্রকৃতি ও গুণ বিকশিত হতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের নানা স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও স্মৃতি। জাতীয়তাবাদের বস্তুগত ভিত্তি হিসেবে ভূখণ্ড, ভাষা, ধর্ম ও অর্থনীতির ঐক্যের বিষয়ও কখনো কখনো গুরুত্ব পায়। তবে নিরপেক্ষ একটি অবস্থানে ধর্মীয় বিষয়টিকে ছাপিয়ে অন্যান্য উপাদান সমূহের কার্যকরি প্রয়োগ ঘটে জাতি-রাষ্ট্রসমূহ তৈরির ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ এজন্যই বলেছেন : ‘ব্যক্তিবিশেষ, ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, য়িহুদি অথবা নাস্তিক, যাহাই হউক না কেন তাহার ইংরেজ, ফরাসি বা জার্মান হইবার কোন বাধা নাই।’(‘নেশন কী’) কোন ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সীমা বিভাজন ‘নেশনে’র একটা প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা হলেও শুধুমাত্র ভূখণ্ড, বর্ণ বা ভাষা এটাকে গঠন করে না। নেশন তা-ই যা তার প্রাচীন ঐতিহ্য, বীরত্বগাথা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নানা উপকরণের সম্মিলিত ফল। বর্তমান ও ভবিষ্যতে জীবনের নানা অনুষঙ্গকে মানুষ এখানে একসঙ্গে লালন ও পালন করতে পারে। তিনি আরো বলেছেন :

অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ-স্বীকার এবং পুনর্বার সে জন্য সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভার হইতে জনসাধারণকে যে একটি একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন। (‘নেশন কী’, আত্মশক্তি, রবীন্দ্র প্রবন্ধসমগ্র)
আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণার দিকেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। তার সঙ্গে যে-আবেগ তিনি জড়িয়েছেন সেখানে (ভূখণ্ডকেন্দ্রিক ভৌগোলিক সীমায় নির্দিষ্ট) একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে বোঝালেও তার ভেতরে সজীব ও প্রাণবন্ত মানুষের উপস্থিতিকে তিনি অগ্রগণ্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ‘নেশনে’র ব্যাখ্যাদানের জন্য রেঁনার আদর্শকেই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় সমাজের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের কাজে ব্যবহার করেছেন। যে ‘অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ও সেই স্মৃতির অনুরূপ ভবিষ্যতের আদর্শে’র কথা তিনি বলেছেন তাতে স্পষ্টতই স্বভারতভূমের জাতি-গঠনের নিদের্শনা ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে :
হিন্দু সভ্যতা যে এক অত্যাশ্চর্য প্রকাণ্ড সমাজ বাঁধিয়াছে, তাহার মধ্যে স্থান পায় নাই এমন জাত নাই। প্রাচীন শক জাতীয় জাঠ ও রাজপুত; মিশ্রজাতীয় নেপালী, আসামী, রাজবংশী, দ্রাবিড়ী, তৈলঙ্গী, নায়ারসকলে আপন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও আচারের নানা প্রভেদ সত্ত্ব্ওে সুবিশাল হিন্দু সমাজের মধ্যে একটি বৃহৎ সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে। (‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’, আত্মশক্তি)

রবীন্দ্রনাথ এ-তথ্যসূত্রেই ‘ভারতবর্ষী সমাজ’-এর গৌরব গাথা বর্ণনা করেছেন। সে-সঙ্গে ইউরোপীয় ‘নেশন’-এর ত্র“টি ও দুর্বল দিকসমূহের নানা ব্যাখ্যা দান করেছেন। স্বাদেশিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিচিত্র বর্ণভিত্তিক ধারণা নিয়ে ইউরোপও একদিন ‘নেশন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ইউরোপের সেই ন্যাশনাল ঐক্য পরবর্তীকালে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে প্রয়োগ ঘটে। ফলে দীর্ঘকাল ধরে বহির্বিশ্ব তথা ঔপনিবেশিত ভূখণ্ডসমূহ কেবল তাদের লালসা ও লোভের অপরিণামদর্শী শিকারে পরিণত হচ্ছিল এবং আজো হচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধের অপরিমেয় ক্ষতি ও মানুষের মানবিক স্খলন ইউরোপীয় সমাজের প্রভুত্বের করাল ছায়াকে স্পষ্ট করে। এতে দ্বিমত নেই যে, ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসী রূপ অন্যবিশ্বের প্রতি হুমকি বলেই তাদের সভ্যতার দানে কেউ উপকৃত হতে পারেনি। রবীন্দ্র-জীবনের পরিণতিকালে পাশ্চাত্য সভ্যতার দিক থেকে মুখ ফেরানোর ব্যাখ্যা এখানেই নিহিত। একসময় অন্তরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ইউরোপকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন অথচ তাকেই তিনি বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হতে দেখেছেন। এ-কারণেই   কালান্তর প্রবন্ধে তাঁর অভিব্যক্তি : ‘ইউরোপীয় নবযুগের শ্রেষ্ঠদানের থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত হয়েছে ইউরোপেরই সংস্রবে। নবযুগের সূর্যমণ্ডলের মধ্যে কলঙ্কের মতো রয়ে গেল ভারতবর্ষ।’ শুধু ভারত নয়, ঔপনিবেশিক যে কোন অঞ্চলেই তারা শেষ পর্যন্ত তথাকথিত উদারতার প্রমাণ রাখতে অক্ষম হয়। তিনি বলেন : ‘আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া যে নেশন বাঁধিয়াছে, তার মধ্যে আদিম অধিবাসীরা মিশিয়া যাইতে পারে নাই।’
ভারতবর্ষে এ-ঐক্য ঘটেছিল। আফ্রিকা, চীন ইত্যাদি অঞ্চলও ইউরোপের প্রভুত্বের বলি হয়। দুর্বলের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আকাশ। ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ ও ইউরোপীয় ‘নেশন’কে মূলত রবীন্দ্রনাথ তাদের উপনিবেশগুলোর ওপর ধ্বংসযজ্ঞের পরই আলাদা করেছিলেন। ইউরোপের তৈরি তথাকথিত ‘আদর্শ নেশন’-এর সংকীর্ণতা অন্য জাতি-গোষ্ঠীর ওপর যথাপ্রযুক্ত হয় না বলেই তাঁর সকল ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। স্বীয় অস্তিত্ব অন্বেষণে শেষপর্যন্ত তিনি পশ্চাতাভিমুখী ঐতিহ্যিক ভারতের সন্ধানী হন। রবীন্দ্রনাথের চোখে ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ সহযোগিতামূলক আর ‘ইউরোপীয় নেশন’ পারস্পরিক বিদ্বেষের সূত্রে গ্রথিত। এ-বিদ্বেষকে অতিক্রম করে, সমসাময়িক বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করেই তিনি ইউরোকেন্দ্রিক নেশন-এর ধারণা বদলাতে চেয়েছিলেন। শুধু জাতি বিশেষের মুক্তি নয়, নিখিল মানবের মুক্তি তিনি চেয়েছিলেন। ‘সভ্যতার সংকট’-এ ইউরোপের প্রতি রবীন্দ্রনাথের চরম নেতিমনোভাব আবি®কৃত হয়। তাতে তাঁর অভিমানের বহিঃপ্রকাশও পরিদৃষ্ট। ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’

এ-থেকে অবশ্য একটি বিষয় পরিষ্কার হয় তা হলশুভবুদ্ধির পথে সামাজিক মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ মনে-প্রাণে আশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূলে তিনি দেখেছেন প্রভুত্বের চরম লোভকে। ইউরোপের কতিপয় রাষ্ট্র বীজ থেকে মহীরূহ হয়ে সাম্রাজ্যে রূপান্তর ঘটে বলেই সেখানকার ‘নেশন’ ব্যর্থ হয়। ‘১৯১৪-তে লড়াইয়ের মূল হিসেবে তিনি দেখলেন প্রভুত্বের লোভ, এর উৎপত্তি ‘বর্তমান য়ুরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যে।’ ১৯১৯-এ ‘বাতায়নিকের পত্রে’ ইউরোপের রাজনীতিকে তিনি বললেন, ‘‘শক্তিপুজা’ এবং এর মূলে আছে লোভ, যতদিন লোভ থাকবে শক্তি সম্মেলন ব্যর্থ হতে বাধ্য।’ সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই তাঁর ভবিষ্যৎবাণীতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সর্তকবাণী উচ্চারণ করেই তিনি ভারতবর্ষ গ্রন্থের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন : ‘য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলভিত্তি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ যদি অধিক স্ফীতি লাভ করে যে, ধর্মের সীমাকে অতিক্রম করিতে থাকে; তবে বিনাশের ছিদ্র দেখা দিবে এবং সেই পথে শনি প্রবেশ করিবে।’ রবীন্দ্র-সমসাময়িক পৃথিবীর অবস্থাই একথা প্রমাণ করেছে যে, ইউরোপের সাম্রাজ্য যা তাঁর দৃষ্টিতে ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’ তা অনিবার্যভাবেই পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের আশা ভরসাকে গলাধঃকরণ করেছে। ‘লীগ অব নেশন্স’-এর ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। রবীন্দ্রনাথ পক্ষপাতমূলক ‘লীগ অব নেশন্সে’র সমালোচনায় তাকে ‘অজগর নীতি’র সঙ্গেই তুলনা করেছিলেন।

সমকালীন বস্তুতান্ত্রিক ইউরোপের চণ্ডনীতির আবিষ্কার, প্রাচ্য সভ্যতার দিকে মুখ ফেরানো, সেই সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথকে আত্মাভিমানী করে তুললেও তিনি অবশ্য সংকীর্ণ অন্ধকুপে পা রাখেননি। বড় প্রমাণ- তাঁর ধারণা কিংবা বিশ্বাস ভারতবর্ষীয় বাঙালি সমাজকে বিজ্ঞান-বিরোধী করেনি। ইউরোপের বস্তুতন্ত্রের প্রতি রাবীন্দ্রিক অবিশ্বাস আসলে বিজ্ঞান-বিরোধী নয়। বস্তুতন্ত্র আর প্রাযুক্তিক বিভেদটা তাঁর সঠিকভাবেই জানা ছিল। না হলে, গান্ধীজির চরকা আন্দোলনকে তিনি শেষ পর্যন্ত সমর্থনই করতেন। কারণ তিনি জানতেন, সমগ্র ভারতবাসীর কাছে অন্নবস্ত্রের নিত্য-নৈমিত্তিক অভাব-অভিযোগের বিশাল জগদ্দল পাথরের মধ্যে চরকা শেষ পর্যন্ত কোন মহৎ সমাধান নয়। এজন্যই বিদেশী বস্ত্র পোড়াবার স্বদেশী আন্দোলনকে তিনি সমর্থন যোগাননি।

‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর সম্পর্ক ছিল উভয়পক্ষ থেকেই প্রচুর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের। স্বাধীনতার জন্য আত্মশক্তির বিকাশ চাই, একথা রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর মতই জোর দিয়ে বলেছেন।’  তবুও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্য অনেক বড় আকার ধারণ করে। তবে বাস্তবসম্মত উপস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথের ‘নেশন’ চিন্তা মাঙ্গলিক অর্থেই প্রায়োগিক সত্য বলে ধর্তব্য। যে ‘ঝঢ়রৎরঃঁধষ ৎবনরৎঃয’ -এর কথা তিনি বলেছেন তার মূলে রয়েছে লোভ, হিংসা কিংবা জঙ্গী মনোভাব থেকে সরে দাঁড়াবার জন্য ইউরোপকে উপদেশ দান। অন্যদিকে ভারতবর্ষীয় সমাজের জন্য তাঁর আদর্শঅধ্যাত্মবাদ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সমন্বয়ে বিশালায়তনিক ভূখণ্ডে বসবাসরত ভারতবাসীর সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হবার মন্ত্র।

ইউরোপীয় ‘নেশন’এর ধারণাকে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই শেষজীবনে এসে খণ্ডন করেছেন। ইউরোপ নিজেদেরই তৈরি ঘধঃরড়হ-এর মৌলসত্য বা অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি অবিশ্বাসী। ঊসঢ়রৎব ও ঘধঃরড়হ-কে তারা কার্যত একীভূত করে বলেই আধুনিক চিন্তার নির্মাতা হয়েও বুমেরাং হয়ে ইউরো ঘধঃরড়হ-এর ধারণা। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাসমরে ইউরোপের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দেখেও সেটা স্পষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ভারতবর্ষীয় সমাজে’র ব্যাখ্যা পূর্ব ইউরোপের ঝড়পরধষরংস-এর কাছাকাছি। আবার ঠিক এর মত নয় বলেও তার একটি মৌলিক আবেদন আছে যা রবীন্দ্রনাথেই স্বতঃসিদ্ধ।

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ঘধঃরড়হ ও ঊসঢ়রৎব শব্দ দুটোকে আন্তঃসম্পর্কিত ও অবিশ্লিষ্ট বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই সঙ্গে ঘধঃরড়হ-এর ধারণাকে আধুনিক মানুষের কল্পনাচার বলেও অভিব্যক্ত করেছেন। জে.এ হবসন তাঁর ওসঢ়বৎরধষরংস গ্রন্থে ‘অ ঘধঃরড়হ রং ধ ড়াবৎভষড়ি ড়ভ হধঃরড়হধষরঃু’ বলে ঊসঢ়রৎব-এর ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ঘধঃরড়হধষরঃু-র উচ্চণ্ড রূপই ঊসঢ়রৎব তৈরি করে। ঘধঃরড়হ-এর পূর্বতন হিসেবে ঊসঢ়রৎব-এ ফিরে যাবার বিষয়টি উচ্চণ্ড নীতির সঙ্গে সমপ্রযুক্ত। শুধু তাই নয়, সমার্থক অর্থ তৈরির কৌশলে আধুনিক ঘধঃরড়হ পরিণত হয় বহু বছর আগের রেঁনা কথিত রোম সাম্রাজ্যের ঋবঁফধষরংস-এ। আসলে রেনেসাঁ ও রিফর্মেশনের ফলে পুরাতন ধারার সামন্ততন্ত্র ভেঙে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হলেও উদারনৈতিক ঘধঃরড়হ পরবর্তীকালে তার মূল্যমান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যিক পুঁজিতন্ত্র আর যন্ত্র-নির্ভর অর্থনীতি প্রত্যেকটি জাতিরাষ্ট্রকেই পাশ্ববর্তী কিংবা দূরবর্তী রাষ্ট্রের দিকে অযাচিত হাত বাড়াতে সাহায্য করে। বেনেডিক্ট এন্ডারসন তাই ঘধঃরড়হ-কে নাম দেন ‘ওসধমরহবফ পড়সসঁহরঃু’  বলে আর মিশেল ফুঁকো নাম দেন ‘উরংপঁৎংরাব ভড়ৎসধঃরড়হ’   বলে।

মনোবিদ ও দার্শনিক ফ্র্যাঞ্জ ফ্যানোর জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাণ ভাবনা ও উত্তর ঔপনিবেশিক তত্ত্ব অত্যন্ত বৈপ্লবিক ও গুরুত্ববহ। ঞযব ডৎবঃপযবফ ড়ভ ঃযব ঊধৎঃয-এর "ঙহ ঘধঃরড়হধষ ঈঁষঃঁৎব" নামক প্রবন্ধে তিনি জাতীয় সংস্কৃতির ঐক্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রেখেছেন। তাঁর ধারনাÑ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আন্দোলন যে-বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছিল তা নিম্নশ্রেণীর অত্যাচারিত মানুষদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও তাদের কন্ঠস্বরকে উচ্চে তুলে ধরবার সংগ্রাম ব্যতিরেকেই (পরিসীমাগতভাবে সংকীর্ণ) মধ্যশ্রেণীর উত্থানে ব্যবহৃত হয়ে নিজের শক্তিকে হারিয়েছিল। অন্যদিকে ‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’ অর্থে প্রকৃত স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বলতে তিনি অত্যাচারিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সংহতিমূলক প্রচেষ্টার কথা বলেছেন। ঘধঃরড়হধষ ঐক্য অর্থে একটি ভূখণ্ডে অস্তিত্বশীল সকল শ্রেণীর মানুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও তিনি বলেছেন। আসলে বোঝাই গেলতৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতার আন্দোলনে বাস্তবেই তা ঘটেনি এমনকি স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও নয়। গধৎরধঃবমঁর ব্যাখ্যা করেছেনদঞযব হধঃরড়হ রং ধহ ধনংঃৎধপঃরড়হ, ধহ ধষষবমড়ৎু, ধ সুঃয ঃযধঃ ফড়বং হড়ঃ পড়ৎৎবংঢ়ড়হফ ঃড় ধ ৎবধষরঃু ঃযধঃ পধহ নব ংপরবহঃরভরপধষষু ফবভরহবফ.’  অন্যদিকে খধংিড়হ বলেছেন : দঘধঃরড়হধষরংস রং ধ ৎবধপঃরড়হ ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষবং যিড় ভববষ পঁষঃঁৎধষষু ধঃ ধ ফরংধফাধহঃধমব.’ 

নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও অ্যান্ডারসনের মতে এটা এখন আমাদের রাজনৈতিক জীবনে বিশ্বজনীন সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে। দীপেশ চক্রবর্তী তাই আরো একটু অগ্রবর্তী হয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ইউরোপীয়ান ইম্পিরিয়ালিজম এবং তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী লক্ষবিন্দু একাকার হয়ে গেছে। তিনি ঝড়ঁঃয অংরধহ জবৎরব-িতে এই কথাই বলেছেন :

ঊঁৎড়ঢ়বধহ রসঢ়বৎরধষরংস ধহফ ঃযরৎফ ড়িৎষফ হধঃরড়হধষরংস যধাব ঃড়মবঃযবৎ ধপযরবাবফ ঃযব ঁহরাবৎংধষরুধঃরড়হ ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ ংঃধঃব ধঃ ঃযব সড়ংঃ ফবংরৎধনষব ভড়ৎস ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপধষ পড়সসঁহরঃু. 
দীপেশ চক্রবর্তীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, ঊঁৎড়ঢ়বধহ রসঢ়বৎরধষরংস-কে চেনা বরং সহজসাধ্য। কারণ, তা অধিকৃত রাজ্যের বস্তুগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে চায় প্রত্যক্ষভাবে। অন্যদিকে আঠার-ঊনিশ শতকের মুক্তবাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি উপনিবেশগুলোতে শোষণের নতুনতর রূপ হিসেবে ঘধঃরড়হধষরংস-এর হাতিয়ার নিয়ে পরোক্ষভাবে হাজির হয়। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয়ান ইম্পিরিয়ালিজমের সম্প্রসারিত রূপ ঘধঃরড়হধষরংস-কে যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘ঘধঃরড়হধষরংস’ নামক প্রবন্ধে তাঁর ভাষ্য :

দঞযব ঘধঃরড়হ যধং ঃযৎরাবহ ষড়হম ঁঢ়ড়হ সঁঃরষধঃবফ যঁসধহরঃু. গবহ ঃযব ভধরৎবংঃ পৎবধঃরড়হং ড়ভ এড়ফ, পধসব ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব ঘধঃরড়হধষ সধহঁভধপঃড়ৎু রহ যঁমব হঁসনবৎং ধং ধিৎ সধশরহম ধহফ সড়হবু সধশরহম ঢ়ঁঢ়ঢ়বঃং, ষঁফরপৎড়ঁংষু াধরহ ড়ভ ঃযবরৎ ঢ়রঃরভঁষ ঢ়বৎভবপঃরড়হ ড়ভ সবপযধহরংস.’ 
এবংবিধ কারণেই পশ্চিমের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের উদ্ভবে তাই রবীন্দ্রনাথ ‘ন্যাশনালিজম’কেই দায়ি করেছিলেন। এমনকি ইউরোপের প্রভুত্বকামনা, লোভ ও রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেও এর মারাত্মক প্রভাব লক্ষণীয় সে-কথাও ভেবেছিলেন।

জাতীয়তাবাদ, ভ্রমণ ও চিঠিপত্র
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, বক্তৃতা কিংবা নানা দেশ পরিভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যেও তাঁর সূতীক্ষè ন্যাশনালিজম ধারণা তথা রাজনৈতিক অভিজ্ঞান দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। রবীন্দ্রনাথ ঊসঢ়রৎব ও ঘধঃরড়হ উভয় বিষয়ের প্রতি সুপ্রসন্ন নন বরং তিনি এগুলোকে দযরফবড়ঁংষু ঢ়ৎড়ভধহব পঁষঃ[ং]’ অর্থাৎ  ন্যাক্কারজনক চর্চা, দপঁষঃ[ং] ড়ভ উবারষ-ড়িৎংযরঢ়’ কিংবা ‘শয়তানের পূজা’ বলে অভিহিত করেছেন তাঁর ৯৮ নং পত্রে এবং একই সঙ্গে দযিরৎষরিহফ ড়ভ ৎধপব ধহঃরঢ়ধঃযু’, দধ ঃড়বিৎ ড়ভ ংশঁষষং’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছে অভিষিক্ত করে ন্যাশনালিজমকে ঘোরালো বিশ্বপরিস্থিতির সহযোগী নষ্ট শক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এছাড়া পৃথিবীকে নরমুণ্ডে ভর্তি এক ভাগাড়ে পরিণত করার অপদানব হিসেবেও একে ব্যাখ্যা করেছেন।  রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় উপন্যাসে, নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে প্রাসঙ্গিকভাবে এ-বিষয়গুলো ধরা পড়েছিল আগেই। পরবর্তীকালে তাঁর দীর্ঘজীবনের নানা পথপরিভ্রমণ ও চিন্তার সারাৎসার সম্বলিত প্রবন্ধসমূহে ব্যাপকভাবে এ-চিন্তার   বিস্তার ঘটে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সম্পর্কিত কাহিনিগুলো তিনি চিঠিপত্রের আকারেও প্রকাশ করেছেন। বন্ধু ও প্রিয়জনদের কাছে লিখিত রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের মধ্যে গভীর চিন্তাদর্শন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো তাঁর ভারত উপমহাদেশের নানা স্থান, ইউরোপ, আমেরিকা, চিন, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া কিংবা পারস্য ভ্রমণের ফল। এই ভ্রমণের ভেতর দিয়েই তিনি নানা গুণীমানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কিংবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন। সে-সবের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার একটি অংশকে রূপান্তরিত করেছেন চিঠিপত্রে কিংবা অসাধারণ বাগ্মীতায়। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচয়িতা রবীন্দ্রনাথের চিঠি ও বক্তৃতাগুলো তাঁর তাৎক্ষণিক অনুভূতির ফল হলেও তার মধ্যে তিনি দেশ-জাতি-রাজনীতি সম্পর্কিত গভীর দার্শনিক প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছেন। বিভাজিত কোনও সত্তা নয়, কেবল সংহতিমূলক একটি সংস্কৃতি তৈরি করবার জন্যই যেন ছিল তাঁর সারাজীবনের সাধনা। তা তাঁর উপনিষদপ্রাপ্ত সত্যম, শিবম ও সুন্দরম এই তিনের জন্য ব্যয়িত। ফলে বিরোধমূলক সংস্কৃতির চেয়ে সংশ্লেষিত বা একত্রীভূত বিশ্বমানবতার স্ফুরণ ঘটানোই ছিল তাঁর প্রধান কাম্য। এ-কারণেই তিনি ইউরোপীয় ‘নেশনে’র মূলে নিহিত নানা বিভাজিত সত্তার দৈন্যকে আবিষ্কারের পর ভারতবর্ষীয় প্রাচীন সমাজ-কাঠামোর মধ্যে স্থৈর্য ও সমাজমূলক সংহতি তথা ঐক্যকে খুঁজতে চেয়েছেন। বিদেশী বন্ধু সি. এফ. এন্ডরুজের কাছে লিখিত রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যায়:

আমরাই সমগ্র মানবজাতির জন্য স্বাধীনতা অর্জন করব। আমাদের ভাষায় ‘নেশন’ কথাটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। যখন এই শব্দটি অন্যদের কাছ থেকে ধার করে আমরা ব্যবহার করব, সেটা আমাদের পক্ষে ঠিক খাটে না। কারণ আমরা সন্ধি করব নারায়ণের সঙ্গে, নারায়ণী সেনার সঙ্গে নয়। তাই আমাদের যে জয়, সে ভাগবৎ রাজ্যেরই জয়। পশ্চিমকে আমি দেখেছি। যে অপবিত্র ভোজে সে সর্বদা মত্ত, ... তাতে আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। জ্বলন্ত মশালের আলোয় মধ্য রাত্রের এই যে মত্ততা, তা আমাদের জন্য নয়। আমাদের রয়েছে শান্ত উষার...নবজাগরণ। (অনু. : মলিনা রায়, রবীন্দ্রনাথ-এন্ডরুজ পত্রাবলী)
আত্মম্ভরিতা ও দুষ্টচক্রে পূর্ণ ‘নেশন’ ও ‘ইম্পায়ার’-এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিম জগতে বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক ঐক্য কামনা করেছিলেন। উপনিষদীয় সত্যম, শিবম, সুন্দরম-এর আলোকে বর্ণিত পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণই বিশ্বশক্তি ও ঐক্য গড়ে তুলতে পারে বলে তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন।

১৮৬১ সালে একটি ক্রান্তিকালীন সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর জন্মের চার বছর আগেই ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ‘নিম্নবর্গের একটি আন্দোলন’কে  ধ্বংস করা হয় এবং তিন বছর পরেই ভারতীয় ভূমিসত্ত্বের উপর পূর্ণাঙ্গ দখলদারিত্ব আইন অনুমোদিত হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে। বৈদেশিক প্রপীড়ক ঔপনিবেশিক শক্তিকর্তৃক ভারতবর্ষের মানুষ স্বভূমে পরবাসীতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি এর মাধ্যমেই পাকাপোক্ত হয়। ব্রিটিশরা যেন ভারতবাসীদের খাওয়ানো-পরানো কিংবা প্রতিপালনের অভিভাবকত্ব অর্জন করে নেয়। আর এখানকার মানুষ তাদের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে শেখে। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের শুভ বোধোদয়ের ব্যাপারে তাদেরকে ভারতবাসীর প্রতি মানবিক আচরণ করতে বলেছিলেন। মনেপ্রাণে একজন মানবতাবাদী মানুষ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ভারতবাসীর প্রতি ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ ও অবিচারকে মেনে নেয়া বাস্তব কারণেই সম্ভব ছিল না। কারণ ভারতবাসীরা ব্রিটিশদের জন্য ল্যাম্পপোস্ট স্বরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি তাদের প্রদীপের জন্য নিজেদেরকে তেলসম জ্বালিয়ে তারা তাদের সভ্যতার উপকরণ যুগিয়েছে। অথচ তাদেরকেই তারা অপমানিত করেছে, তাদের মধ্যকার ঐক্যশক্তিকে নস্যাৎ করে দারিদ্র্যকে জিইয়ে রেখেছে। তাই বলে ভারতবাসীর কূপমণ্ডুকতাকেও রবীন্দ্রনাথ প্রশ্রয় দেন নি। অন্ধত্ব, অযৌক্তিক ঘৃণা ও বিদ্যমান পারস্পরিক অবিশ্বাসের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে তিনি গঠনমূলক আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে বলেছেন। সংঘর্ষ পরিহার করত জাতিগত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তীব্র অনুরোধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রমণ-বিষয়ক লেখাসমূহে ব্রিটিশদের উচ্চ-নীচ ভেদবুদ্ধির দ্বারা নির্মিত রাজনৈতিক অপব্যবহারের উপর ভীষণ অপ্রসন্ন ছিলেন। তাঁর এই অপ্রসন্ন মনোভাব ও সচেতনতার গভীরে নিহিত ছিল ইউরোপীয় ‘নেশন’, সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বিরূপতা।

এক জাতির ওপর আরেক জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, শোষণমূলক আচরণের মাধ্যমে যে নির্মমতা ও নৃশংসতা জন্ম দিয়েছিল ব্রিটিশ তাতে এই উপমহাদেশের মানুষ ‘ঙঃযবৎ’ বা অপরে পরিণত হয়। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ বাতিল বলে ঘোষণা দিতে দ্বিধা করেননি। লন্ডন থেকে লিখিত কোন একজন ভদ্রমহিলার জবাবে লিখিত পত্রে তিনি এ-বিষয়টিকে তুলে ধরেন। কথিত আছে যে, এই ভদ্রমহিলা রবীন্দ্রনাথকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোন একটি বক্তৃতায় আক্রমণ করতে দেখেছেন, তাই তিনি তাঁকে এ-বিরুদ্ধতার জন্য ভর্ৎসনা করেছিলেন। নিম্নে এ-বিষয়টি উদ্ধৃত হলো :

ও ফববঢ়ষু ভববষ ভড়ৎ ঃযব ৎধপবং যিড় ধৎব নবরহম রহংঁষঃবফ ধহফ রহলঁৎবফ নু ঃযব ৎঁঃযষবংং বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঢ়ড়বিৎভঁষ হধঃরড়হং নবষড়হমরহম ঃড় ঃযব ডবংঃ ধহফ ঃযব ঊধংঃ. ও ভববষ ধং সঁপয ভড়ৎ ঃযব ঘবমৎড়ং, নৎঁঃধষষু ষুহপযবফ রহ অসবৎরপধ, ড়ভঃবহ ভড়ৎ বপড়হড়সরপ ৎবধংড়হং, ধহফ ভড়ৎ ঃযব কড়ৎবধহং, যিড় ধৎব ঃযব ষধঃবংঃ ারপঃরসং ড়ভ ঔধঢ়ধহবংব রসঢ়বৎরধষরংস, ধং ভড়ৎ ধহু ৎিড়হমং ফড়হব ঃড় ঃযব যবষঢ়ষবংং সঁষঃরঃঁফব রহ সু ড়হি পড়ঁহঃৎু.

রবীন্দ্রনাথ এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির দুঃশাসন ও রক্তক্ষয়ে ফুঁসে উঠেছিলেন। অনৈতিকভাবে মানবতার এই লাঞ্ছনা এবং স্বৈরাচারমূলক আচরণকে তিনি অপরাধমূলক কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অপরিণামদর্শী ইউরো-শাসন নিরপরাধীকে দোষী করে, শাসকের শাসনের হাতকে আরো নির্মম করে এবং প্রভু ও দাসভিত্তিক একটি রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কায়েম করে। সেখানে শাসক ও জনগণ বাইনারী অপোজিশন বা দ্বিমেরুকরণের শিকার হতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী দখলদারিত্বের ভিত্তিতে দেশ ও মানুষের ওপর অকথিত এই নির্যাতনকেই হবসন বলেছেন ‘এৎববফ’ যা রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘লোভ’ এবং এডওয়ার্ড সাঈদ যাকে ‘সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘ঈঁষঃঁৎধষ ফড়সরহধহপব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। রবীন্দ্র-সমব্যথী পণ্ডিত রমাঁ রল্যাঁর কাছে লিখিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন :
চধৎধংরঃরংস, যিবৎব নধংবফ ঁঢ়ড়হ ঢ়ড়বিৎ ড়ৎ ঁঢ়ড়হ বিধশহবংং, সঁংঃ নৎববফ ফবমবহবৎধপু. অহফ ঃযব ঃরসব ংববসং ভধংঃ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপযরহম যিবহ ঃযব ংড়ঁষ রিষষ নব ংঁপশবফ ফৎু ভৎড়স ঃযব পরারষরুধঃরড়হ ড়ভ ঊঁৎড়ঢ়ব ধষংড় নু ঃযব মৎড়রিহম ষঁংঃ ভড়ৎ মধরহ রহ যবৎ পড়সসবৎপব ধহফ ঢ়ড়ষরঃরপং, ঁহষবংং ংযব যধং রিংফড়স ধহফ ঢ়ড়বিৎ ঃড় পযধহমব যবৎ সরহফ ধহফ হড়ঃ সবৎবষু যবৎ ংুংঃবস. 

রবীন্দ্রনাথ উপনিবেশিত ও উপনিবেশ স্থাপনকারীদের আন্তঃসাংঘর্ষিক জটিলতায় চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। চার্লস এন্ডরুজের কাছে লিখিত ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার দীর্ঘসূত্রী টানাপড়েনকে তিনি ‘অজগর নীতি’ উপমা দিয়েছিলেন। ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধেও সাম্রাজ্যবাদী মাৎস্যান্যায়কে তিনি এ-অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। রাষ্ট্রিক শোষণের ফলে অজগরের মতোই নিম্নশ্রেণীর অধঃস্তন রাষ্ট্রসমূহেকে গিলে খেতে চায় বড় রাষ্ট্রসমূহ। সঙ্গত কারণেই ব্রিটিশ সৈন্য অধিকৃত ইরাকে ব্যাপক হারে বোমাবর্ষণে নিরপরাধ নারী শিশুসহ সর্বসাধারণের ওপর খড়গাঘাতকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। ব্রিটিশদের মতো আমেরিকানদের সাম্প্রতিককালের ইরাকনীতির একরৈখিক পুনরাবৃত্তি ইউরোপীয় সভ্যতার বস্তু ও যন্ত্রনীতি শাসিত দুর্মর লোভ ও হিংসাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি বস্তুজগতে প্রভূত উন্নতির সহায়ক হলেও লোভ নামক পর-পীড়কের দুষ্টচক্রখাতে একরৈখিক এই উন্নয়নের পশ্চাতে নৈতিকতা বিবর্জিত সামুহিক লোভ ও যুদ্ধের নেশা জড়িত। বাস্তবিক অর্থে, সেখানে মানবিক বোধের অপনয়ন ঘটেছে বলে তিনি মনে করেছেন। শেখদের গ্রামের ওপর ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বোমা নিক্ষেপের তিনি তীব্র নিন্দা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতে : যিশু বিশ্বের যাবৎ মানব সন্তানকে ঈশ্বরের সন্তান বলে পরিগণিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান খ্রিস্টরা পিতা-পুত্রের এই বন্ধনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। যিশুর অন্তরে শেল বিদ্ধ করেই তারা মানব জাতির উপর সেই হিংসাত্মক যুদ্ধনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। যিশুর প্রতি রবীন্দ্রনাথের এ-শ্রদ্ধা ভারতের প্রখর মানবিকবোধ, উজ্জীবিত প্রেম ও সহানুভূতি সমন্বয়ে গঠিত অহিংসনীতির প্রসঙ্গ মনে করায়। গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ও অহিংসনীতিকে তিনি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ইংরেজ বিধ্বংসী নীতির অপনোদনের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ঘরে বাইরে উপন্যাসের নায়ক নিখিলেশের মধ্যে শক্তি ও সাহস প্রয়োগ করে রবীন্দ্রনাথ (অনেক বিষয়ে বিরোধ থাকলেও) গান্ধীজির অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতির প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিপক্ষে চরম অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর ১৯১৫ সালে তাঁর উপর বর্তিত নাইটহুড উপাধি বর্জন করে রবীন্দ্রনাথই জনসম্মুখে এই হিংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন। ১৯১৯ সালের ২রা জুন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ভাইসরয় এর নিকট লিখিত নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের খোলা চিঠিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তখন রবীন্দ্রনাথ যে প্রতিবাদ করেছিলেন তা সমসাময়িককালে কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। সাম্র্যাজ্যবাদী বিধ্বংসী নীতির বিপক্ষে রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থান রাশিয়ার ওুাবংঃরধ নামক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বের হয়েছিল :

ঠরড়ষবহপব নবমবঃং ারড়ষবহপব ধহফ ভরহফং ংঃঁঢ়রফরঃু. ঋৎববফড়স ড়ভ সরহফ রং হববফবফ ভড়ৎ ঃযব ৎবফবসঢ়ঃরড়হ ড়ভ ঃৎঁঃয, ঃবৎৎড়ৎ যড়ঢ়বষবংংষু শরষষং রঃ. ঞযব নৎঁঃব পধহহড়ঃ ংঁনফঁব ঃযব নৎঁঃব. ওঃ রং ড়হষু ঃযব সধহ যিড় পধহ ফড় রঃ.
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উদগ্র হামলা ও অবিচারের বিরুদ্ধে যেমন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন তেমনি এই অপশক্তির পশ্চাতে দায়ী উগ্রস্বাদেশিকতার ভিত্তিতে তৈরি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিষয়েও তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে লিখিত তাঁর একটি পত্রে বলা হয়েছে :
ও যধাব ংধরফ ড়াবৎ ধহফ ড়াবৎ ধমধরহ ঃযধঃ ঃযব ধমমৎবংংরাব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ হধঃরড়হধষরংস ধহফ রসঢ়বৎরধষরংস, ৎবষরমরড়ঁংষু পঁষঃরাধঃবফ নু সড়ংঃ ড়ভ ঃযব হধঃরড়হং ড়ভ ঃযব বিংঃ, রং ধ সবহধপব ঃড় ঃযব যিড়ষব ড়িৎষফ. (দঝবষবপঃবফ ষবঃঃবৎং’ ৩৩৩)
রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ হবসনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উপর্যুক্ত উক্তির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। হবসনও তাঁর মতই উগ্র জাতীয়তাবাদের ভেতরে সাম্রাজ্যবাদের বাসা লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে : ভারতে ইউরোপীয়দের আগমনের মূলে রয়েছে তাদের রাষ্ট্রিক স্বার্থ। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে শুধুই তাদের নিজস্ব জাতির জন্য ভালবাসা ও তীব্র অহমিকা। নিজ দেশের সমৃদ্ধির জন্যই তারা অন্য দেশে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এজন্য অন্য বিশ্বকে লুণ্ঠন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অন্ধ দেশপ্রেমই তাদেরকে মানবতার কল্যাণের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছে এবং তাদের ভেতরে সুপ্ত ভালবাসা বিকাশের পরিবর্তে অপরিচ্ছন্ন যুক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে উপস্থিত করেছে। রাশিয়ার চিঠিতে লেখেন:
যাই হোক, আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাইনি, অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে তবেই সভ্যতা সমুচ্চে থাকবে এ কথা অনিবার্য বলে মনে করে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে। ... নিরন্ন ভারতবর্ষের অন্নে ইংল্যান্ড পরিপুষ্ট হয়েছে। ইংল্যান্ডের অনেক লোকেরই মনের ভাব এই যে, ইংল্যান্ডকে চিরদিন শোষণ করাই ভারতবর্ষের সার্থকতা। 
ইউরোপীয় ন্যাশলিজমকে আক্রমণ রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের রচনার মধ্যেই আবিষ্কার করা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে অনেক ব্যাপারেই মত বদলিয়েছিলেন, লক্ষণীয় শুধুমাত্র এ-ক্ষেত্রেই তাঁর স্থির রাজনৈতিক ভাষণের ব্যতিক্রম ঘটাননি। আধুনিক বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের এই আক্রমণনীতি সর্বাগ্রেই ঘটেছে যখন রাজনৈতিকভাবে বহির্বিশ্বের অন্য কেউই এর বিরুদ্ধাচারণ করেননি। খেয়া ও নৈবেদ্যের কবিতায় তিনি বিশ শতকের প্রান্তলগ্নে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করেই যুদ্ধ ও রক্তপাতের জন্য ন্যাশনালিজমকেই দায়ী করেছেন। তাঁর কাছে ‘ন্যাশনালিজম’ উত্তেজনাময় নেশার মতো যা চরমপন্থী ও মানুষের আবেগগত ধোঁকা সৃষ্টির জন্য দায়ী উপাদানগুলোর একটি। তাই জাতিগত উন্মত্ততা ও ধর্মীয় উপাদান-এর সবটাই এর মধ্যে নিমজ্জিত। এজন্যই তিনি বলেছেনÑ ‘জাতীয়তাবাদ উগ্রতম নেশা বা মাদক, যাহা মানুষের সমস্ত যুক্তিবাদ ও বোধশক্তিকে অসার করিয়া দেয়। এই ‘জাতীয়তাবাদের মদ’ খাইয়া আজ পাশ্চাত্যেও এক-একটা সমগ্র জাতিকে-জাতি বিবেকবুদ্ধি ভুলিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে হনন করিতে ছুটিয়াছে।’  এজন্যই রবীন্দ্রনাথ একসময় চধঃৎরড়ঃরপ সধহ বা চধৎঃরড়ঃরংস-কে সমর্থন করতে পারছিলেন না; সেটি শ্যভেনিজম বা উগ্র-জাতীয়তাবাদ অর্থে অবশ্যই। ১৯২১ সালের ১৪ জানুয়ারী নিউইয়র্ক থেকে লিখিত একটি পত্রে তিনি বলেন :
ওঃ পধহ হড়ঃ নব ংধরফ ঃযধঃ ও ধস ঁহঃড়ঁপযবফ নু ঃযরং যবধঃ ধহফ সড়াবসবহঃ. ইঁঃ ংড়সবযড়,ি নু সু ঃবসঢ়বৎধসবহঃ ধং ধ ঢ়ড়বঃ, ও ধস রহপধঢ়ধনষব ড়ভ ধ ধপপবঢ়ঃরহম ঃযবংব ড়নলবপঃং ধং ভরহধষ..... সু ংড়ঁষ পৎরবং ড়ঁঃ : ঞযব পড়সঢ়ষবঃব. গধহ সঁংঃ হবাবৎ নু ংধপৎরঃরপবফ ঃড় ঃযব ঢ়ধঃৎরড়ষরপ সধহ, ড়ৎ বাবহ ঃড় ঃযব সবৎবষু সড়ৎধষ সধহ. 
১৯২১-এর ৮ফেব্র“য়ারী অপর একটি পত্রে তিনি লিখেছেন কীভাবে সারা আমেরিকা জুড়ে এশিয়া ও আফ্রিকাবাসীদের উপর অন্যদেশীয় বলে হামলা চালানো হয়েছে। মূলস্রোতের সাদা জনগোষ্ঠীকর্তৃক কালোদেরকে জলন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে শুধু এজন্য যে, তারা রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিক হিসেবে ভোটের অধিকার চেয়েছে। এছাড়াও জার্মানরা শুধু ঘৃণা এবং রাশানরা পুনপুন ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্বমানবতাবাদী মানুষ হবার কারণেই সমস্ত বিশ্ববাসীকে তাদের ভেতরকার স˜গুণ সম্পন্ন মানুষকে জাগাবার আহ্বান করেছিলেন। ঘৃণা-বিদ্বেষ ও মিথ্যার বেসাতি থেকে বেরিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের সাধনাই কেবল কাম্য হতে পারে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যএকথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন। একরৈখিক বিচার না করে তিনি মানবতার মতো বিষয়কেও বহুরৈখিক, ব্যাপক ও বহুদর্শী ব্যাপার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর এই সূক্ষ্মদর্শী মানবতাবাদ ভারতবাসীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যাপৃত গান্ধীজির সত্যাগ্রহ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। গান্ধীজির স্বদেশী আন্দোলন ও স্বরাজলাভের পন্থাকে তিনি জাতীয়তাবাদী উগ্রনীতিরই ছায়া হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অহিংস আন্দোলকে মনে মনে স্বীকৃতি দিলেও সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে তিনি তাই ভারতবাসীদের জন্য সুস্বাস্থ্যকর বিবেচনা করেননি। তাঁর ধারণা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই আবেগপূর্ণ আন্দোলন যতটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াবে ততটাই উপনিষদিক দর্শনের আলোক ফেলতে অক্ষম হবে। উল্টোদিকে মানুষের অন্তরে নিহিত ভালবাসা ও সহিষ্ণুতা কমে যাবে; যা হবে আরো ভয়ানক। ১৯২৩ সালে ফ্রান্স থেকে চার্লস এন্ডরুজের কাছে লিখিত চিঠিতে তিনি বলেন :
নিষ্ঠুর অবিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে যদি আমরা ইউরোপকে সর্বতোভাবে ত্যাগ করতে চাই, তাতে আমরা নিজেদেরই অপমান করি। আমরা কলহও করবনা, প্রতিশোধও নেব না। ক্ষুদ্রতার বদলে কিছুতেই ক্ষুদ্র আচরণ করব না।... শিবম ও অদ্বৈতমের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছি, সেই কারণে দুঃখ ভোগ করছি।... সাত্তিক শক্তিকে তামসিক শক্তিতে পরিণত করা খুবই গর্হিত। (অনুবাদক : মলিনা রায়, রবীন্দ্রনাথ-এন্ডরুজ পত্রাবলী) 

রবীন্দ্রনাথ অন্তরের শক্তিকে জাগ্রত করার বাসনা নিয়েই ভারতবাসীকে তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে বলেছিলেন। তাছাড়া স্বসমাজেই বিদ্যমান জাতিভেদের অভিশাপ বিলুপ্ত করে দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষা ও নারী উন্নয়নের প্রতি নজর দিতে বলেছিলেন। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে পারলেই কেবল ভারতের পক্ষে ব্রিটিশ তাড়ানো কিংবা স্বরাজ-স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করা সহজতর হবে বলে তিনি মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীকে মানুষে মানুষে পারস্পরিক ভালবাসা ও সমন্বয়করণের প্রশ্নে যাবতীয় কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা যুগিয়েছেন। ১৯২০ সালের ১৮সেপ্টেম্বর প্যারিস থেকে লিখিত একটি পত্রে জানা যাচ্ছে :

দেখছি অসহযোগ নিয়ে আমাদের দেশের লোকেরা উগ্রভাবে মেতে উঠেছে। এই আন্দোলনও বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনের মতো একটা কিছু হয়ে দাঁড়াবে। এরকম ভাবে আবেগকে যদি ভারতব্যাপী স্বাধীন প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলার কাজেই বিশেষ করে লাগানো যেত কত ভালো হত।

মহাত্মা গান্ধীই এ কাজে সত্যিকারের অধিনায়ক হোন। বিশেষভাবে দেশসেবার আহ্বান, আত্মত্যাগের আবেদন তিনি জানান। তারই প্লাবনে প্রেম ও সঙ্গে সহযোগের আদেশ যদি তিনি দেন, আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে তাঁর কথা মত কাজ করতে রাজী আছি। ক্রোধের আগুন জে^লে দিয়ে তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেবার কাজে আমার পৌরুষের ক্ষয় কিছুতেই করব না। (অনুবাদক : মলিনা রায়, রবীন্দ্রনাথ-এন্ডরুজ পত্রাবলী)  

গান্ধীজির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অসমর্থনের আরেকটি বড় কারণমানুষের ব্যক্তিগত সীমাহীন অন্ধত্ব সেখানে সাধারণের জীবনপাতের জন্য দায়ী হচ্ছিল। চার্লস এন্ডরুজের কাছে লেখা ১৯২১ সালের ২মার্চের চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেছেন :
অসহযোগের ভাবটি হল রাজনৈতিক উগ্রতপস্যা। আমাদের ছাত্রেরা এই যে আত্মনিবেদন করছে, সেটা কার কাছে? এরূপ অবাস্তবতাকে আমি ভয় করি। এসব ছাত্ররা আমার চোখে নিছক ছায়ামূর্তি নয়। তাদের জীবন যেমন তাদের কাছে তেমনি সর্ব মানবের অধিদেবতার কাছে পরম মূল্যবান। (অনুবাদক : মলিনা রায়, রবীন্দ্রনাথ-এন্ডরুজ পত্রাবলী)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস্তবিক অর্থেই একজন সচেতন ও ইতিবাদী লেখক যিনি তাঁর আদর্শকে কখনোই ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেননি। গান্ধীজির সঙ্গে ভারত স্বাধীনতায় অংশগ্রহণ তাঁর জনপ্রিয়তাকে অনেকখানি উচ্চে তুলে ধরতে পারত, একথা জেনেও তিনি সে পথে যাননি। যাই হোক, স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও স্বদেশের প্রতি তার ভালবাসার কোন কমতি হয়নি। তাঁর সাহিত্যকর্মে, কবিতা ও গানে ভারতীয় ঐতিহ্য ও প্রকৃতির টান গভীরভাবেই অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের সত্যিকারের স্বদেশপ্রেম প্রত্যক্ষ করি যখন তাঁকে আমরা নানা জনহিতকর কর্মে তথা গণউন্নয়নের জন্য স্থাপিত ক্ষুদ্রঋণ চালু করা কিংবা পতিসরে সর্বসাধারণের শিক্ষার জন্য আন্তরিক উদ্যোগ লক্ষ করি। আসলে স্বদেশপ্রেমে অন্ধত্ব রবীন্দ্রনাথে কাম্য নয়। শুষ্ক বুদ্ধি-তর্ক দিয়ে তাঁকে স্পর্শ করা যায় না। তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় আন্তরিক বুদ্ধি দিয়ে।

বিশ্বমুখীন সংস্কৃতি ও মানুষে-মানুষে হার্দিক সংযোগ সাধন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম দর্শন। রবীন্দ্রনাথের ভারত এমন একটি আইডিয়া যা কেবলমাত্র ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। আর এজন্যই তিনি সর্বভারতীয় হয়েও বৈশ্বিক মানুষ। সে-কথা তিনি এস. এস. রিনডমকে লিখিত এক পত্রেই জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কাছে লিখেছেন :

ভারতের প্রতি যখন অবিচার হয় তখন তার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়ানো উচিত। ভারতবাসী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই সেই অন্যায়ের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আমাদের। (অনু . : মলিনা রায়, পূর্বোক্ত)

জগতের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ আপাত উন্নয়নের একটি খতিয়ান রচনা করেছে মাত্ররবীন্দ্রনাথ অন্তত সেটাই বিশ্বাস করতেন। আর এজন্যই তিনি বিভাজনমূলক নীতির পরিবর্তে সর্বমানবতাবাদী উন্নয়নের কথা বলেছেন। পারস্য যাত্রীর মধ্যে ২৫মে ১৯৩২ সালে ইরাকের সম্রাটের প্রতি রবীন্দ্রনাথ একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনুযোগের সুর তুলেই তিনি ইতিহাসের আবর্জনা ফেলে সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীকে গড়ে তুলতে বলেছিলেন। ২০০৩ সালে ইরাকের উপর কিংবা পরবর্তীকালে অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর মার্কিন আক্রমণ নীতির কারণ ব্যাখ্যা করলে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যত দশর্নের সত্যতা প্রমাণিত হয়। পারস্পরিক ঘৃণা, অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতাও মার্কিন আক্রমণ নীতির জন্য দায়ী। রবীন্দ্রনাথ জানতেন : বিশ্বতোমুখিন একটি উদার মানসিক অবস্থা ব্যতিত রাষ্ট্রসমসূহ বারবারই ন্যাশনালিজমের ফাঁদে পা দিবে অথবা নির্মমভাবে উচ্চ-নীচ ভেদযুক্ত প্রভু-দাস কেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠবে। প্রসঙ্গত নোয়াম চমস্কির কথা এখানে উদ্ধৃত করে বলা যায় : দখধৎমব হধঃরড়হং ফড় যিধঃ ঃযবু রিংয, যিরষব ংসধষষ হধঃরড়হং ধপপবঢ়ঃ যিধঃ ঃযব সঁংঃ.’ 

রোমান্টিক ও আদর্শবাদী, আধ্যাত্মিক কিংবা কল্পনাচারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে খারিজ করতে চান অনেকেইসে-কথা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ-কেন্দ্রিক তাঁর সুচিন্তিত বচনগুলো সারাবিশ্বের অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি যেমন হবসন, লেনিন, কিংবা এডওয়ার্ড সাঈদ কথায় কথায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ দ্বারা উন্নত বিশ্ব অপর বিশ্বকে কব্জা করবেএকথা রবীন্দ্রনাথ তো বহু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। জানা যায়, লেনিনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের যে কয়টি বই ছিল কবির ঘধঃরড়হধষরংস বইটি তার অন্যতম। তাছাড়া ন্যাশনালিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত হাল আমলের অনেক উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখকের সঙ্গেও মিলে যায়। টিমথি ব্রেনানের যে ভাষ্য, ন্যাশনালিজমই সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ তৈরিতে ভূমিকা রাখেতা রবীন্দ্রনাথেরও কথা। হোমিভাবা উল্লেখ করেন : ‘ঊঁৎড়ঢ়বধহ হধঃরড়হ ধিং সড়ঃরাধঃবফ নু যিধঃ ঊঁৎড়ঢ়ব ধিং ফড়রহম রহ রঃং ভধৎ-ভষঁহম ফড়সরহরড়হং.’  এছাড়া রেঁনা, ফ্রাঞ্জ ফেনন কিংবা এন্ডারসন সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, ন্যাশনালিজম কোন প্রাকৃতিক সৃষ্টি নয়; এটি নিঃসন্দেহে সামাজিক অবস্থা থেকেই উদ্ভূত এবং যার মধ্যে অবশ্যই-অবশ্যই নৈতিকতার ঘাটতি রয়েছে। কাজেই ‘নেশন’ সভ্যতা গঠনে প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও ইতিহাসে এটা যতটা রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যকে উপহার দিয়েছে, বাস্তবার্থে ততটাই নৈতিক গুণাবলী অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সমালোচকরা মনে করেন, ন্যাশনালিজম একটি ‘অপরত্ব’ তৈরি করার মাধ্যমে অসহিষ্ণুতারই অনুপ্রবেশ ঘটায়, কারণ এর সাংগঠনিক সত্যের ভেতরেই নিহিত আছে বৈষম্য ও আধিপত্যবাদ। আরনেস্ট গেলনার, বেনেডিক্ট এন্ডারসন এবং টম নায়ানের্র মত ব্যক্তিবর্গও জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, অযৌক্তিক ও অসঙ্গত আচরণ এবং নানা ধরনের বিশৃঙ্খলার জন্য ঘধঃরড়হধষরংস-কে দায়ী করেছেন। আনিয়া লুম্বাও তাঁর ঈড়ষড়হরধষরংস/চড়ংঃপড়ষড়হরধষরংস নামক গ্রন্থে বলেছেন কীভাবে ঘধঃরড়হ নানা ধরনের সমস্যা তৈরির জন্য দায়ী :

চবৎযধঢ়ং ঃযব পড়হহবপঃরড়হ নবঃবিবহ ঢ়ড়ংঃপড়ষড়হরধষ ৎিরঃরহম ধহফ ঃযব হধঃরড়হ পধহ নব নবঃঃবৎ পড়সঢ়ৎবযবহফবফ নু ঁহফবৎংঃধহফরহম ঃযধঃ ঃযব দহধঃরড়হ’ রঃংবষভ রং ধ মৎড়ঁহফ ড়ভ ফরংঢ়ঁঃব ধহফ ফবনধঃব, ধ ংরঃব ভড়ৎ ঃযব পড়সঢ়বঃরহম রসধমরহরহমং ড়ভ ফরভভবৎবহঃ রফবড়ষড়মরপধষ ধহফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ রহঃবৎবংঃং. 

লীলা গান্ধী মনে করেন ঘধঃরড়হধষরঃরংস-ই পারস্পরিক ঘৃণা ও জাতিগত বিদ্বেষের মূলে এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মূলে কার্যকরী উপাদান। তিনি বলেন : ‘পূর্ব ও পশ্চিম বিশ্ব উভয়ই আজ আমরা উগ্র স্বাদেশিকতা, বর্ণবাদ ও বিচ্ছিন্নকরণের ব্যাপারে অবগত। জাতীয়তাবাদ বর্তমান বিশ্বে ক্রোয়েশীয়-সার্বিয়, গ্রিক-মেসিডোনিয়ান, এস্তোনিয়ান-রাশিয়ান, স্লোভাক-চেক, আর্মেনিয়-আজারবাইজানিস, ইসরায়েলি-প্যালেস্টিনিয়, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি বহুবর্ণিল জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও অসহিংষ্ণুতা সৃষ্টির জন্য দায়ী।’ 

উপর্যুক্ত যুক্তি বর্তমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক   চিন্তা-চেতনাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সাম্রাজ্যবাদ ও ন্যাশনালিজম উভয়ই রবীন্দ্র-দৃষ্টিতে ধ্বংসাত্মক উপাদান। তিনি মনে করেন, মানুষের সদিচ্ছা ও আত্মশক্তির নিয়ন্ত্রণই পারে একটি বিশ্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বিংশ শতাব্দীর বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের গণহত্যা জাতীয়-উগ্রস্বার্থের কারণেই কেবল সম্ভব হয়েছিল। এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়ে বর্তমানকালে আমরা আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ভেতর অবস্থান করছি। চমস্কির ভাষায় উবসড়পৎধপু নয় চড়ষুধৎপযু-র মধ্যে আমাদের বসবাস। পল হার্স্ট (চধঁষ ঐরৎংঃ) নামক একজন সমাজতাত্ত্বিক দডধৎ রহ ঃযব ২১ংঃ ঈবহঃঁৎু’-তে যা বলেন তাতে স্পষ্ট হয় যে, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির জটিল অবস্থা কিছু সংখ্যক পরমাণুযুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি আরো মনে করেন : ‘বিশ্বমানবতার ক্ষেত্রে চরম হুমকি এই সব অবস্থা থেকে বের হয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্বের হাতবাড়ানোর কাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথ অনুসরণ করা যেতে পারে।’ 

কাজেই রবীন্দ্রনাথকে নরম সুরের ভাববিগ্রহের সাহিত্যিক বলে অভিযুক্ত করাটা কতটা সমীচীন হবে তা পাঠকই বিচার করবেন। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে সাময়িক উত্তেজনার বশ হতে বলেননি কখনো। তিনি চেয়েছিলেন বিশাল ও বিরাটভাবে উপলব্ধির এক মহাজীবন। হঠাৎ প্রচণ্ডতা বা উচ্চণ্ডতার বিপক্ষে ছিল তাঁর মন-মনন। অন্যদিকে দার্শনিক অভিব্যক্তি বিহীন জীবন কেবল শূন্য কলসীর মত বাজে। তাতে আওয়াজ হয় ভাল, শোনাও যায় দূর থেকে। তাতে মনে হয়, এই বুঝি পেলাম শ্রেষ্ঠতর জীবনোপায়। রবীন্দ্রনাথ ধ্যানী-ঋষি-দার্শনিক কিন্তু সমাজ-সংসার বিবিক্ত সন্ন্যাসী নন মোটেই। একমাত্র গভীর অনুধাবনই রবীন্দ্র-দর্শন দ্বারা পরিশ্র”ত করতে পারে যে-কাউকে। রবীন্দ্রনাথকে আমি অস্বীকার করলে নিজেই সংশয়ী হইকই কোন তত্ত্ব-নীতিই তো পৃথিবীকে শান্তির অমরাবতী করে তুলছে না! তাই বাস্তব অর্থেই রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধন, আত্মশক্তির আবিষ্কার, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ, সংহতি ও ঐক্যের মধ্যেই বিশ্বমানবতার কল্যাণ নিহিত একথা স্বীকার করা এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গীতাঞ্জলির প্রিয় ভাষ্য, ‘অন্তর মম বিকশিত কর/ অন্তরতর হে।/ নির্মল করো, উজ্জ্বল করো/ সুন্দর করো হে।’এই নির্মল অন্তর আর সুন্দরের বাসনাই হয়ত আগামী পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে পারবে; নচেৎ লোভের বাণিজ্য-বেসাতি আর ক্রোধের আণবিক আঘাতই হবে আমাদের সকলের নিয়তি।











মিথুন ব্যানার্জী
দুঃসময়-এর চিহ্নপাঠ

_______________________________________________________

আধুনিক সাহিত্য-সমালোচনা রীতিতে আন্তঃশাস্ত্রীয় জ্ঞানের প্রয়োগ বহুলচর্চিত। সাহিত্য বিশ্লেষণে তাই চিহ্নবিজ্ঞানের (ংবসরড়ঃরপং) প্রয়োগও সবিশেষ প্রাসঙ্গিক। উল্লিখিত জ্ঞান-শৃঙ্খলার কেন্দ্রীয় ভিত্তি এই প্রতীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, বিশ্বনিখিলের সব কিছুই চিহ্ন-ব্যবস্থার (ংরমহ-ংুংঃবস) অন্তর্গত। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে কবিতার শিল্পরূপ বিবেচনায়ও রয়েছে চিহ্নের বর্ণিল ও বহুমাত্রিক প্রয়োগ। আমরা জানি, কবিতায় প্রকাশিত হয় কবির আত্মজাত উপলব্ধি, সুসংহত জীবনবোধের শিল্পিত ভাষ্য। মনে রাখা প্রয়োজন যে, কবিতায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে কবি নিজেকে উন্মোচন করেন। আর এই পরিসরের স্বল্পতার কারণেই কবি তাঁর প্রকাশিতব্য বোধকে করে তোলেন স্তরবহুল দ্যোতনার অভিসারী। প্রায়ই অনেক কথা তিনি বলে চলেন কোনো কথা না বলে। আর এমন করে কথা বলতে হলে স্তরবহুল চিহ্নপুঞ্জ সৃজনের কোনো বিকল্প থাকে না। এ কারণেই কবিতায় চিহ্নের অনুসন্ধান একইসঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ব্যতিক্রমধর্মী, এমনকি অনিবার্য বললেও খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। বর্তমান আলোচনায় আমরা চিহ্নবিজ্ঞানের আলোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনা কাব্যের অন্তর্গত “দুঃসময়” কবিতাটির নিবিড়-পাঠে ব্রতী হব।

“দুঃসময়” কবিতাটি অবিহিত কালের বিপদ-আতঙ্কে দীর্ণ; আবার একইসঙ্গে কালবেলাকে অতিক্রম করবার অমিত বিশ্বাসে ঋদ্ধ। কবিতাটির ডিসর্কোস প্রকৃতির এক সন্ধি-সময় সন্ধ্যাকে ধারণ করে আছে। আঁধার এবং আলোর মিলনের এই ক্ষণে কবির শঙ্কা আর সাহস হাত ধরে এগিয়ে চলে। অনিকেত এই চলার পথে সঙ্গীহীন কবির বন্ধু হয়ে আবির্ভূত হয়েছে একটি পাখি। কবির সঙ্গে একীভূত হয়ে কবিতাটির কেন্দ্রে অবস্থান করছে এই ‘পাখি’ চিহ্নটি; যাকে তিনি ‘বিহঙ্গ’ নামে সম্বোধন করেছেন বারংবার। পাখিকে ঘিরেই কবির আকুলতা; তাকে অবলম্বন করেই তাঁর আশাবাদ। দুঃসময়ের এই কালে পাখিই কবির সকল জীবন-প্রেরণার উৎস; হয়তো তাঁর পরমকাক্সিক্ষত জীবনদেবতা-ও। ভারতীয় সাহিত্যধারায়, আদিকবি বাল্মীকি যেমন পাখির বেদনায় আপ্লুত হয়ে মহিমান্বিত শ্লোক সৃষ্টিতে নিমগ্ন হয়েছিলেন, তেমনি কবিও পাখিকেই আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর অসময়ের কাহন উপস্থাপনের শিল্পকৌশল হিসেবে। এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন হবে। তবে, যে কথা না বললেই নয়: পাখিকে ঘিরেই কবি তাঁর শিল্পকথনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন আপনতর বীক্ষণে; চিহ্নের বিনিসুতায়। চিহ্নবিজ্ঞানের রীতি অনুসরণ করে বলা যায় যে, ‘পাখি’ই কবিতাটির চিহ্নমণ্ডলের কেন্দ্রীয় শক্তি; যার সূত্র ধরে এর  চিহ্ন-পাঠে যোজিত হয়েছে নতুন মাত্রা। কবির সন্ধ্যা পরিণত হয়েছে দুঃসময়ব্যাপ্ত জীবন-কাব্যে; শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে সুসময়ের প্রত্যাশা।

২.
কল্পনা কাব্যের অন্যান্য কবিতার যে প্রেক্ষাপট আমরা দেখতে পাই তাতে বিচিত্র বিষয়ের সঙ্গে বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, ফেলে আসা ভারতবর্ষকে রোমান্টিকতার নবদীপ্তিতে ফিরে দেখা; অপ্রাপনীয়কে অতীতচারী আবহে এক মুহূর্তের জন্য হলেও পাওয়া যায় কি না তা পরখ করবার আকাক্সক্ষা। তাই এই কাব্যে আমরা পেয়েছি মগ্নস্মৃতির পুনরুত্থান-প্রত্যাশী এক কবিকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যক্তিক নির্জ্ঞান-কাঠামোকে সামূহিক ব্যাপ্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে নান্দনিক ও রসঘন করে সচেতন স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন এই কাব্যে। এই সামান্য বৈশিষ্ট্যটি “দুঃসময়” কবিতায় সংগুপ্ত; খানিকটা অনুপস্থিতও বটে। আলোচ্য কবিতায় আমরা কবিকে পাই শঙ্কাগ্রস্তের মতো; এখানে কবি শঙ্কিত আলোকে সন্ধ্যার আঁধারে পথ চলেন। দুঃসময়-আবৃত জগৎ আর সেই জগতের সমান্তরালে প্রবাহিত সময়ের তীক্ষèতা স্পর্শ করে কবিকে। আবার সমাজ-সচেতন শিল্পীর মতই বৈশ্বিক-সংকটও ভাবিয়ে তোলে তাঁকে। তাইতো কবি অন্তর দিয়ে অনুভব করেন ক্রান্তিলগ্নকে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, রবীন্দ্রনাথ এক অনিঃশেষ আশাবাদকেই আমৃত্যু লালন করে গেছেন। আর তাই সর্বপ্লাবী দুঃসময়কেও পার করবার অভিযান পরিচালনায় তিনি প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। সভ্যতার সংকট, মানবতার সংকট কবিকে যেন আরও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। যখন সব শেষ হয়ে চরম তমসা শুরু হয় তখনও কবি ক্ষীণশশীকে দেখেন এবং আশান্বিত হন। সোনার তরী ও চৈতালি রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ প্রমত্তা পদ্মার উচ্ছ্বাসদীপ্ত জীবন দেখে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। কল্পনা-তে তিনি চলে গেলেন রেবা-শিপ্রার তটে, কালিদাসের কালে। পুরনো আলোয় তিনি আবারও উদ্দীপিত হলেন; নস্টালজিয়াকে তিনি মিলিয়ে দিলেন নতুন কালের সাম্প্রতিকতার সঙ্গে। তাই ভিতরে ভিতরে গোটা পৃথিবী জুড়ে একটা পরিবর্তন যে ঘটতে চলেছে সেটাকে কেমন করে যেন তিনি নিজের অনুভবের অংশ করে নিলেন! আর এরই প্রকাশ ঘটল “দুঃসময়” কবিতায়। এই রচনার আলোকে অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য নয় যে, সমকাল নিয়ে কবি যেমন করে সচেতন ছিলেন, তেমনি সমকালের-সংকটও হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন তিনি। এই সংকট তাঁকে মর্মাহত করত, বিচলিত করত; এই সংকট উত্তরণের চেষ্টায় তিনি ব্যাকুল হতেন। থেমে থাকা মানে সংকটকে মেনে নেওয়া, তাই রথের রশি আঁকড়ে ধরে তিনি অবিরাম ছুটে চলার ব্রত নিলেন। এই কারণেই সবকিছুর পরও কবি বলতে পারেন ‘ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা’।

৩.
সাহিত্যে ব্যক্তিগত গণ্ডি একীভূত হয় সমগ্রের সঙ্গে। পাঠকের আগ্রহে এবং পাঠসূত্রে সাহিত্যের ব্যক্তিমানব পরিণত হয় সমগ্রের অংশে। আর এরই পরম্পরায় সাহিত্যিকের অনুভব দ্যোতিত হয়ে সৃজিত হয় পাঠকৃতি (ঃবীঃ)। এই পাঠকৃতির অন্তস্তলে সক্রিয় থাকে ¯্রষ্টার নিবিড় বীক্ষণ, যা তিনি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। সাহিত্যিকের এই অন্বিষ্ট ডিসকোর্স কখনও সরাসরি উপস্থাপিত হয় আবার কখনও প্রতীকের অন্তরালে পাঠককে নিয়ে যায় অন্য এক কুহক-বিশ্বে। আর এই প্রতীকের আবরণ উন্মোচন করে পাঠককে ‘পাঠে’ শামিল করতে আগ্রহী করে চিহ্নবিজ্ঞান। সংগঠনবাদী সমালোচনা পদ্ধতির অন্যতম আলোচ্য চিহ্নবিজ্ঞান। সাধারণত চিহ্ন গঠিত হয় দ্যোতক (ংরমহরভরবৎ) ও দ্যোতিতের (ংরমহরভরবফ) সমন্বয়ে। দ্যোতক হলো কোনো চিহ্নের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অন্বয়। যেমন : ‘দুঃসময়’ শব্দটি দুঃ-স-ম-য় এর যে বর্ণভিত্তিক চিত্রাত্মক উপস্থাপন, তা-ই হলো এর দ্যোতক। আর দ্যোতিত হলো এই শব্দচিত্রের গভীরে প্রোথিত বিমূর্ত উপলব্ধি। এখানে ‘দুঃসময়’ কোনো বিশেষ সময়ের দ্যোতক হতে পারে আবার হতে পারে মানব সভ্যতার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাতের আসন্নতা। আবার এই দুয়ের মধ্যকার সর্ম্পক নির্ভর করে ঔপাদানিক বা প্যারাডিগম্যাটিক এবং সজ্জাগত বা সিনট্যাগম্যাটিক সর্ম্পকের ওপর। চিহ্ন গঠনকারী উপাদানসমূহ কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে যে অর্থ প্রকাশ করবে, অন্য একটি বিন্যাসে তা থেকে আলাদা অর্থ প্রকাশ করবে। যেমন : ‘ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/ এখনি অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা’। এখানে ধ্বনির বিন্যাস, শব্দের পৌনঃপুনিকতা এবং চিত্রময় বোধের গভীরতা একদিকে এর প্যারাডিগম্যাটিক অভিনবত্বকে প্রকাশ করে; অপরদিকে এর সিনট্যাগম্যাটিক গীতলতাকে দ্যোতিত করে। ধ্বনির বিন্যাস পাল্টে গেলে কিংবা শব্দ পরিবর্তন করে দিলে এই দ্যোতনাও ভিন্ন হতো। আবার কবিতার পুরো শরীর জুড়ে বারংবার এই স্তবকটি ফিরে আসাও কেন্দ্রীয়ভাবে চিহ্নটির নিগূঢ় দ্যোতনা সঞ্চারের সম্ভাবনাকে পাঠকের নিকট জাগিয়ে তোলে। এতে করে শব্দ ও অর্থের মধ্যে তৈরি হয় অভূতপূর্ব সমন্বয়। কবিতার বর্ণস্তরে দৃশ্যত কবি যা বলেন এবং কবিতার না-বলা বাণীতে যা ব্যঞ্জনাপ্রাপ্ত হয় তা মূলত চিহ্নটির হয়ে ওঠার শক্তি জোগায়। এই কাঠামোটিকে বিবেচনায় রেখে আমরা পুনরায় ফিরে যাই “দুঃসময়” কবিতার কেন্দ্রীয় চিহ্ন ‘পাখি’ এবং ‘সন্ধ্যা’ বিষয়ক আলোচনায়। সাহিত্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন চিহ্নের প্রয়োগিক-তাৎপর্যকে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন নান্দনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠকের নিবিড় সংবীক্ষণ। চিহ্নবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ কাঠামোয় একটি কবিতায় ব্যবহৃত উপমা-চিত্রকল্পের প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব চিহ্ন-বার্তা। আবার প্রতিটি চিহ্ন-ই নিজস্বতা বজায় রেখে সামগ্রিকভাবে যে চিহ্নের সমাবেশ তৈরি করে তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে কবিতার চিহ্নবিশ্ব (ংবসরড়ংঢ়যধৎব)। বিশিষ্ট চিহ্নতাত্ত্বিক ইউরি লটমানের সাহায্য নিয়ে আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা চলে যে, পরস্পর-সম্পর্কিত প্রতিবেশে একগুচ্ছ চিহ্ন যখন মিলিতভাবে অভিন্ন কোনো দ্যোতনার জন্ম দেয় তখনই চিহ্নবিশ্ব রূপলাভ করে। আগেই বলা হয়েছে যে, আলোচ্য কবিতাটি এক বিরূপ কালখণ্ডের শঙ্কা-দোলায় দুলে ওঠা অনুভবের দ্যোতনাসঞ্চারী শিল্পাবয়ব। আর এই দ্যোতনায় সমন্বিত হয় ‘পাখি’ আর ‘সন্ধ্যা’-চিহ্ন। কবি তাঁর বিহঙ্গ-বন্ধুকে সাথে নিয়ে আসন্ন ভয়াল বিভাবরী পেরোতে চান--এ কেবল কবির প্রত্যাশা নয়; কবি যেন অনন্যোপায়। এক অমোঘ গতিপথে কবি ক্রম-অগ্রসরমান হন। এই গতিপথেরই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে ‘সন্ধ্যা’ :

        যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ-মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
        যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া           

সন্ধ্যার প্রতিবেশে যখন বিহঙ্গ কবিতার মূল আবেদনকে জাগিয়ে তুলে কবির জীবনবাদী চেতনাকে অবিষ্কার করে, তখন তাকে ঘিরেই তৈরি হয় দুঃসময়ের চিহ্নবলয়। কারো ইঙ্গিতে যখন সংগীত থেমে যায়, দেহ যখন ক্লান্তিতে ক্লিষ্ট, তখনও অন্ধ পাখিকে পাখা না বন্ধ করবার অনুরোধ জানান কবি। যেন তার ডানায় ভর করে দুঃসময়কে পার করতে তিনি বদ্ধপরিকর। এই পাখিই তখন জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। কবির কাছে কোনো ‘আশ্রয়শাখা’ নেই, নেই কোনো ‘কুন্দকুসুমরঞ্জিত কুঞ্জ’। এই না-থাকা পাখিকে যেন আরও সংগ্রামী, আরও জীবনবাদী করে তোলে। ‘কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা!’Ñএই আকুতিমাখা উচ্চারণে তাই হতাশা-আচ্ছন্ন দীর্ঘশ্বাসের বদলে ক্রমশ অনিবার্য প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার সাহস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি যেন তাঁর মতো করে পাখিকে নিজের অমসৃণ পথের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একে তো আশ্রয় নেই তাতে আবার ‘সুচির শর্বরী’। যদিও কবি জানেন, এখনই এই দুঃসময় পেরোবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তবুও বিকাশোন্মুখ ক্ষীণ চাঁদ কবির হৃদয়ে আশার দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখে :

সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি,
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা

পাখি যাতে আঁধারেও পথ চিনতে পারে তার জন্য তারারা অঙ্গুলি সংকেত দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ এই দুঃসময়েও প্রকৃতির সাহায্য লাভের প্রত্যাশা থেকে বিশ্বাস হারান না। নিসর্গকে যে আস্থায় তিনি তাঁর রোমান্টিক চেতনায় আত্মস্থ করেছিলেন সেই নির্ভরতাকে তিনি শত দুর্যোগেও বিচলিত হতে দেন না। তাই ‘পাখি’ চিহ্নটি প্রকৃতির বরাভয় প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে এর চিহ্নায়নকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদানের পথে এগিয়ে যায়। যদিও নিচেই গভীর মরণ সহ¯্র ¯্রােতে তার দিকে ধেয়ে আসছে, তারপরও পাখির থেমে যাওয়া চলবে না এমন অটুট বিশ্বাস কেবল কবিকে নয় এই কবিতার পাঠকবৃন্দকেও গভীরভাবে উদ্দীপিত করে। এই যে অবিরাম উড়ে চলা, এ যতটা পাখির নিজের জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি বহুদূর তীরে যারা অঞ্জলি বেঁধে ডাকছে তাদের জন্য। তাদের সেই সকরুণ আহ্বানে পাখিকে সাড়া দিতেই হবে; অন্বিষ্ট সূর্যালোক পাখিকে স্পর্শ করতেই হবে। একটা বিষয় এই প্রসঙ্গে আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। কবিতাটি যখন লেখা হচ্ছে, বিশ শতক তখন আগতপ্রায়। বিবিক্ত ব্যক্তিআত্মার হাহাকার যে শতকের অমোঘ লক্ষণ, সেই শতকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবি যূথচিন্তাকে কেবল লালনই করেন না, সমষ্টিবদ্ধ হবার অভিযানে নিয়োজিত হন। অনিঃশেষ মঙ্গলচেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি হয়তো এভাবেই সমাহত ব্যক্তিমনের শুশ্রƒষায় এগিয়ে আসেন : 

                  বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি,
এসো এসো সুরে করুণ মিনতিমাখা
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।   

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবির স্বোপার্জিত মানবিক বোধ ‘পাখি’র চিহ্নস্বভাবকেও প্রভাবিত করে। কবি বিশ্বাস করেন, সবার প্রতিভূ হয়ে আর্বিভূত হওয়া পাখিকে নির্বিকার হতে হবে। তাকে যেতে হবে ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’ স্তরে। এমনকি কবি পাখিকে বলছেন ‘ওরে ভাষা নেই’। অর্থাৎ, পাখির জন্য প্রস্তুতকৃত কোনো ভাষা নেই, যা আছে তা সবই দুর্বলের ভাষা; সান্ত ¦নার ভাষা। নেই বলেই তো নতুন করে সৃষ্টি হবে ভাষা; পাখি তৈরি করবে আশার ভাষা, আগামীর ভাষা। এই সম্ভাবনা আর সামর্থ্যরে মেলবন্ধনে ‘পাখি’ চিহ্নটি ক্রমশ পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। চিহ্নটির অবিচ্ছেদ্য দ্যোতক হয়ে এর সঙ্গে জৈব-সম্বন্ধ গড়ে ‘পাখা’ শব্দবন্ধটি। আর তাই পাঠকের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অনেক কিছু না থাকার পরও পাখির পাখা আছে; যে পাখার উড়ে যাবার নিজস্ব ছন্দ আছে, যে ছন্দ পাখিকে প্রত্যাশার ভাষা দেয় জীবনের আয়োজনে। তাইতো তাকে ঘিরেই স্বপ্ন, নতুন দিনের, নতুন ভোরের স্বপ্ন। এই স্বপ্নে দিয়েই কবি দুঃসময়কে পার করতে চান।


৪.
“দুঃসময়” কবিতায় চিহ্নের বহুমাত্রিকতায় পাখির আত্মপ্রতিষ্ঠা; যা হয়ে উঠেছে সময়ের আনুগত্য মেনে নেওয়া মানবাত্মার প্রতিষ্ঠা-প্রত্যাশার দ্যোতক। ‘পাখি’ চিহ্নের মুখোমুখি কবি বসিয়ে দিয়েছেন ‘সন্ধ্যা’ চিহ্নটিকে। বলা যেতে পারে, ‘পাখি’ এবং ‘সন্ধ্যা’ চিহ্নদুটির যুগল-বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই কবিতাটির কেন্দ্রীয় তাৎপর্য রূপায়িত হয়েছে। ‘পাখি’ চিহ্নটিতে অনেকগুলো দ্যোতিত একসঙ্গে সারি বেঁধে এর পূর্ণাঙ্গ চিহ্নায়ন সম্পন্ন করেছে। এখানে একগুচ্ছ প্যারাডাইম অভিন্ন লক্ষ্যে সমন্বিত হয়েছে; যেমন: নীড়, আশ্রয়শাখা, পাখা, ওড়ার ছবি, মহাকাশের অঙ্গন। এই প্যারাডাইমগুলো নির্দিষ্ট সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছে চিহ্নটির বিন্যাস তথা এক নিñিদ্র সিনট্যাগম্যাটিক সম্পর্ক। প্যারাডাইমগুলো শব্দ ও অর্থের মধ্যে দ্যোতনার ভিন্নতা তৈরি করে; যাতে করে চিহ্নেও যুক্ত হয় স্তরবহুল সংজ্ঞাপন-সামর্থ্য। চিহ্নবিজ্ঞানী চার্লস স্যান্ডার্স পার্স যে তিন ধরনের চিহ্নের কথা বলেছেন-অর্থাৎ : ক) চিত্রাশ্রয়ী (ওপড়হরপ), খ) সূচকীয় (ওহফবীরপধষ) এবং গ) প্রতীকী (ঝুসনড়ষরপ)- তাদের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে বলা যায় যে, আলোচ্য কবিতায় ‘পাখি’ কিংবা ‘সন্ধ্যা’ চিহ্নদ্বয় শব্দগতভাবে নিজেদের গণ্ডিকে বহুদূর পেরিয়ে যায়, না-বলা অনেক কিছুকে সংকেতায়িত করে প্রতীকী হয়ে ওঠে। চিহ্নগুলো যেসব প্যারাডাইম-সহযোগে গঠিত তারা নিজেদের মধ্যে এমন এক নান্দনিক বিন্যাস রচনা করে যে তাদের সিনট্যাগম্যাটিক সম্পর্কে সংযোজিত হয় বহুস্তরবিশিষ্ট গভীরতর অর্থব্যঞ্জনা। ফলে বাচ্যার্থ এখানে গৌণ হয়ে পড়ে। পাখি যদি মুক্তির প্রতীক হয়; তার পাখা হলো সেই মুক্তির উপায় বা মুক্তির পথ, তার একান্ত সহায়। এর সাহায্যেই তার মুক্তি ঘটবে।

কবি এই কবিতায় একটি বিরূপ কালকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কবি নিজে এই কালের কাছে সমর্পিত হচ্ছেন না। কালের সঙ্গে সমঝোতা না করে কবি কালোত্তীর্ণ হতে প্রতিজ্ঞ। কবি-সত্তাকে পাখি কালান্তরের গান শোনায়। এই পাখিকে কেন্দ্র করেই কবি তাঁর অনির্বাণ বিশ্বাস-প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন। এই আলোকেরই স্পর্শে পাখির অন্ধত্ব মোচন হবে। এখন প্রশ্ন ওঠে, পাখির এই অন্ধত্ব কি কোনো দৈহিক প্রতিবন্ধকতা নাকি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আমরা কি কখনও আলো-তে দেখি নাকি আলো-কে দেখি? কখনও সরাসরি কিংবা বস্তুতে প্রতিফলিত অবস্থায়! এইসব দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর পেতেই কবি সন্ধ্যার ধূ¤্রজাল পেরিয়ে তাঁর পাখিকে আলোকসমৃদ্ধ করতে চান। জ্ঞান-জ্যোতি দিয়ে তিনি পাখির দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে আগ্রহী। পাখি দেখতে চায় বলেই তার আলোর তৃষ্ণা এত প্রবল। আবার কবি এখানে বলছেন, পাখির ভাষা নেই। প্রসঙ্গত কল্পনা কাব্যে অন্য আরেকটি কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। “স্বপ্ন” কবিতায় আমরা দেখি স্বয়ং কবি ভাষাহীন হয়ে তাঁর পূর্বজন্মের প্রথম প্রিয়ার সঙ্গে সংজ্ঞাপনে সক্ষম হতে পারছেন না। অবর্ণনীয় কষ্টে কবিকে বলতে হয় ‘সে ভাষা ভুলিয়া গিয়াছি, নাম দোঁহাকার’। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি, কবি সংজ্ঞাপন-ব্যর্থ হলেও অপূর্ব বস্তু নির্মাণক্ষমতায় নিজেকে তিনি ছড়িয়ে দেন, ভরিয়ে রাখেন তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ সৃষ্টির জগৎ। তিনি হয়ত এ-ও জানেন এই প্রজ্ঞাই তাঁর অস্তিত্ব বিনির্মাণকারী। এই প্রজ্ঞা দিয়েই দুঃসময়ের দীর্ঘ প্রহরের ইতি ঘটবে। আর তা ঘটাবে কবির সৃষ্টির বার্তাবাহী সেই পাখি। আমাদের জানা আছে, ব্যাধের তীরের আঘাতে মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর ক্রৌঞ্চকে ঘিরে তার নারী-সঙ্গীর যে সকরুণ বিলাপ, তাতে ব্যথিত হয়েছিল রতœাকর দস্যুর অন্তর। ব্যথিত দস্যুর স্বয়ংক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ লাভ করেছিল মহৎ কাব্যের শিল্পগুণ। সামাজিকভাবে নিগৃহীত, আপাতদৃষ্টিতে মনুষ্যত্ববোধ বিবর্জিত বলে পরিচিত যে মানুষটি, সেও কি-না পাখির বিরহ-ক্রন্দনে সংবেদনশীল হয়ে দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে রচনা করেছেন কবিতা। এই অলোকসামান্য পুরাণ-কথা রবীন্দ্রনাথকে যে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল, তার প্রমাণ মেলে কবির বাল্মীকি প্রতিভা শীর্ষক কাব্যনাটক রচনার মধ্য দিয়ে। বাল্মীকির সেই ক্রৌঞ্চর বেদনাপ্লুত প্রেরণাও আলোচ্য কবিতার ‘পাখি’ প্রতীকের মাঝে ধরা দিয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের দুঃসময়ের যে বিহঙ্গ, সে-ও যেন ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির বার্তা ঘোষণা করছে। এই বার্তা রবীন্দ্রনাথের কালেও যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল, তেমনি আজও এর যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। পৃথিবী যখন বিশ্বায়নের তক্মা এঁটে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতার দিকে ধাবমান তখন পাখিই শোনাতে পারে উত্তরণের বাণী। ধরিত্রীর শূন্য বুকে আনতে পারে কলকাকলিময় ধ্বনি।


কবি জীবনের উপাসক; মৃত্যুর মধ্য দিয়েও কবি নতুন জীবনকে আবাহন করেন। তাই মনে হয়, কবির বিহঙ্গের অবয়বসীমায় সমন্বিত হয়েছে ফিনিক্স তথা আগুনপাখির পুরাণ। এই আগুনপাখি নিজের ছাই থেকে বারংবার জন্ম নেয়; তার এই পুনঃপুনঃ জন্মই যেন পরিবেশন করে অনিশেষ জীবনের সাতকাহন। কবির সকল আকুতি তাই পাখির কাছে তথা জীবনপাখির কাছে। মিথের শক্তিতে ফিনিক্স পাখি যেমন গ্রিক, চৈনিক, মিশরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যীয় এমনকি আমেরিকান আদিবাসীদের পুরাণে নানা মাত্রায় স্থান লাভ করেছে, তেমনি কবির বিহঙ্গও চিরকালীন বিশ্বজনীন মানবমুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। কবি জানেন, এই অপরিসীম শঙ্কাদীর্ণ ভবিষ্যতের একমাত্র আশার স্থল হচ্ছে পাখি। তাইতো লালনের পাখির পায়ে মনোবেড়ি পরানোর মতো কবিও হৃদয় দিয়ে পাখির সঙ্গে একাত্ম হতে চান। আবু সয়ীদ আইয়ুব ভেবেছিলেন যে, কবি তাঁর ক্লান্ত দুটি ডানায় পৃথিবীর বিষণœ অবসাদকে যেন টেনে নিয়েছেন। আমরা মনে করি, অবসাদ টেনে নেওয়াতে কবির সামর্থ্যরে শেষ নয়, বরং আপন কবি-সত্তাকে বিহঙ্গ-সত্তায় মিশিয়ে দিয়ে অবসাদের সমুদ্র পেরোনোতেই কবির আগ্রহ। তাই বিহঙ্গকে কবির নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। বিহঙ্গ আর কবি অভিন্ন বিন্দুতে সমপতিত হয়েছে। তাই মনে হয়, এই যে বারংবার কবি যাকে গতির পানে ছুটে চলার কথা বলছেন, সে-ও হয়তো নিজের সঙ্গেই নিজের কথা বলা।    

“দুঃসময়” কবিতাটিতে আমরা এই বোধ আর বিশ্বাসকে চিহ্নের কাঠামোয় একত্র হতে দেখি। তাই কবিতাটির পাঠ হয়ে ওঠে এক নান্দনিক চিহ্ন-অভিযান। “দুঃসময়ে”র চিহ্নায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শব্দ হয়ে উঠেছে প্রতীক। আমাদের চেনা শব্দগুলো যখন পূর্বের অবয়ব ভেঙ্গে নতুন দ্যোতিত নিয়ে আসে, তখন তথ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সংকেত। পরিচিত জগৎ থেকে জন্ম নেয় নিবিড় শিল্প-প্রতিবেদন; যে প্রতিবেদনের অংশ হয় আমাদের চেতনা। আমরা উদ্ভাসিত হই মঙ্গলালোকে, উত্তীর্ণ হই চিরনবীন নান্দনিকতায়।















জফির সেতু
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গীতাঞ্জলি
______________________________________

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একটা মুশকিলে পড়তে হয়, সেটা হলো কোন রবীন্দ্রনাথ? সত্যিইতো কোন রবীন্দ্রনাথ? এক রবীন্দ্রনাথের ভেতরে যে বহু রবীন্দ্রনাথের বসবাস, এটা কে না জানে? আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠিক অন্য কারো মতো নন, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথেরই মতো। রবীন্দ্রনাথকে দেখলে বোঝা যায় সাধারণ মানুষের বোধ ও চেতনার স্তর কতদূর পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব। রুচির পরিবর্তন-পরিশীলন, জীবনচর্চার পরিমিতিবোধ, নন্দনবুদ্ধির সার্বক্ষণিক স্বতঃউৎসারণ তার মনন-কল্পনাকে যে তারে বেঁধে দিয়েছিল তা আলৌকিক নয়, একান্তই লোকসম্ভব, কিন্তু সাধনাসাপেক্ষ নিশ্চয়ই। যে-মানুষ কবিতা ও গান লিখেন, একাধারে নাট্যকার ও অভিনেতা, গানে সুরারোপ করে নিজেই গান-এমন ক্ষ্যাপা বাউলের পক্ষে পঞ্চেন্দ্রিয়-নির্ভরতা আবশ্যিক শর্ত হয়ে দেখা দেওয়ার কথা এবং তা হলে মানতেই হয় রবীন্দ্রনাথের ও ইন্দ্রিয়ের ধারণক্ষমতা গ্যেটে বা টলস্টয়ের মাপেরই ছিল। অথচ তাঁর জীবনযাপনে যে শুদ্ধতার আভা ছড়িয়ে থাকে সেখানে মৃত্তিকা-সম্পৃক্তি নেই, কেবলই দেখা যায় ফুলের ফুটে থাকা ও কুসুম সৌরভ। কী নন এই রবীন্দ্রনাথ?

কিন্তু আমাদের স্বভাবই হয়তো এইরকম যে একজনকে বড়ো করতে গিয়ে আরেকজনকে ছোটো করতে চাই, ছোটো করে ফেলি। কথাটা বললাম এই কারণে, এদেশে নজরুল ইসলামকে বড়ো করে দেখাতে গিয়ে অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে ছোটো করে ফেলেন, এমনকি তাকে প্রায়শ কাঠগড়ার দিকেও ঠেলে দেওয়া হয়। আমার মতো মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে যাদের জন্ম তাদের হয়তো সে অভিজ্ঞতা আছে। স্বাধীনতার নিকট প্রজন্মের মানুষ আমি, এখনও পাকিস্তানের ভূত আমাদের মাথা থেকে যায়নি। তাই আমি দেখেছি আমার স্কুলে, বাড়িতে-রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুলই ছিলেন আরাধ্য কবি। এর মানে এই নয় আমার পরিবার সাম্প্রদায়িক ছিল। আমি অসম্ভব এক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। এই জন্যে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারটা যথেষ্ট অসম্প্রদায়িক ছিল; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের থেকে অনেক দূরের, এবং এক অজ্ঞাত কারণে নজরুলই ছিলেন সবার প্রিয়-যদিও অনেকেই নজরুল অধ্যয়ন করেননি। রবীন্দ্রনাথতো নয়ই। তাই বাবাকে, চাচাকে, কিংবা বাড়িতে মেহমান আসলে নজরুলের ওজোরস-সম্পৃক্ত কত কবিতা অঙ্গসঞ্চালনপূর্বক শোনাতে হয়েছে; আবৃত্তি করতে করতে, বিনিময়ে টাকা পেয়েছি, উপহার হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ পড়ে কখনো আমি ইনাম লাভ করিনি কারও কাছ থেকে। এজন্য আমার ভেতরে বরাবর একটা প্রশ্নও কাজ করত, কিন্তু কাউকে সাহস করে প্রশ্ন করতে পারিনি-না বাড়িতে, না স্কুলে। বাস্তবে, আমি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের মুখে শুনেছি নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়ো কবি ছিলেন। এবং ভেতরে ভেতরে এরকম একটা প্রত্যয়ও গড়ে উঠেছিল। আমার এক আত্মীয়ের কাছে শুনেছি নজরুলের প্রতিভা নষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ তার ভাতিজিকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। আবার এও শুনেছি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল নজরুলের, কিন্তু পেয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং এর পেছনে দুটি বড়ো কারণ-একটি হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার আর ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ভালো; অপরটি হচ্ছে, ইংরেজরা মুসলমানদের দুচোখে দেখতে পারত না, আর নজরুল যেহেতু মুসলমান সুতরাং তার নোবেলপ্রাপ্তি প্রশ্নই আসেনা। এরকম আরও নানা কথাবার্তা শুনেই আমরা বড়ো হয়ে উঠছিলাম। অন্যদিকে আমি শিক্ষকতা করি বলে ছাত্ররা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে রবীন্দ্রনাথ বড়ো কবি, না নজরুল বড়ো কবি? আমি দেখেছি নজরুলের প্রতি তাদের একটা নীরব পক্ষপাত আছে, আর রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটা গোপন সন্দেহ।

আসলে এরূপ অপপ্রচার বা প্রচারণা কিংবা পক্ষপাত একটা সুনির্দিষ্ট বোধ থেকেই বলে আমি মনে করি। বলাবাহুল্য, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণেই রবীন্দ্র-নজরুলে এই বিভক্তি। ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্পে এই দুই কবিকেও হলাহল পান করতে হয়েছে। যদিও তারা দুজনেই ছিলেন সমান অসাম্প্রদায়িক, দুই শক্তিমান কবি; এবং তাদের দুজনের মধ্যে সখ্যও ছিল প্রবাদতুল্য। কিন্তু  রবীন্দ্রনাথের জন্য দুর্ভাগ্য, যে বাঙালির জন্য সমস্ত জীবন তিনি ভেবেছেন, অথচ তিনি এখনো সকলের হতে পারলেন না! যাই হোক, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথকে কেউ নিয়ে আসেন নি, তাকে খুঁজে নিতে হয়েছে, ক্রমে ক্রমে বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ধীরে ধীরে, সঙ্গোপনে। এবং এই রবীন্দ্রনাথ আমার নিজের রবীন্দ্রনাথ।



সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলি না পড়লেও মোটামুটি রবীন্দ্রনাথ আমি পড়েছি এবং পড়ি প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার তিন অমর সৃষ্টি আমার নিত্যসঙ্গীই বলা যায়। আর তা এই জন্যে যে এগুলো আমি যতবার পড়ি ততবারই নতুন বলে মনে হয় আমার কাছে! সেই অসাধারণ রবীন্দ্র-সৃষ্টিগুলো হচ্ছে গল্পগুচ্ছ, রবীন্দ্রসংগীত (গীতবিতান) ও গীতাঞ্জলি কাব্যখানি। গীতাঞ্জলি বলতে আমি রবীন্দ্র-কাব্যপরিক্রমার গীতাঞ্জলির কথা বলছি না, বলছি গীতাঞ্জলি সংকলনটির কথা, যেটি রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, অর্থাৎ ঝড়হম ঙভভবৎরহমং-এর গীতাঞ্জলি। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি নামে নিজের কিছু কবিতা ও গানের স্ব-কৃত ইংরেজি গদ্য অনুবাদের এই গ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। সংবাদসংস্থা রয়টারের মাধ্যমে সুইডিশ একাডেমির এই সিদ্ধান্ত মুহুর্তেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আর প্রাচ্যের একজন কবির ওপরে পাশ্চাত্যের শিক্ষিত সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এই প্রথম পড়ল।

যে-গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যভূমিতে প্রথম গৌরব নিয়ে আসেন, বাংলায় তো বটেই, খোদ অনেক বাঙালি আজও গীতাঞ্জলির ব্যাপারে ভুল ধারণা পোষণ করেন যে বইটি কবির বাংলা গীতাঞ্জলিরই তর্জমা। এমনকি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরেজি গীতাঞ্জলির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্র সমালোচক ও জীবনীকাররা পর্যন্ত বলেন গ্রন্থটি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি, নৈবেদ্য ইত্যাদি কাব্য থেকে নেয়া কবিতার অনুবাদের সংকলন। আসলে তাও কিন্তু নয়। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে কবিতা ও গানের অনুবাদ ১০৩টি; এর মধ্যে বাংলা গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গান ও কবিতার মধ্যে থেকে ১০৪টি বাদ দিয়ে মাত্র নেয়া হয়েছে ৫৩টি। বাকি ৫০টির মধ্যে রয়েছে গীতিমাল্য ১৬টি, নৈবেদ্য ১৫টি, খেয়া ১১টি, শিশু ৩টি, কল্পনা ১টিÑঅর্থাৎ ৯টি কাব্য এবং অচলায়তন নাটক থেকে ১টি গান। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত ১০৩টি কবিতা মূলগ্রন্থের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংকলনে সাজানো হয়নি।এমনকি অনুবাদে কোথাও কোথাও মূল-বিতার অংশবিশেষ বাদও পড়েছে।

বাংলা গীতাঞ্জলি বেরিয়ে ছিল ১৯১০ সালে আর ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রথম প্রকাশ করেছিল লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি ১৯১২ সালে ১লা নভেম্বর। সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে বিতরণের কথা মনে রেখে মাত্র সাড়ে সাতশ কপি ছাপানো হয়েছিল, তার মধ্যে বিক্রির জন্য ছাড়া হয়েছিল মাত্র ২৫০ কপি। ইংরেজিভাষী কবি, শিল্পী ও কাব্যমোদী মানুষ ছাড়া আর কেউ তেমন ঘটনাটি জানতে পারেননি। ১৯১৩ সালে ১লা মার্চ ম্যাকমিলান কোম্পানি গীতাঞ্জলির সাধারণ ও সুলভ সংস্করণ প্রকাশ করে এবং তা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে বাঙালি কবির কবিতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৩ সালেই বইটি ১৩ বার ছাপতে  হয়েছিল।

ইংরেজি গীতাঞ্জলি গ্রন্থটি ইউলিয়াম রোদেনস্টাইনকে রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন। রোদেনস্টাইন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের  বন্ধু।  নিজের  কবিতার আস্বাদ দেবার মানসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম কিছু কবিতা নিজেই  অনুবাদ করে তাকে পড়তে দেন। রোদেনস্টাইন তা মনোযোগ সহকারে পড়েন, মুগ্ধ হন এবং বিলেতের সুধীজনের কাছে সেগুলি উপস্থাপনও করেন। তাদের মধ্যে স্বয়ং কবি ড. ই. ণবধঃং-ও ছিলেন। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে কবি ণবধঃং-এর উচ্ছ্বসিত ভূমিকাও ছিল। এই ভূমিকায় ইয়েট্স জানিয়েছেন গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি পড়ে তিনি কি রকম গভীরভাবে অভিভূত হয়েছিলেন, তার জবানিতে: ‘এই অনুবাদগুলোর পাণ্ডুলিপিটি আমি কিছুদিন আমার সঙ্গে সঙ্গে বয়ে বেড়িয়েছি, কখনো ট্রেনে, বাসে অথবা রেঁস্তোরায় বসে বসে পড়ছি, আর মাঝে মাঝে তা বন্ধও করতে হয়েছে, পাছে কেউ দেখে ফেলে এগুলো আমাকে কী রকম আবেগ বিহ্বল করে তুলেছে। এই গানগুলোর মধ্যে যে-ভাবজগতের ছবি বিবৃত রয়েছে, আমি সারাজীবন  তারই স্বপ্ন দেখেছি।’  অনত্র তিনি বলেছেন,  ‘বাংলার সভ্যতা যদি অক্ষত থাকে, যে সাধারণ মানসিকতা সকলের মনেই  বয়ে চলেছে সেটা যদি আমাদের মতো ভেঙে ভেঙে বহু মানসিকতার পরিণত না হয়Ñযে মানসিকতা পরস্পরকে মোটেই বুঝতে পারে না, তাহলে এই কবিতাগুলোর মধ্যেকার পরম সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো পর্যন্ত কয়েকপুরুষের মধ্যে পথের ভিখিরির মনেও সঞ্চারিত হবে।’ আরো বলেছেন, ‘প্রজন্মক্রমে ভ্রাম্যমান পথিক থেকে নদীর মাঝি পর্যন্ত সবাই গুন গুন করে এ গান গাইবে।’ ইয়েট্সের এরূপ চিন্তা যে অমূলক ছিল না, গীতাঞ্জলি প্রশ্নে আজকের বাস্তবতা বড়ো প্রমাণ।

ইয়েট্স জানিয়েছেন তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানবার মতো ইংরেজিতে তাদের দেশে কোনো বই ছিল না। তাকে জানবার জন্য একমাত্র উপায় ছিল প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে শোনা এবং কবির লেখাপাঠ। ইয়েট্স শরণাপন্ন হয়েছিলেন এক বাঙালি ডাক্তারের। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের অন্যান্য আরো কবি রয়েছেন, কিন্তু তার সমকক্ষ কেউ নেই। এটাকে আমরা রবীন্দ্র যুগ বলি। আমাদের দেশে তিনি যতখানি  বিখ্যাত, ইউরোপে তেমন বিখ্যাত কেনো কবি আছেন বলে মনে হয় না। কবিতায় তিনি যতখানি প্রতিভা সম্পন্ন, সংগীতের ক্ষেত্রেও ততখানি। ভারতের পশ্চিমপ্রান্ত থেকে বার্মা পর্যন্ত যেখানই বাংলা ভাষাভাষী রয়েছেন সেখানেই তার গান গাওয়া হয়।’

শ্রুতি ও কাব্যপাঠের ওপর ভরসা করেই কবির জীবন ও কাব্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ইয়েটস : ‘এখানে পথিক গেরুয়া বসন পরিধান করে গায়ে ধুলো লাগলে বোঝা যাবে না বলে। যুবতী শয্যায় তার প্রেমিক রাজপুত্রের মালা থেকে খসে পড়া পাঁপড়ি খোঁজে, ভৃত্য বা বধূ শূন্যগৃহের প্রভুর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করে। এ-সবই ঈশ্বরের দিকে ধাবমান হৃদয়ের প্রতীক। ফুল আর নদী, শঙ্খধ্বনি, ভারতীয় ঘন বর্ষা অথবা তপ্ত নিদাঘ, এগুলোও মিলনের বা বিবাহের বিভিন্ন মেজাজের প্রতিচ্ছবি; আর নৌকার ওপর বসে যে ব্যক্তিটি বাঁশি বাজানÑরহস্যময় অর্থব্যঞ্জক চীনা চিত্রপটের মতো, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর।’ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না ইয়েট্স-এর কত গভীরভাবে গীতাঞ্জলি পাঠ করেছিলেন। নতুবা তার পক্ষে এমন ব্যাখ্যা সম্ভব হতো না।

ইংরেজি গীতাঞ্জলিকে বিবেচনার  প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটি স্মরণ রাখা একান্তই প্রয়োজন যে, এই বইটিই কবিকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছিল। ইয়েট্স গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নোবেল কমিটিতে বাঙালি কবির নাম প্রস্তাব করেননি। করেছিলেন স্টার্জ মুর। কমিটিকে তার সুপারিশ ছিল এই রকম : ‘ঝরৎ, ধং ধ ভবষষড়ি ড়ভ ঃযব ৎড়ুধষ ংড়পরবঃু ড়ভ ষরঃবৎধঃঁৎব ড়ভ ঃযব টহরঃবফ করহমফড়স, ও যধাব ঃযব  যড়হড়ঁৎ ঃড় ঢ়ৎড়ঢ়ড়ংব ঃযব হধসব ড়ভ জধনরহফৎড়হধঃয ঞধমড়ৎব ধং ধ ঢ়বৎংড়হ বিষষ য়ঁধষরভরবফ রহ সু ড়ঢ়রহরড়হ ঃড় নব ধধিৎফবফ ঃযব ঘড়নবষ চৎরুব রহ ষরঃবৎধঃঁৎব.’Ñ ঞ. ঝঃঁৎমব গড়ড়ৎ. কমিটির কাছে রবীন্দ্রনাথের নামটিই অজানা ছিল। কাব্যমূল্য যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইংরেজি গীতাঞ্জলি এবং দ্য গার্ডেনার। তারা স্বাভাবিকভাবেই বাংলা জানতেন না এবং বই দুটিকে ইংরেজি কাব্য হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। সুইডিশ একাডেমির অন্যতম সদস্য পণ্ডিত কবি পের হালস্ট্রয়েম কমিটির কাছে যে দীর্ঘ রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতে তিনি লিখেছিলেন : ‘যেহেতু আমি এই ভাষা বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ এবং ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটিভাবে অজ্ঞই বলা যায়। তাই আমি কোনোরকম বিদ্যে জাহির না করেই যে কথাটা বলা দরকার মনে করছি, তা হলো, বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে যেসব গুণাবলি অত্যাবশ্যকীয় বলে ধরা হয়, গীতাঞ্জলি ন্যূনতমভাবেও তা প্রমাণ করবে।’ শেষে মন্তব্য করেছিলেন এই বলে, ‘যাই হোক একথা নিশ্চিত যে, ১৮৩২-এ গ্যেটের মৃত্যুর পর ইউরোপে এমন কোনো কবি নেই যিনি মহৎ মানবতাবাদ, নিষ্কলুষ মহানুভবতা, এবং ধ্রুপদী সাত্ত্বিকতায় টেগোরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন।’ অতপর, সুইডিশ একাডেমি ১৯১৩ সালের নভেম্বরে জানায়  রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ‘তার গভীরভাবে সংবেদনশীল, সতেজ ও সুন্দর কবিতার জন্য, যার সাহায্যে পরম নৈপুণ্যের সাথে তিনি তার স্বকৃত ইংরেজি ভাষান্তরের মাধ্যমে তার কাব্যিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতীচ্যের সাহিত্যের একটি অংশে পরিণত করেছেন।’



রবীন্দ্রনাথের এই নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাদের জন্য যতটা ছিল গৌরবের, কাল হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য। পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলির রচনা ও অনুবাদ নিয়ে প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে পরশ্রীকাতররা নানা রটনা রটায়। নোবেল লাভের পর তার কাছে অজস্র চিঠিপত্র আসতে থাকে, যার মধ্যে অনেকগুলোই অযৌক্তিক ও অপমানজনক।  জনৈক পাশ্চাত্য মহিলা লেখেন, তার ধারণা গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেছেন সি. এফ. এন্ডুজ এবং তিনি চান রবীন্দ্রনাথ যেন অনুগ্রহ করে তার স্বাক্ষরটি পাঠিয়ে দেন, এবং একইসঙ্গে এন্ড্রুজের ঠিকানা  জানান, এজন্যে যে, নোবেলপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলিতে যেন উভয় লেখকের স্বাক্ষর তিনি সংগ্রহ করতে পারেন। অন্যদিকে আরেকটি কথা  চালু হয়েছিল এই বলে যে গীতাঞ্জলি ইয়েট্স-এর লিখে দেয়া বই। কথাই চালু করেছিলেন ভ্যালেন্টাইন চিরোল নামক এক ব্রিটিশ আমলা। ১৯১৪ সালে কবি তার মনোবেদনায় কথা প্রকাশ করেন স্টার্জ মুর ও রোদেনস্টাইনকে । স্টার্জ মুর জানিয়ে ছিলেন, ‘খ্যাতিমানদের দুর্ভাগ্যই এটা যে মিথ্যে গঞ্জনা সইতে হয়,... তবে তোমার সম্পর্কে মিথ্যে লিখে তা চালিয়ে দেওয়া অসম্ভব, কেউ না কেউ প্রতিবাদ করবেই।’ রোদেনস্টাইন যখন চিঠি পান তার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন সি.এফ. এন্ডুজ। তিনি এটা শুনে লজ্জিত, বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। এবং দু ঃখ প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথকে চিঠিও লিখেছিলেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পাশ্চাত্যের আরেকজন নোবেলবিজয়ী ঔপন্যাসিক স্যার রোডিয়ার্ড কিপলিং নোবেলপ্রাপ্তির পর প্রাকাশ্যেই রবীন্দ্রবিরোধীতায় নেমেছিলেন। তার বিভিন্ন মন্তব্য ছিল জাতিবিদ্বেষী ও ঘৃণাসূচক, তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘আমাদের তৈরি ক্যালিবান’ বলে আখ্যায়িত করে তিরস্কার করেছিলেন, যা ছিল ঔপনিবেশিক মানসিকতাপ্রসূত।



অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের পুরস্কারপ্রাপ্তিকে এদেশের অনেকেই কবির ইংরেজি তোষণ, ইংরেজদের ভারতবদান্যতা এবং ভারত-ব্রিটেন কূটনৈতিকসম্পর্কের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ লাগসই চাল হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। এমনকি দেশীয় অনেক পণ্ডিত বইটিকে ইয়েট্সের অনুবাদ বলে অপপ্রচার চালান। এ-প্রসঙ্গে আমি দুটি তথ্য উদ্ধৃত করছি :

ক. রবীন্দ্রনাথ শুধু গীতাঞ্জলিরই ইংরেজি অনুবাদ করেননি, ১৯১২-১৪ সালের মধ্যে কবির ৭টি বই ‘ম্যাকমিলান এন্ড কোম্পানি’ থেকে বের হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে--গীতাঞ্জলি, দ্য গার্ডেনার, দ্য ক্রিসেন্ট মুন, চিত্রা, দ্য পোস্টঅফিস, দ্য কিং অব দ্য ডার্ক চেম্বার এবং ৮টি বক্তৃতার সংকলন। এছাড়াও রয়েছে তার ইন্ডিয়া সোসাইটি-কর্তৃক প্রকাশিত কবীরের দোহার অনুবাদ ঙহব যঁৎফৎবফ ঢ়ড়বসং ড়ভ শড়নরৎ। রবীন্দ্রপ্রয়াণের এত বছর পর আজ আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি ইয়েটস, ব্রিজেস, এন্ডুজ, স্টার্জ মুর-- যাদের হাতেই ইংরেজি গীতাঞ্জলি পাণ্ডুলিপির টাইপ-কপি পড়–ক না কেন আসলে কবির তাদের কাছ থেকে অনুল্লেখ্যভাবে যৎসামান্য নিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বুঝতে পারেন তার বিনয় ও সৌজন্য কীভাবে অপপ্রচারিত হয়ে অমর্যাদাকর এক পরিস্থিতি তাকে টেনে নামাচ্ছে।

খ. নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কলকাতার একান্ত ঘনিষ্ট মহলে তিনি তার মানসিক প্রতিক্রিয়ায় জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এত বড়ো সম্মানে তার খুশির চেয়ে অস্বস্তিই হচ্ছে বেশি।... শেষকালে এই মণিহার বোঝা হয়ে দাঁড়াবে নাতো।’  আরও বলেছিলেন, ‘পশ্চিম বড় হুকুমে জাত, ওরা এরকম যে একটা কাণ্ড করল, সে কি বুঝে,  না না-বুঝে, সেটাও তো তেমন বোঝা যাচ্ছে না।’

রবীন্দ্রানাথ কোন অবস্থায় গীতাঞ্জলি ভাষান্তরিত করেছিলেন, নিজেই ১৯১৩ সালের ১ মে লন্ডন থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন। ততদিনে গীতাঞ্জলির একাধিক সংস্করণ বের হয়েছে। বাইরে হইচই পড়েছে এবং সে খবরের ঢেউ  কলকাতায় ভাইঝিটির কানেও এসেছে: ‘একদিন যে ভাবের হাওয়ায় মনের মধ্যে রসের উৎসব জেগে উঠেছিল সেইটিকে আর একবার এক ভাষার ভিতর দিয়ে মনের মধ্যে উদ্ভাবিত করে নেবার জন্য কেমন একটা তাগিত এল। একটি ছোট্ট খাতা ভরে এল। এটি পকেটে করে নিয়ে জাহাজে চড়লুম।... ভাবলুম সমুদ্রের মধ্যে মনটি যখন উসখুস করে উঠবে তখন  চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার একটি-দুটি করে তর্জমা করতে বসব। ঘটলও তাই।’
রবীন্দ্রনাথ তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূকে নিয়ে বিলেতের উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়েছিলেন ১৯১২ সালের ২৭ মে, লন্ডন পৌঁছেন ১৬ জুন, এ-ব্যাপারে রথীন্দ্রনাথের ভাষ্য :  ‘আমরা লন্ডন এসে পৌঁছলাম এক সন্ধ্যায়। চেয়ারিং ক্রস স্টেশনে এসে জানা গেল টমাস কুক আমাদের জন্য ব্লুমসবেরি অঞ্চলে একটি হোটেলের  কয়েকটি কামরা ভাড়া করে রেখেছেন। স্টেশন থেকে টিউব রেলে আমরা ব্লুমসবেরি অভিমুখে রওয়ানা দিলাম। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ রেলপথে এই প্রথম আমার অভিযান। নতুন অভিজ্ঞতার জন্যই হোক কিংবা অত্যাধিক দায়িত্বভারের জন্যই হোক--আমি নিজের হাতে অতি সন্তর্পণে বাবার অ্যাটাচি কেসটি বহন করে আনছিলাম, টিউব থেকে নামবার মুখে সেইটিই নামতে ভুলে গেলাম। এই অ্যাটাচির মধ্যেই বাবার ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি ও আরো অনেক সব দরকারি কাগজপত্র ছিল।’
আমার মনে হয় এর পরে আর পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলি প্রশ্নে কোনো কথা থাকেনা। থাকাটা শোভনও নয়। তবে এইটুকু বলা যায় কাব্যটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালির গৌরবের শিরস্ত্রাণেই পালক সংযোজন করেননি, গোটা প্রাচ্যভূমিকেই তিনি ঔজ্জ্বল্য দান করেছিলেন।

দায়
২০০৭ সালে রবীন্দ্রজন্মবার্ষিক অনুষ্ঠানে সিলেটের ‘আনন্দলোক’ আমাকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে আমি রবীন্দ্রনাথ ও তার গীতাঞ্জলিকে মাথায় রেখে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যটি প্রদান করি। ওটা কোনো লিখিত বক্তব্য ছিল না। ফলে আমাকে কিছু নোট নিতে হয়, তথ্যের জন্য। বর্তমান প্রবন্ধটি সেই নোট ও তথ্যের আলোকে রচিত। প্রাসঙ্গিক তথ্যের জন্য আমাকে সে সময় তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা ও ইংরেজি অনেক বইয়ের সাহায্য নিতে হয়। সেগুলোর সবকয়টির নাম আজ ঠিক মনে করতে পারছিনা। তবে আবদার রশীদ সম্পাদিত গীতাঞ্জলি, ছিন্নপত্র ও কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতির কথা মনে আছে। আমি এসবের দায় স্বীকার করছি। এ-ক্ষেত্রে উদ্ধৃতি ছাড়াও কোনো বিষয় কোনো বই থেকে সংগৃহীত হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আমি তারও দায় স্বীকার করছি।







ফখরুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথের নীতিকাব্য : কণিকা


_______________________________________________________

রবীন্দ্র কাব্যধারায় কণিকা (১৩০৬ বঙ্গাব্দ) একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সত্য, সুন্দর, কল্যাণ এ ত্রিবেণীর সঙ্গম রবীন্দ্র সৃষ্টিপুঞ্জ। কালের পরিক্রমায় এদের কোন কোনটি কখনও কখনও কবির অধিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এ নিরিখে কণিকায় সত্যের পরাক্রম। বিষয় পরিচর্যায় নীতির গভীর সংযোগ কণিকার ব্যতিক্রমধর্মিতার প্রধান কারণ।
শিল্প, নীতি প্রচারের বাহন হবে কি না-এ বিতর্ক বহু পুরাতন। শিল্প যদি তার নিজস্ব দায় মিটিয়ে অন্যান্য দায়ও  বহন করতে সক্ষম হয় তবে আপত্তির কারণ থাকে না। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর একটি মন্তব্য স্মরণযোগ্য : ‘সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙ্গা লাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, নীতির টিনের ভেপুঁ এবং ধর্মের জয়ঢাক-এই সব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে।’ [সাহিত্যে খেলা] রসিক রবীন্দ্রনাথ কেন জানি এই বইখানি তাকেই উৎসর্গ করে বসলেন। আঙ্গিক ও বিষয়গত পরিচর্যার দিক লক্ষ করে কণিকাকে নীতিকবিতা বলতে হয়। নীতিকবিতায় সরাসরি নীতিকথা ব্যক্ত হতে পারে আবার কাব্য মাধুর্যের আড়ালেও নীতিকথা প্রচারিত হতে পারে। নীতিকবিতা উদ্দেশ্যমূলক রচনা। নীতিকবিতা রচনার পেছনে মূলত দুটি উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে। এক. পাঠককে সচেতন করে তোলা, দুই. তত্ত্বকথার মাধ্যমে জগত-জীবন ও লোকচারিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দান।

কণিকার ১১০টি কবিতার মধ্যে দুই পংক্তির কুড়িটি, চার পংক্তির চৌষট্টিটি, ছয় পংক্তির চারটি, আট পংক্তির সাতটি, দশ পংক্তির এগারটি এবং বার পংক্তির চারটি কবিতা রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের এ কাব্য বিদগ্ধজনের দৃষ্টি লাভে সমর্থ হন নি। যারা রবীন্দ্রকাব্যের ধারাবাহিক আলোচনা করেছেন তারাও  একে আলোচ্য করেন নি, অনেকে নিতান্ত করুণাবশত দুএকটি অনুচ্ছেদ এর জন্য বরাদ্দ করেছেন এবং তাতেও কোনো প্রশংসাবচন বর্ষিত হয় নি। অনেকে একে ছড়া বা বচন জাতীয় রচনা বলেছেন। অনেকের মতে, এটা রবীন্দ্রনাথের দুই পর্বের মাঝে বিশ্রাম-বিলাস। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-আলোচক নীহাররঞ্জন রায়ের কণিকার মূল্যায়ন এরকম : ‘কণিকার অধিকাংশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা লিমেরিক জাতীয়। ইহাদের প্রেরণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোথাও তত্ত্বমূলক, কোথাও উপদেশমূলক; কোথাও ব্যঙ্গ-হাস্যমূলক। কতকগুলি দুই অথবা চার লাইনের ছড়াও আছে যাহা কতকটা ‘বচন’ জাতীয়, যেমন, ‘দেহটা যেমনি করে ঘোরাও যেখানে/বাম হাত বামে থাকে ডান হাত ডানে’ অথবা ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে;/ তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে। যথার্থ কাব্যরসের সার্থক প্রকাশ এসব কবিতায় প্রায় অনুপস্থিত, তবে এমন কবিতাও আছে :

ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়।
তুমি পরিপূর্ণ রূপ - তব  বক্ষে কোলে
জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।

কণিকার কবিতাগুলোর বিষয়গত অভিপ্রায় বিবেচনা করে নিম্নোক্তভাবে শ্রেণি- উপশ্রেণিতে ভাগ করতে পারি :

১. তত্ত্বান্বেষী
ক. জ্ঞানাত্মক : খেলেনা, অল্প জানা ও বেশি জানা, পর-বিচারে গ্রহভেদ, অসাধ্য চেষ্টা, ভালো মন্দ, একই পথ, ধ্রুবানি তস্য নশ্যন্তি, স্তুতি ও নিন্দা, আদিরহস্য, অদৃশ্যকারণ, জীবন, ছলনা, বস্ত্রহরণ, মৃত্যু।
খ. সত্যরূপ উদ্ভাসী: সন্দেহের কারণ, পরিচয়, স্পষ্টভাষী, অচেতন মাহাত্ম্য, গরজের আত্মীয়তা, কাক: কাক: পিক: পিক:, মাঝারির সর্তকতা, গ্রহণে ও দানে, তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে, বলের অপেক্ষা বলী, স্বাধীনতা, বিফল নিন্দা, অপরিবর্তনীয়, স্পষ্টসত্য, শক্তির শক্তি।
গ. মূল্য অবধারণ সমস্যা : অকর্মার বিভ্রাট, হার-জিত, ভার, উচ্চের প্রয়োজন, প্রকারভেদ, মূল, জ্ঞানের দৃষ্টি ও প্রেমের সম্ভোগ, গদ্য ও পদ্য, নূতন ও সনাতন, অনাবশ্যকের আবশ্যকতা, সুখ দুঃখ।
ঘ . পরগুণ হরণ : গুণজ্ঞ, দানরিক্ত, প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
ঙ . জন্মঋণ অস্বীকার প্রবণতা : যথার্থ আপন, অকর্মার বিভ্রাট, রাষ্ট্রনীতি, নম্রতা, অকৃতজ্ঞ।
চ. পরিণামগত ঐক্য : নতিস্বীকার, পরস্পর, ফুল ও ফল, প্রশ্নের অতীত, অনুরাগ ও বৈরাগ্য, বিরাম, চালক, সত্যের  আবিষ্কার, আরম্ভ ও শেষ, চিরনবীনতা, ধ্র“বসত্য, একপরিণাম।
ছ. স্বসীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অচেতনতা: শক্তিরসীমা, অসম্পূর্ণ সংবাদ, নদীর প্রতি খাল, কলঙ্কব্যবসায়ী, শত্র“তাগৌরব, কুয়াশার আক্ষেপ, মোহের আশঙ্কা।

২. উপদেশাত্মক :
ক. উপদেশমূলক : যথাকর্তব্য, স্বদেশদ্বেষী, অপরিহরণীয়, সুসময়।
খ. স্বস্থানের অস্বস্তি : নূতন চাল, নিন্দুকের দুরাশা, প্রবীণ ও নবীন, আকাক্সক্ষা, মোহ।
গ.ঔদার্য : শক্তের ক্ষমা, উদারচরিতানাম্, নিজের ও সাধারণের, দীনের দান, সজ্ঞান আত্মবিসর্জন।
ঘ. ভালোমন্দ প্রভেদক : সন্দেহের কারণ, ভক্তি ও অতিভক্তি, প্রভেদ, অস্ফুট ও পরিস্ফুট, সত্যের সংযম, সৌন্দর্যের সংযম।

৩. ব্যঙ্গাত্মক :
ক. ব্যঙ্গ-হাস্যমূলক : অসম্ভব ভালো, নিরাপদ নীচতা, কর্তব্য গ্রহণ।
খ. মূর্খের বিচার : ঈর্ষার সন্দেহ, কীটের বিচার, অধিকার, এক-তরফা হিসাব, নদীর প্রতি খাল, পরের কর্ম-বিচার, গালির ভঙ্গি।
গ. ঈর্ষা : চুরি নিবারণ, আত্মশত্র“তা।
ঘ. অসারের তর্জন-গর্জন : হাতে কলমে, সমালোচক, কৃতীর প্রমাদ, স্পর্ধা, আযোগ্যের উপহাস, ক্ষুদের দম্ভ, উপলক্ষ।
ঙ. ক্ষুদ্রের বৃহদত্বগৌরব : প্রতাপের তাপ, সাম্যনীতি, কুটুম্বিতা - বিচার, পর ও আত্মীয়।
চ. মহতের গৌরবনাশ : হার জিত, ভিক্ষা ও উপার্জন, ভক্তিভাজন, মহতের দুঃখ।

ঈশপের নীতিগল্পে যেমন উপাদান হিসেবে জীব-জন্তু গৃহীত, জাপানি হাইকুতে যেমন প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগৃহীত তেমনি রবীন্দ্রনাথের কণিকাতেও উপাদান হিসেবে গাছপালা জীব-জন্তুকেই বেছে নেয়া হয়েছে। নদী-সাগর, চাঁদ-সূর্য, লতা-পাতা, ফুল-প্রজাপতি, এসবের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গার্হস্থ্যদ্রব্য যেমন থলি-ঝুড়ি, প্রদীপ, লাঙ্গল, কাঠ, কুঠার, ঘটি, ছাতা প্রভৃতিকে কবি উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এসব উপাদান ব্যবহার করে কবি রূপকের আড়াল তৈরি করেছেন। কবির লক্ষ্য, জগত ও জীবনের সত্যরূপ উদঘাটন, ব্যক্তির বা লোকচরিত্র্যের দোষ গুণ সীমাবদ্ধতা চিহ্নিতকরণ, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দর্শানো। ঐসব উপাদান খুব কার্যকরভাবেই কবির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে।

আমরা বর্তমান আলোচনায় চারটি বিষয়কে অবলম্বন করে কবির অভিপ্রায়কে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করবো। বিষয় চারটি : এক. জগৎ ও জীবন, দুই. সমাজ, তিন. লোকচারিত্র্য, চার. সাহিত্য।

এক. জগৎ ও জীবন

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুতে জীবনের শেষ, একথা বিশ্বাস করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের একটি নতুন দরোজা অতিক্রম করে মানুষ। ‘জীবন’ কবিতায় এই ভাবেরই প্রতিফলন লক্ষ করা যায় : ‘জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা/যেমন চলার অঙ্গ পা তোলা পা ফেলা।’ মৃত্যু সম্পর্কিত তাঁর ভাবনার প্রকাশ রয়েছে ‘মৃত্যু’ নামধেয় কবিতাটিতে। যেখানে তিনি বলেছেন :

ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
                           মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়।
               তুমি পরিপূর্ণ রূপ তব বক্ষে কোলে
                           জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।
এখানে মৃত্যুকে কবি দোলনায় দোল খাওয়া শিশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন, দোলনের একপ্রান্ত যদি জীবন হয় তবে অন্যপ্রান্ত মৃত্যু। মৃত্যুতে জীবনের শেষ নয় এ কথা অনেক প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শেষ বলে যে কিছু নেই, নাটকে-গানে বারবার তার উচ্চকিত ঘোষণা সংশয়কে ব্যক্ত করে না বরং তাঁর স্থির প্রত্যয়ের দৃঢ় অভিব্যক্তিকে ব্যাঞ্জিত করে। আরম্ভ ও শেষ কবিতায় তারই পুনরুক্তি

শেষ কহে একদিন সব শেষ হবে,
হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে।
আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয়
সেইখানে পুনরায় আরম্ভ -উদয়।

জীবন অনিঃশেষ, অপরাজেয় এই বিশ্বাসে বলীয়ান কবি মহাভারতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ প্রসঙ্গটিকে অঙ্গীকার করেছেন। অন্তহীন দ্রৌপদীর শাড়ির প্রতীকে কবি জীবনের অনিঃশেষতাকে অভিদ্যোতিত করেছেন :

সংসার জিনেছি’ বলে দুরন্ত মরণ
জীবন বসন তার করিছে হরণ।
যত বস্ত্র টান দেয়, বিধতার বরে
বস্ত্র বাড়ি চলে তত নিত্য কাল ধরে।
মানুষকে নিয়তির হাতে বাধা পুতুল কল্পনা আধ্যাত্মিক ভাব-কল্পনায় বিভোর মানুষের স্বভাবজ। রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই যে আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন ছিলেন তা নয়, কিন্তু চির অপরিজ্ঞাত রহস্যের সামনে প্রায়ই যে বিমূঢ় হতেন তাঁর  সাক্ষ্য দিচ্ছে নিম্নোধৃত চরণগুলি :
বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিগো গৌরব
কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি
যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।

মানুষ জগতের কল্যাণে যা করে যায়, মৃত্যুর পর সেটুকুতেই তার পরিচয় খুঁজে নেয় অন্যরা। মানুষের কর্মের গুরুত্বকে স্বীকার করেন কবি। কর্মের মাঝেই মানুষের পরিচয় লিপিবদ্ধ থাকে-এই ঋষিবচনের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ‘তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে’ কবিতায় :

গন্ধ চলে যায়, হায়, বন্ধ নাহি থাকে,
ফুল তারে মাথা নাড়ি ফিরে ফিরে ডাকে।
বায়ু বলে, যাহা গেল সেই গন্ধ তব,
যেটুকু না দিবে তারে গন্ধ নাহি কব।

দুই. সমাজ

সূক্ষ্ম সমাজচিন্তার বেশকিছু পরিচয় রবীন্দ্রনাথ এ কাব্যে রেখেছেন। আমরা তারি দুএকটি আলোচনা করে এর সত্যতা তুলে ধরছি। ‘অধিকার’ নামীয় কবিতায় কবি সমাজ মানসের স্থূলবুুদ্ধি ও জড়তাকে ব্যঙ্গ করেছেন অভিনব কৌশলে। বনবাসী লতা-ফুল-গুল্মদের মধ্যে বনের উপর কার অধিকার অধিক বিস্তৃত এমন বির্তকের অবতারণা ও তার বিচার প্রসঙ্গ এর প্রতিপাদ্য। সৌন্দর্য-শোভায়, বর্ণে-গন্ধে ফুল বনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে। বকুলের গন্ধই সম্বল, পলাশের মাত্র বর্ণবিভা, গোলাপের রয়েছে রূপ ও গন্ধ। নিরেট বুদ্ধি মানুষের কাছে ফুলের এসব গুণ বায়বীয় ব্যাপার। তাদের বিশ্বাস এসব দ্বারা বনের উপর ফুলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। স্থূলবুদ্ধি মানুষ ফুলের পরিবর্তে কচুর দাবীর অগ্রগণ্যতা প্রদান করে, কেন না মাটির অভ্যন্তরে কচুই সবচেয়ে বেশি শিকড় ছড়াতে সক্ষম এবং তা প্রত্যক্ষও বটে! বিচারাক যদি এরূপ হন তবে সমাজের দশা কি হবে তা সহজেই কল্পনা করা যায়। বিচারের মাপকাঠি সুবিবেচিত ও সুনির্ধারিত না হলে অকেজো কেজোর মর্যাদা পেয়ে যায়। সমাজের এ দুর্দিন সেদিনই ঘুচবে যে দিন মানুষ এ ধরনের প্রত্যক্ষ-প্রমাণ ভুলতে পারবেন।

একটা কুড়াল তার হাতল নাই। কুড়াল তাই শালগাছের কাছে একটা ডাল প্রার্থনা করল। ডাল পেলে তা দিয়ে হাতল তৈরি হলো। এরপর কুড়াল শালগাছটির গোড়াতে কোপ দিতে শুরু করল। রাষ্ট্রনীতি নামক কবিতায় এটুকুই বিবৃত। রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাপারকে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই প্রতীকায়িত করেছেন। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণের প্রতীক এখানে শালগাছ। ক্ষমতাপ্রার্থী রাজনীতিক দলের প্রতীক কুড়াল। জনগণের সমর্থন ছাড়া রাজনৈতিক দল ক্ষমতা লাভ করতে পারে না। জনগণের দুর্ভাগ্য তারা যাদের ক্ষমতায়িত করেন ক্ষমতায় গিয়ে অধিকাংশ সময়ই তাদের ভূমিকা হয় জনপীড়কের। শাল ও কুড়লকে যথাক্রমে শাসিত ও শাসকের প্রতীকে উপস্থাপন খুবই চমকপ্রদ ও সফল হয়েছে। রাজনীতিক দলগুলো ক্ষমতা লাভের জন্য যেসব উপায় অনেক সময় গ্রহণ করে তা ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে’র সঙ্গে তুলনীয়। সরকারিদল ও বিরোধীদল এমন কর্মসূচী গ্রহণ করে যা জনগণের কল্যাণচিন্তা থেকে জাত নয়। দুই শক্তির চাপে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। “আত্মশত্র“তা” কবিতাটিকে এরই প্রতীক চিত্ররূপে আবিষ্কার করা সম্ভব। কবিতাটিতে খোঁপা আর এলোচুলের বিবাদ চিত্র রয়েছে। একে অপরকে হীনরূপে চিত্রিত করতে তৎপর। খোপা কামনা করে মাথায় যেন টাক পড়ে অন্যদিকে এলোচুলের প্রার্থনা চুল যাতে কাটা পড়ে। দুজনেই ভুলে যাচ্ছে চুল না থাকলে তাদের নিজেদেরই অস্বিত্ব থাকে না। চুলকে জনগণ কল্পনা করলে এবং খোপা ও এলোচুলকে সরকারিদল ও বিরোধীদল বিবেচনা করলে সহজেই আমাদের পূর্বোক্ত মতের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হবে।

তিন. লোকচারিত্র্য

কণিকার বেশিরভাগ কবিতাতেই রয়েছে লোকচারিত্র্যের সমালোচনা। আমরা তারই কয়েকটি আলোচনা করে এর বিভিন্ন প্রান্ত চিহ্নিত করতে চেষ্টা করবো। মানুষের মধ্যে উচ্চাভিলাষ জাগ্রত হলে প্রায়শই ভুলে যায় তার বর্তমান অবস্থা, যোগ্যতা ও উৎসের কথা। “যথার্থ আপন” কবিতায় কবি মানুষের এই চারিত্রিক ত্র“টিকে ব্যঙ্গ করেছেন। কবিতায় বর্ণিত হয়েছে, মাচায় ঝোলা কুমড়া মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বীকারে অনিচ্ছুক। সে আত্মীয়তা খোঁজে আকাশের সূর্য-চাঁদ-তারার সঙ্গে। মাচাটিকে পুষ্পকরথ কল্পনা করে অহংকারী কুমড়া আকাশে উড়াল দেবার কথা ভাবে কিন্তু তার দুর্ভাগ্য (!) নিয়তির মতো বোটা তাকে মাটির সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। তাই তার আবেদন বৃন্তচ্যুতির। আবদার যখন পূরণ হলো তখন তার গন্তব্য হলো জন্মভূমি। সে ধরণী পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বুঝল তার যথার্থ আত্মীয়তা কার সঙ্গে।

মাঝারির সর্তকতা কবিতায় কবি লিখেছেন : ‘উত্তম নিশ্চিতে চলে অধমের সাথে/তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।’ কোনো রাখঢাক না রেখেই মাঝারি মাপের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কবি এভাবেই তুলে ধরেছেন। গরজের আত্মীয়তা কবিতাতে দেখা যায় ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলির  সঙ্গে তার আত্মীয়তা ঘোষণা করছে কিন্তু টাকার থলি তা স্বীকারে পরাক্সমুখ। বাস্তব সমাজেও দেখা যায় দুর্বল দীনজন প্রতাপশালী ধনীর আত্মীয়তা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে কিন্তু ধনীজন তা বেশির ভাগ সময়ই উপেক্ষা করে।

সুযোগ সন্ধানী মানুষ প্রায়শই তোষামোদিতে লিপ্ত থাকে। তোষামোদ করে অনেক সময় ফললাভও ঘটে। গুনজ্ঞ কবিতায় প্রজাপতি ভ্রমরের কাছে জানতে চায় তার অপরূপ রূপ থাকা সত্ত্বেও সে কেন কবিদের মন পায় না। জবাবে ভ্রমর স্বীকার করে প্রজাপতির সৌন্দর্য আছে নিশ্চয়ই কিন্তু তার এই গুণপণা প্রজাপতি সরবে ঘোষণা করে বেড়ায় না এখানেই ভ্রমর জিতে যায়। ‘প্রচারেই প্রসার’ কথাটির সত্যতা এভাবেই প্রমাণিত হয়। “স্পর্ধা” কবিতায় মহতের প্রতি ক্ষুদ্রের নিন্দা প্রচারের অপচেষ্টা ও তার অসারতার কথা বর্ণিত। হাউই এর গর্ব সে তারার মুখে ছাই দিয়ে আসে কিন্তু সে খেয়াল করে না সে ছাই তারই পশ্চাৎগামী হয়। লোকচরিত্র্যের এসব দিকের প্রতি কবির ব্যঙ্গদৃষ্টি এভাবেই নিক্ষিপ্ত।


চার. সাহিত্য বিষয়ক

সাহিত্য সম্পর্কিত তিনটি কবিতায় কথা বলার যায়। এগুলো হচ্ছে : গদ্য ও পদ্য, সমালোচক ও অসম্ভবভালো। সমালোচক ও লেখক এ দুয়ের বৈরিতা বহুবিদিত। সমালোচনাও যে শিল্পকর্ম সে কথা আমরাও ভুলছি না তবে একদেশদর্শী সমালোচনাও তো আমাদের সাহিত্যে দুর্লভ নয়। শিল্প আগে সমালোচনা পরে। অনেক সময়ই সমালোচক ভুলে যান, শিল্পের জন্য সমালোচনা, সমালোচনার জন্য শিল্প নয়। প্রাণহীন, যুক্তিবিচারহীন বিদ্বিষ্ট সমালোচককে উদ্দেশ্যে করেই ‘সমালোচক’ কবিতায় কবি লিখেছেন : ‘তোমার যা মূল্য তার চেয়ে বেশি কথা’। রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন : ‘রক্ত-মাংস গন্ধ পেয়ে ক্রিটিকেরা আসে ধেয়ে’। ক্রিটিকদের ‘ভালো হতো আরো ভালো হলে’ এ ধরনের বাধাবুলিই মূলত তার ব্যঙ্গের বিষয় হয়েছে ‘অসম্ভব ভালো’ কবিতায়। ভালোত্ব যখন পরিমাপ্য নয় তখন ঐরূপ মন্তব্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। কবি ঐ ধরনের সমলোচনা ও সমালোচককে ব্যঙ্গ করেই বলেছেন, আরো ভালো মূলত থাকেÑ ‘অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়’। ‘গদ্য ও পদ্য’ কবিতায় মাত্র দুই চরণে কবি এদের প্রভেদকে মূর্ত করেছেন। পদ্যের আকর্ষণ হৃদয়ে কারণ আবেগই তা সম্বল আর গদ্যের লক্ষ মস্তিষ্ক কেননা, তা যুক্তি-বুদ্ধি নির্ভর। শরকে পদ্যের আর গদাকে গদ্যের প্রতিনিধিত্ব দান করে কবি বলেন, একের কাজ অন্যেকে দিয়ে হয় না।

কণিকায় ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের প্রতিষ্ঠাদান রবীন্দ্রনাথের অনন্যতারই সাক্ষী। অনেকখানি ভাব মরে এলে একটুখানি ভাষায় প্রকাশ করার কথা প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, কণিকা তারই মূর্তিমান প্রকাশ। হাস্যরস-ব্যঙ্গের মাধ্যমে সত্যের প্রকাশ ঘটানো নতুন ব্যাপার নয় সত্যি, তবে লাঠি না ভেঙ্গে সাপ মারার মতো এই কৌশল খুব কার্যকরী। সাহিত্যে রূপক প্রতীকের ব্যবহার পূর্বোক্ত কৌশলেরই ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্রনাথ কলা-কৌশল হিসেবে এসবকেই অঙ্গীকার করেছেন। বিষয় সৌন্দর্যের সঙ্গে আঙ্গিকের সৌন্দর্যের ব্যাপারেও তিনি সমান সচেতন ছিলেন। ছন্দ-অলঙ্কারের তাৎপর্যময় উপস্থিতি সে সাক্ষ্যই বহন করে। তাই কণিকা কেবল ছন্দোবদ্ধ উপদেশ নয়, সত্যের সুন্দরতর প্রকাশও বটে।






কুমার দীপ
গীতাঞ্জলি কিংবা ...

_______________________________________

বাংলা গীতাঞ্জলির মোট গান বা কবিতাসংখ্যা ১৫৭, আর এওঞঅঘঔঅখও : ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর উপস্থাপনা ১০৩ টি। এই ১০৩টির ভেতরে বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৫৩টি। বাকি ৫০টি গৃহীত হয়েছে ‘গীতিমাল্য’, ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’, ‘শিশু’, ‘কল্পনা’, ‘চৈতালি’, ‘উৎসর্গ’, ‘স্মরণ’ ও ‘অচলায়তন’ থেকে। বাংলা গীতাঞ্জলি যেখানে পুরোটাই কাব্যগুণসম্পন্ন গানে পরিপূর্ণ সেখানে ইংরেজি গীতাঞ্জলি পূর্ণত ছন্দ-তাল-লয়শূন্য গদ্যানুবাদ। আক্ষরিক বা অবিকল তো নয়ই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো ভাবানুবাদ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা একেবারে ভিন্নপ্রায় বক্তব্য সংক্ষেপ। এটাকে রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্র ও মৌলিক ইংরেজি গ্রন্থ বললেও অপলাপ হয় না। বাংলা গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গানই প্রথমে প্রার্থনা সঙ্গীত। গীতাঞ্জলির অল্প কিছু মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রীতিমূলক পঙক্তির সন্ধান মেলে, ইংরেজি গীতাঞ্জলিতেও দু-চারটা ভিন্নস্বাদের কবিতা আছে। বাংলা গীতাঞ্জলির প্রথম গান ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/চরণধুলার তলে/ সকল অহঙ্কার হে আমার/ ডুবাও চোখের জ্বলে...।’ নিজেকে নিঃশর্ত নিবেদন করা, আত্ম-অহম, আত্মগৌরব লুপ্ত করে নিজেকে প্রকাশ করবার এই গানটি ইংরেজি গীতাঞ্জলি তথা ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এ নেই। পক্ষান্তরে ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ-এর প্রথম নিবেদন ঞঐঙট ঐঅঝঞ সধফব সব বহফষবংং, ংঁপয রং ঃযু ঢ়ষবধংঁৎব. ঞযরং ভৎধরষ াবংংবষ ঃযড়ঁ বসঢ়ঃরবংঃ ধমধরহ ধহফ ধমধরহ, ধহফ ভরষষবংঃ রঃ বাবৎ রিঃয ভৎবংয ষরভব. বাংলা গীতাঞ্জলিই নয়, গীতিমাল্য থেকে নেওয়া। গীতিমাল্যর ২৩ নং এই গানটি, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ/ এমনি লীলা তব।/ ফুরায়ে গেলে আবার ভরেছ/ জীবন নব নব...।’ জীবনস্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ। জীবনদেবতার পরশ পেয়ে, দয়া পেয়ে কবি এখানে বিপুল হরষিত। বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে ৭৮ সংখ্যক গানটি নিয়ে নিবেদন করা হয়েছে ইংরেজি গীতাঞ্জলির দ্বিতীয় গান হিসেবে। এখানে জীবনদেবতার গান গাইতে পেরে কবি গর্বিত, ছলছল চোখে নিমেষহারা। আবার জীবনদেবতাও কবির গীতরাগে তৃপ্ত। গান দিয়েই কবি এখানে জীবন প্রভুর চরণ ছুঁয়ে যান, গানের দ্বারাই প্রভুকে ডাকেন বন্ধু বলে। ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর তৃতীয় পরিবেশনা ও কহড়ি ঘড়ঃ যড়ি ঃযড়ঁ ংরহমবংঃ, সু সধংঃবৎ ! ও বাবৎ ষরংঃবহ রহ ংরষবহঃ ধসধুবসবহঃ. বাংলায় বহুশ্র“ত গান, তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, / অবাক হয়ে শুনি, যা কিনা বাংলা গীতাঞ্জলির ২২ নং এ আছে। পূর্ব-গানের অনুরণন থাকলেও কিঞ্চিৎ সুরহারা কবি এখানে। আবার সুরহারা হলেও সুরের জালে আবদ্ধ তিনি। চতুর্থ গান খওঋঊ ঙঋ গণ ষরভব, ও ংযধষষ বাবৎ ঃৎু ঃড় শববঢ় সু নড়ফু ঢ়ঁৎব, শহড়রিহম ঃযধঃ ঃযু ষরারহম ঃড়ঁপয রং ঁঢ়ড়হ ধষষ সু ষরসনং, গীতাঞ্জলি কিংবা গীতিমাল্য নয়, নৈবেদ্যর ৭৫ নং গান, যেখানে প্রাণেশ্বরের পরশলগ্ন কবি নিজেকে পবিত্র রাখবার, সর্বপ্রকার মিথ্যা থেকে দূরে থাকবার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন এবং সকল কুটিলতা, হিংসা কিংবা অমঙ্গলকে দূরে রেখে প্রেমে প্রষ্ফুটিত থেকে প্রাণেশ্বরের প্রচার কর্মে নিয়োজিত থাকবার কথা বলেছেন। এওঞঅঘঔঅখও র পরের গান গীতিমাল্য থেকে নেয়া। ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে/ আমায় শুধু ক্ষণেক তরে’ গানটিতে কবি কিছুটা আলাদা বসন্তের আগমনে উচ্ছ্বসিত। বাংলা গীতাঞ্জলির ৮৭ নং গান (যা কি না ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ৬ নং-এ অবস্থিত) নিবেদনের আতিশয্যে খানিকটা আত্মোৎসর্গের উন্মাদনায় আক্রান্ত। মৃত্যুভাবনা দ্বারা প্রভাবিত কবি নিজেকে সুধা-গন্ধযুক্ত ফুল হিসেবে উপস্থাপন করে ধুলোয় ঝরার আগে স্রষ্টার চরণে নিবেদিত হতে চেয়েছেন। নোবেল বিজয়ী বইয়ের ৭ নং  গণ ঝঙঘএ ঐঅঝ ঢ়ঁঃ ড়ভভ যবৎ ধফড়ৎহসবহঃং. ঝযব যধং হড় ঢ়ৎরফব ড়ভ ফৎবংং ধহফ ফবপড়ৎধঃরড়হ. গানটিই বাংলায় ‘আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলঙ্কার / তোমার কাছে রাখে নি আর সাজের অহঙ্কার’ (গী. ১২৫নং)। এখানেও কবি অহমিকাহীন আত্মনিবেদনে আকুল। নিজে কবি হয়ে প্রভুকে সম্বোধন করেছেন মহাকবি বলে। ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর ৮ থেকে ১৯ পর্যন্ত সকল গানই গীতাঞ্জলি থেকে নেয়া। এই গানগুলোতেও আছে আত্মনিবেদনের বিপুল আয়োজন। দু-একটা সামান্য ব্যতিক্রম একেবারেই যে নেই তা বলা যাবে না। গীতাঞ্জলির ১২৭ নং ( ইং. গীতাঞ্জলির ৮নং) গানে বিধাতা কর্তৃক রাজার মতো সাজানো, মণিরতন হারে সুসজ্জিত হওয়ার দীনতা প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে আমায় আমি নিজের শিরে বইব না (বাং. গী. ১০৫) প্রায় একই অনুরণনের গান হলেও ইংরেজি গীতাঞ্জলির ১০ নং নিবেদন ঐঊজঊ ওঝ ঞঐণ ভড়ড়ঃংঃড়ড়ষ ধহফ ঃযবৎব ৎবংঃ ঃযু ভববঃ যিবৎব ষরাব ঃযব ঢ়ড়ড়ৎবংঃ, ধহফ ষড়ষিরবংঃ, ধহফ ষড়ংঃ. বাংলা গীতাঞ্জলির বিখ্যাত ও অনন্যসাধারণ গান যেথায় থাকে দীনের অধম দীনের হতে দীন / সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে / সবার পিছে, সবার নীচে, / সব হারাদের মাঝে। (১০৭) কবিতা হিসেবে এটি রবীন্দ্রপ্রাণা। কবি তাঁর জীবনপ্রভুকে। সহায় দীন-দরিদ্রের মাঝে খুঁজে ফিরেছেন। এবং পরবর্তী খঊঅঠঊ ঞঐওঝ পযধহঃরহম ধহফ ংরহমরহম ধহফ ঃবষষরহম ড়ভ নবধফং ! ডযড়স ফড়ংঃ ঃযড়ঁ ড়িৎংযরঢ় রহ ঃযরং ষড়হষু ফধৎশ পড়ৎহবৎ ড়ভ ধ ঃবসঢ়ষব রিঃয ফড়ড়ৎং ধষষ ংযঁঃ? ঙঢ়বহ ঃযরহব বুবং ধহফ ংবব ঃযু এড়ফ রং হড়ঃ নবভড়ৎব ঃযবব!  (ইং গী. ১১)। গানটিও সমভাবনারই অগ্রবর্তী রূপ যেন । বাংলা গীতাঞ্জলির ১১৯-এ অবস্থিত এই গানে কবি যখন বলেন :

ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পুজিস সঙ্গোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
দেবতা নেই ঘরে।
...     ...     ...
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার পরে।

তখন একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কবি কোন্ ঈশ্বরকে খুঁজছেন । মন্দির-মসজিদ নয় মাটিলগ্ন শ্রমজীবী মানুষের রূপে যে ঈশ্বর বিরাজ করেন সেই জীবনে ঈশ্বরই কবির আরাধ্য। ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর পরের ৪টি গান আগের মতোই আত্মনিবেদনময়, পরমেশ্বরের কাছে লীন হওয়ার বাসনা ভারাতুর। তৎপরবর্তী গানটি, যা কি না বাংলা গীতাঞ্জলির ৪৪ নং গীত হতে নেয়া সেখানে আবার রবীন্দ্রসাহিত্যের মৌলসুরের সন্ধান মেলে। জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে মানবজীবনকে ধন্য করার আবাহনী সুর ইংরেজিতে হয়ে উঠেছে, ও ঐঅঠঊ ঐঅউ সু রহারঃধঃরড়হ ঃড় ঃযরং ড়িৎষফ’ং ভবংঃরাধষ, ধহফ ঃযঁং সু ষরভব যধং নববহ নষবংংবফ. গু বুবং যধাব ংববহ ধহফ সু বধৎং যধাব যবধৎফ.

ভক্তি অপেক্ষা প্রেম যে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় সেকথা আপাত ভক্তিরসঋদ্ধ কবিতাতেও স্পষ্ট। তারপরও এওঞঅঘঔঅখও র ১৭নং গানে কবি বলেন, ও অগ ঙঘখণ ধিরঃরহম ভড়ৎ ষড়াব ঃড় মরাব সুংবষভ ঁঢ় ধঃ ষধংঃ রহঃড় যরং যধহফং. ঞযধঃ রং যিু রঃ রং ংড় ষধঃব ধহফ যিু ও যধাব নববহ মঁরষঃু ড়ভ ংঁপয ড়সরংংরড়হং. বাংলায় যা ছিলো প্রেমের হাতে ধরা দেব / তাই রয়েছি বসে; / অনেক দেরি হয়ে হয়ে গেল, / দোষী অনেক দোষে। পরের দুটি গান আবার সেই স্রষ্টানুকূল্যপ্রার্থী। গীতাঞ্জলির ১৮ ও ২০ সংখ্যক গান থেকে জন্ম নিয়েছে ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর নং ২২ ও ২৩ গান দুটি । দুটি গানই মধ্যযুগের বৈষ্ণবসাহিত্যের সুরধন্য। কবি যখন বলেন : হে একা সখা, হে প্রিয়তম, / রয়েছে খোলা এ ঘর মম, / সমুখ দিয়ে স্বপনসম / যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে, তখন বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা বিরহের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আবার গেয়ে ওঠেন, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, / পরানসখা বন্ধু হে আমার, তখনও রাধা-কৃষ্ণের অভিসারের কথাই মনে পড়ে। বাংলা গীতাঞ্জলির শেষ তথা ১৫৭ সংখ্যক গানটি একটি গ্রন্থের শেষ উপস্থাপনার হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে এটি ২৪তম পরিবেশনা। যে সাফল্য প্রত্যাশা ছিলো কবির, তা পূরণ হয় নি বলে কবি এখানে জানাচ্ছেন। দিবস সাঙ্গ হলে পাখি গায় না, ক্লান্ত বায়ু আর চলে না, কিন্তু পথিকের পথ যদি না ফুরায়? পথের মাঝখানে পাথেয় ফুরিয়ে গেছে কবির, ক্ষতির রেখা ফুটে উঠেছে। ধুলা-মলিন অপমানহত হয়েও নবীন উদ্যাপনে ফুল ফুটিয়ে তোলার কথা বলেছেন। এই কথারই প্রতিধ্বনি পাই যেন নৈবেদ্যর ৯৮ সংখ্যক গানের শেষ দুটি চরণে, যেখানে কবি বলেন, রাত্রি এনে দাও তুমি দিবসের চোখে, /আবার জাগাতে তারে নবীন আলোকে। ইংরেজি গীতাঞ্জলির এটি ২৫ সংখ্যক উপস্থাপনা। বাংলা গীতাঞ্জলির ৬ সংখ্যক গানটি প্রেমানন্দরসঋদ্ধ; ১৭ সংখ্যক গানটি প্রেম-বিরহ আর প্রকৃতির রসে সিক্ত; ১৪৫ দ্বিধাজড়িত চিত্তে স্রষ্টার বন্দনা; ১৪৩ তম গানে আছে আগেকার আত্মনিবেদন, আর ১০৩ সংখ্যক গানটি বৈষ্ণব সাহিত্যের সুরকেই পুনঃজাগ্রত করে। উল্লি¬খিত গানগুলি অনূদিত হয়েছে ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর ২৬ থেকে ৩০ সংখ্যক নিবেদন হিসেবে। এ গ্রন্থের ৩১তম অংশটি খেয়া কাব্যের বন্দী কবিতার অনুবাদ, যেখানে আত্মঅহমিকা বা আত্মউন্নত ভাবনার প্রবঞ্চনা প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যায়ের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য উপস্থাপনা মনে হয় ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর ৩৫ সংখ্যক গদ্যটি। ডঐঊজঊ ঞঐঊ সরহফ রং রিঃযড়ঁঃ ভবধৎ ধহফ ঃযব যবধফ রং যবষফ যরময; ডযবৎব শহড়ষিবফমব রং ভৎবব;  যা বাংলায় ছিলো :

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
                                    যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া ওঠে, যেথা নির্বাসিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়

জীবন ও জীবনমুখিতা এখানে গীতাঞ্জলির অনেক কবিতার তুলনায় উন্নত ও অনুসরণযোগ্য। নৈবেদ্যর ৯৯ সংখ্যক গানটি ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৩৬তম প্রকাশ। এখানে কবি বীর্যবান হতে চেয়েছেন। কাউকে পরাজিত করবার জন্য নয়, নিজের ক্ষীণতা দূর করার জন্য, সুখ-দুঃখকে সহ্য করার জন্য, কর্ম ও প্রীতি-পূণ্যে ফুটে ওঠার জন্য; ক্ষুদ্রকে হীন জ্ঞান না করা কিংবা সবলের চরণে নিজেরে না সঁপে দেয়ার জন্য এবং সবকিছুর উর্ধ্বে প্রাণেশ্বরের চরণে নিজেকে স্থির রাখবার জন্য। নৈবেদ্য থেকে ৮৬, ৩৩, ৮১, ২৬, ৩০, ৪৪, ৩ ও ২৪ সংখ্যক কবিতা বা গানগুলোও ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে অনূদিত হয়েছে। ৮৬ সংখ্যক কবিতা, যা কি না ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর ৪০ নং-এ অন্তর্ভূক্ত যেখানে কবি কিছুটা ব্যতিক্রম। অনেক দিন নববারিবর্ষণের মতো শ্যামল সংবাদ না পাওয়া কবি কখনও বজ্রনাদের মতো ভয়ঙ্কর কিছু, কখনও জননীর স্নেহের সজলতা প্রত্যাশা করেছেন।

ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে স্থান পাওয়া নৈবেদ্যর ৩৩ সংখ্যক কবিতাটিও প্রথাগত। স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতার ডালি। ঞঐঙট অজঞ ঞঐঊ ংশু ধহফ ঃযড়ঁ ধৎঃ ঃযব হবংঃ ধং বিষষ.(৬৭) ঝঙঘএ ঙঋঋঊজওঘএঝ এর এই রচনাটি নৈবেদ্যর ৮১ সংখ্যক কবিতা, একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়। / হে সুন্দর, নীড়ে তব প্রেম সুনিবিড় / প্রতি ক্ষণে নানা বর্ণে নানা গন্ধে গীতে / মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারিভিতে। এখানেও বর্ণিত হয়েছে পরমাত্মার অবিনশ্বরতার কথা। তবু আত্মা পরমাত্মার কথা বলি আর সাধারণ প্রাণের কথাই বলি, মনুষ্যপ্রাণের কর্মলীলা অপরিসীম তাৎপর্যবাহী। কবির শিরায় শিরায় যেমন তরঙ্গায়িত তেমনি অপরূপ ছলে তালে-লয়ে বিশ্বদিগি¦জয়ে ছুটে চলেছে সে প্রাণ। বিশ্বব্যাপী জন্ম-মৃত্যুর সমুদ্রদোলায় দোলায়িত সেই অনন্ত প্রাণস্পন্দন কবির অন্তরেও নৃত্য করছে। নৈবেদ্যর ২৬ সংখ্যক কবিতার এটিই বক্তব্য। কবিগুরুর কাব্যিকতার এক মহৎ জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়েছে নৈবেদ্যর ৩০ সংখ্যক উপস্থাপনায়, যা কি-না ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৭৩ সংখ্যক পদ। ইংরেজিতে যা উঊখওঠঊজঅঘঈঊ রং হড়ঃ ভড়ৎ সব রহ ৎবহঁহপরধঃরড়হ. ও ভববষ ঃযব বসনৎধপব ড়ভ ভৎববফড়স রহ ধ ঃযড়ঁংধহফ নড়হফং ড়ভ ফবষরমযঃ. ঞযড়ঁ বাবৎ ঢ়ঁৎবংঃ ভড়ৎ সব ঃযব ভৎবংয ফৎধঁমযঃ ড়ভ ঃযু রিহব ড়ভ াধৎরড়ঁং পড়ষড়ঁৎং ধহফ ভৎধমৎধহপব, ভরষষরহম ঃযরং বধৎঃযবৎহ াবংংবষ ঃড় ঃযব নৎরস. গু ড়িৎষফ রিষষ ষরমযঃ রঃং যঁহফৎবফ ফরভভবৎবহঃ ষধসঢ়ং রিঃয ঃযু ভষধসব ধহফ ঢ়ষধপব ঃযবস নবভড়ৎব ঃযব ধষঃবৎ ড়ভ সু ঃবসঢ়ষব. ঘড়, ও রিষষ হবাবৎ ংযঁঃ ঃযব ফড়ড়ৎং ড়ভ সু ংবহংবং. ঞযব ফবষরমযঃং ড়ভ ংরমযঃ ধহফ যবধৎরহম ধহফ ঃড়ঁপয রিষষ নবধৎ ঃযু ফবষরমযঃ. ণবং, ধষষ সু রষষঁংরড়হং রিষষ নঁৎহ রহঃড় রষষঁসরহধঃরড়হ ড়ভ লড়ু, ধহফ ধষষ সু ফবংরৎবং ৎরঢ়বহ রহঃড় ভৎঁরঃং ড়ভ ষড়াব. বাংলায় তা ছিলো :

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহনন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দির-মাঝে।

কবি যতই পরমাত্মার নিকট আত্মার বিলীয়মানতার কথা বলুন, ঈশ্বরের পাদপদ্মে মতি রাখার কথা বার বার উচ্চারণ করুন, পরমেশ্বরের মহীমা কীর্তনে পঙক্তির পর পঙক্তি ব্যয় করুন; পার্থিব সংসারহীন বৈরাগ্য জীবনে তাঁর কোনো আকাক্সক্ষা নেই। বরং সংসারের অসংখ্য বন্ধন মাঝেই তিনি মুক্তির স্বাদ সন্ধান করেছেন। পৃথিবীর মৃত্তিকার পাত্রখানিতেই বার বার সুধা পান করতে চেয়েছেন। বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ অনুভবের সূতিকাগার মনুষ্যইন্দ্রিয়াদির দরজা বন্ধ করে প্রেমকে ভক্তিরূপে ফুটিয়ে তুলে মানব জীবনকে সার্থক করে তুলতে চেয়েছেন।







মর্মরিত ঊষাপুরুষ
গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কার

__________________________________________________________

রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার মূলত ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এর জন্য। ইংরেজ কবি স্টার্জ মোর, যিনি রবীন্দ্রনাথের ক্রিসেন্ট মুন গ্রন্থের অনুবাদে সহায়তা করেন, তিনিই কবির নাম এই পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করেন। কিন্তু তারও আগে বাঙলা ভূগোলের বাইরে গীতাঞ্জলিকে পরিচিত করাবার অভিপ্রায়ে প্রথম যাঁরা এগিয়ে আসেন তাঁরা- বিলেতের ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি’। এখান থেকেই প্রথম (১৯১২ সালে) রবীন্দ্রনাথের ‘কিছু কবিতা ও গানের’ ইংরেজি গদ্যানুবাদ নিয়ে গীতাঞ্জলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। অনূদিত গীতাঞ্জলি প্রকাশের পরপরই তা ইউরোপের মূলধারার সাহিত্যিকদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এবং সে সময়ের ইংরেজি কাব্যামোদীদের অন্তরে গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে। লন্ডনের ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ প্রথম ইংরেজি গীতাঞ্জলির সীমিত সংস্করণ বের করে। ‘ম্যাকমিলান অ্যান্ড কোং’ কর্তৃক পূর্ণরূপে তা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের মার্চে। নোবেল পাওয়ার আগেই গীতাঞ্জলি দুবার পুনর্মুদ্রিত হয়। অনূদিত গীতাঞ্জলি প্রকাশের পর উৎসর্গ পাতায় নাম দেখা যায় রদেস্টাইনের। রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির পথ তৈরি করে দেন রদেনস্টাইন। ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এ ষোল পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভূমিকায় ডবলিউ. বি. ইয়েটস-এর কথায় তার প্রমাণ মেলে।

পাশ্চাত্যে রদেস্টাইন থেকে আরম্ভ করে টমসন পর্যন্ত যাঁরাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে আলোড়িত হয়েছিলেন তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল প্রাচ্য সম্বন্ধে এক ধ্র“ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাচ্যের যে অধ্যাত্মবাদের প্রতি তাঁদের গভীর অনুরাগ ছিলো রবীন্দ্রনাথে তারই প্রকাশ দেখে তাঁরা খুশি হন। এছাড়া ভারতীয় দর্শন বিষয়ে পেলব যে ছবিটি দিনের পর দিন তাঁরা অন্তরে লালন করেছেন গীতাঞ্জলির মাধ্যমে তা যেন একেবারে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়। যৌবনে দেখা মোহিনী চ্যাটার্জিকে ইয়েটস নতুন করে আবিষ্কার করেন রবীন্দ্রনাথের ভেতর। ফলে যেমনটি তিনি ভাবতেনজ্জভারত মানেই এক আদিম, অবিভাজ্য ও চিরায়ত সংস্কৃতির লালনভূমি; গীতাঞ্জলির ভূমিকায় তিনি তারই জয়গান করেন। ইয়েটস গীতাঞ্জলিতে দেখেন এক অভাবিত নিষ্পাপতা (অহ রহহড়পবহপব, ধ ংরসঢ়ষরপরঃু ঃযধঃ ড়হব ফড়বং হড়ঃ ভরহফ বষংবযিবৎব রহ ষরঃবৎধঃঁৎব সধশবং ঃযব নরৎফং ধহফ ঃযব ষবধাবং ংববস ধং হবধৎ ঃড় যরস ধং ঃযবু ধৎব হবধৎ ঃড় পযরষফৎবহ, ধহফ ঃযব পযধহমবং ড়ভ ঃযব ংবধংড়হং মৎবধঃ বাবহঃং ধং নবভড়ৎব ড়ঁৎ ঃযড়ঁমযঃং যধফ ধৎরংবহ নবঃবিবহ ঃযবস ধহফ ঁং.)। এই চেতনা আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যে একেবারেই নতুন বলে ইয়েটস বেশ উচ্ছ্বসিতই হন। ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-কে ইউরোপীয় পাঠক খ্রিস্টের বাণীর অনুরণন হিসেবে গ্রহণ করে। এডওয়ার্ড টমসন বলেন : ‘রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় বিশেষত তাঁর নৈবেদ্য পর্যায়ে নিউ টেস্টামেন্টর প্রভাব রয়েছে।’ এমনটা প্রত্যয় হয়, রবীন্দ্রনাথ খ্রিস্টধর্মের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে না হোক, যিশুর জীবন ও বাণীর প্রতি তাঁর নিজের বাণী ও ধর্মবোধের এক ধরনের সহজাত নৈকট্য ছিলো। দুঃখের ভেতর আনন্দ ও মুক্তি, এ হয়তো উপনিষদের মন্ত্র, কিন্তু যিশুর জীবনেও সেই সত্যের প্রকাশ দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথায় : ‘তাঁহাকে তাঁর শিষ্যরা দুঃখের মানুষ বলেন। দুঃখ স্বীকারকে তিনি মহৎ করিয়া দেখাইয়াছেন। ইহাতেও তিনি মানুষকে বড়ো করিয়াছেন। দুঃখের উপরেও মানুষ যখন আপনাকে প্রকাশ করে তখনই মানুষ আপনার সেই বিশুদ্ধ মনুষ্যত্বকে প্রচার করে, যাহা আগুনেও পোড়ে না, যাহা অস্ত্রাঘাতে ছিন্ন হয় না।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ সেই মানুষের ভেতর ঈশ্বরের সন্ধান করেন, যে মানুষ অপমানিত, অবহেলিত ও অসহায় এবং এইসব মানুষের সেবাই যে প্রকৃত ধর্ম, এই শিক্ষাও সম্ভবত তিনি যিশুর কাছেই শিখেন। এভাবে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে অথবা যিশুর বাণীর সঙ্গে রবীন্দ্রবাণীর যে সাযুজ্য, তা উভয় ধর্মের অন্তর্গত মানবিকতা দ্বারা পরিলক্ষিত এবং পৃথিবীর মূলধারাভুক্ত সব ধর্মের মূল বাণীর মধ্যে যে ঐক্য রয়েছে, তা ওই সার্বজনীন মানবিকতা দ্বারাই নির্মিত। ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এর পাঠক সেই সার্বজনীন মানবিকতার কণ্ঠস্বরকে চিহ্নিত করতে সামর্থ্য হন। রবীন্দ্রনাথ ‘আত্মপরিচয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন : ‘আমার রচনার মধ্যে যদি কোনো ধর্মতত্ত্ব থাকে, তবে সে হচ্ছে এই যে, পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সেই পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধিই ধর্মবোধ, যে প্রেমের একদিকে দ্বৈত আর একদিকে অদ্বৈত, একদিকে বিচ্ছেদ আর একদিকে মিলন, একদিকে বন্ধন, আর একদিকে মুক্তি।’ আবু সয়ীদ আইয়ুব একইভাবে বলেন : পদাবলি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির তুল্য সংরক্ত, প্রাণ¯পন্দিত ও প্রকাশোজ্জ্বল প্রেমের কবিতা যেকোনো সাহিত্যে দুর্লভ। বৈষ্ণবকাব্যের যে পদগুলির সঙ্গে আমরা অত্যন্ত পরিচিত এবং যার কাব্যিক উৎকর্ষ সর্বসম্মত, তাতে প্রায়ই প্রেমের লক্ষণ ভক্তির লক্ষণকে ছাড়িয়ে গেছে। গীতাঞ্জলি এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।

রবীন্দ্রকাব্যের যে পরিধি আর তার যে অতলান্ত রূপ এবং এর সাথেই ‘সীমা থেকে অসীম, রূপ থেকে অরূপ এবং বিশেষ থেকে নির্বিশেষ’-এর যে অভাবিত মেলবন্ধন প্রতিটি পরতে পরতে, তা সহজাত নয়, অর্জিত। রবীন্দ্রনাথ নিজে এ বিষয়ে বেশ সচেতন ছিলেন এবং সচেতনভাবেই তিনি প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষের সম্মিলনক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন তাঁর প্রতিটি ভাবকে। ফলে তিনি নিজেও বুঝতেন যে, তাঁর গীতিকবিতাসমূহের অনুবাদ সহজ নয়। একটি সরল অর্থান্তর হয়তো সম্ভব, কিন্তু যে কাব্যগুণে বিভাসিত এই এই পঙক্তিমালা এবং যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পটভূমিতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, ভাষান্তরে তাকে স্পর্শ করা দুষ্কর। আবার এই কবিতাগুলোকে তৎকালীন ইংরেজি কবিতায় ব্যবহৃত প্রবণতাসমূহের সাথে একসূত্রে গাঁথতে গেলে মূলের সাথে সম্পর্ক খুইয়ে বসে। অপর দিকে তা না করতে পারলেও যাদের দেখবার বুঝবার স্বাধীন দৃষ্টি আছে তাদের কাছে পৌঁছানো যায় না। এই দ্বিবিধ সংকট থেকেই তিনি নিজে এবং গীতাঞ্জলির প্রথম মুগ্ধ ইংরেজ পাঠক রদেস্টাইন  বারবার এই কাব্যের সরলতার প্রতি মনোনিবেশ করতে অনুরোধ করেছেন। এবং সম্ভবত এই বোধ থেকেই কবি রদেনস্টাইনের কাছে লেখা একাধিক পত্রে গীতাঞ্জলির কবিতাসমূহকে ‘অতিসাধারণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। আবার তাতেও তাঁর চিত্ত তুষ্ট নয় ফলে, (জুলাই ১৯১২) রদেনস্টাইনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি তাঁর গুটিকয় কবিতা প্রেরণ করে অতি কুণ্ঠার সঙ্গে লেখেন, ‘কবিতাগুলি এতো সাধারণ যে তা অনুবাদের যোগ্য নয়, কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস কবিতাসমূহের অপসৃয়মান ভাববস্তু আপনি ঠিকই ধরতে পারবেন।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথা একদিকে যেমন বিনয় অপরদিকে তেমনি পাশ্চাত্যে  এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে  তাঁর একধরনের সংশয়েরও বহিঃপ্রকাশ। তবুও গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম নামে প্রকাশের পর যে সকল পশ্চিমা পাঠক তা পাঠ করে বিশেষভাবে উজ্জীবিত হনজ্জ তাঁরা দেখেন যে, এটি গঠনগত দিক দিয়ে আশ্চর্যরকম সমান্তরাল ও একরৈখিক। এর অন্যতম কারণজ্জগুটিকয় শব্দ এখানে বারবার আবর্তিত হয়  (খড়ৎফ, ঋষঁব, ঝড়হম, মধৎষধহফ, মঁবংঃ, ষবরংঁৎব, রহংঃৎঁসবহঃ.) এবং একই প্রতীক কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে ফিরেফিরে আসে। সত্যিই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেখানে সুগ্রন্থিত, প্রতীকী এবং সংবেদনশীল, সেই একই কবিতা ইংরেজিতে হয়ে গেছে বিশৃঙ্খল! ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এর প্রথম পাঠে তার চিত্রময় প্রতীকী নির্মাণে বিস্ময় জাগে, কিন্তু একই চিত্রের অথবা অন্তর্গতভাবে অভিন্ন প্রতীকের পৌনঃপুনিক ব্যবহার ক্লান্তির কারণ হয়। এমনকি তার অনেক প্রতীকী চিত্র কানে সুন্দর শোনালেও তা খুব একটা অর্থবহ মনে হয় না। ‘ফৎঁহশ রিঃয ঃযব লড়ু ড়ভ ংরহমরহম, ও ভড়ৎমবঃ সুংবষভ ধহফ পধষষ ঃযবব ভৎরবহফ যিড় ধৎঃ সু ষড়ৎফ’, তাঁর এই প্রতীকী বক্তব্য, এডুইন হারবার্ট লুইসের ভাষায় : ‘শিশুসুলভ নি®পাপ দার্শনিকতায় পূর্ণ। এমন কথা আমরা মাঝে মধ্যে গির্জায় শুনতে পাই, অথবা বিচ্ছিন্ন নারী-পুরুষ বা শিশুর মুখে শুনতে পাই’। লুইস একে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘তাঁর এই শিশুসুলভ নিষ্পাপতার কারণে রবীন্দ্রনাথ মার্কিন মহিলাদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন’। এই কথার শুরুও করেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। শিকাগোতে একবার তিনি পরিহাস করে বলেন, ‘একদল স্বামী নামধারী ভারতীয় ধর্মপ্রচারকেরা সুন্দর সুন্দর কথা বলে এদেশের মেয়েদের বেশ ভজিয়ে ফেলেছেন’। অধ্যাপক লুইস শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কার্যত রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর নিজের কথাই স্মরণ করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের এই মিষ্টি ও আপাত অর্থহীন সুন্দর কথাকেই এডওয়ার্ড টমসন ‘প্রিটি প্রিটি ননসেন্স’ বলে বাতিল বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের কবিতা যে তার মূলের ছায়ামাত্র, এই কথাটি প্রথম যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থিত করেন এডওয়ার্ড টমসন। টমসন রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে তিনটি ব্যাকরণগত ত্র“টির কথা উল্লে¬খ করেন :
প্রথমত : রবীন্দ্রনাথ সবসময় ইংরেজি আর্টিকেলের (অর্থাৎ ধ, ধহ ও ঃযব) সঠিক ব্যবহার করতে পারতেন না।

দ্বিতীয়ত : পদান্বয়ী অব্যয় বা ঢ়ৎবঢ়ড়ংরঃরড়হ-এর ব্যবহারেও তাঁর দুর্বলতা ছিল।

তৃতীয়ত : ইংরেজি ইডিয়ম ব্যবহারেও তিনি ত্র“টিমুক্ত ছিলেন না।

টমসন অবশ্য স্বীকার করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অপূর্ব সুধামণ্ডিত। মাতৃভাষা ইংরেজি নয় অথচ এমন মিষ্টতায় সে ভাষা লিখতে সক্ষম এমন উদাহরণ, টমসনের কথায়, ‘খুব বেশি নেই’। তিনি বলেছেন, জোসেফ কনরাড (পোলিশ-ব্রিটিশ লেখক) ইংরেজি ভাষাকে আরো পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সে ভাষার চর্চা তিনি শুরু করেন শৈশব থেকে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষায় লেখা শুরু করেন যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ। কিন্তু ব্যকরণগত দক্ষতার প্রসঙ্গ ছাড়াও ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-কে মূল বাংলার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে যে বৈসাদৃশ্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে তা হলোজ্জঅনুদিত অনেক কবিতাই ভাবসংকোচনে আক্রান্ত, ঈশ্বরপ্রেমে জর্জরিত ও অতিতরল এবং আরোপিত ভাবালুতায় নিমজ্জিত। এর মধ্যে সবচেয়ে উলে¬খযোগ্য হলোজ্জমূল কবিতায় বৈষ্ণবীয় ভাবরস যা কখনো কখনো কামদপ্রভায় উজ্জ্বল, ইংরেজিতে তা স¤পূর্ণ অনুপস্থিত। ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এর সব কবিতাই এক ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত, তাতে আমি ও তুমির ভেদরেখা প্রায়শই অনুপস্থিত। কিন্তু বাংলায় তার সুরটি ভিন্ন, এখানে ঈশ্বরের মানস মূর্তিটি চোখের ওপর ঝলক যদি দেয়ও, তার পরিচয় কিন্তু প্রভুর নয়, প্রেমিকের। এই কথাটিকেই রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন এভাবে : ‘দেবতারে আমি যাহা দিতে পাই, দিই তা প্রিয়জনে/ প্রিয়জনে আমি যাহা দিতে পাই, তাই দিই দেবতারে/ আর পাবো কোথা?/ দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা’। এই তাঁর মূল প্রবণতা, গীতাঞ্জলিতে তো বটেই আর সবখানেও। এর কারণটাও স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথের মনের ভেতর এক নির্জন সন্ন্যাসীর বাস, তার পরিচয় আমরা পাই পনের বছর বয়সে প্রকাশিত বনফুল থেকেই। কিন্তু তিনি তো কেবল সন্ন্যাসী নন, প্রেমিকও বটে। আর বাঙালি পাঠকের কাছে সেটাই তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয়। গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণ প্রস্তুত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রেমিক পরিচয়টি গোপন রাখেন। ফলে পাউন্ড, ইয়েটস বা রদেনস্টাইন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষে মূল বাংলার সঙ্গে অনুবাদের এই তারতম্যের কথা জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না কখনও। আবার ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহম-এর গুণাগুণ নিয়ে প্রায়শই মতামতের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও পাউন্ড ও ইয়েটস বা রদেস্টাইন এই কবিতাগুলি পড়ে বিস্মিত হনজ্জকেননা গ্রন্থভুক্ত অধিকাংশ কবিতাই অভাবনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু গীতাঞ্জলির ২২ নম্বর কবিতাটিকে উদাহরণ হিসেবে  উলে¬খ করে বলেছেনজ্জযদিও স্বরবিতানের ১১ নম্বর এই গানটিকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রকৃতিপর্যায়ভুক্ত করেছেন, তবুও বাঙালি শ্রোতার কাছে এর আসল সুর প্রেমের’। তিনি এই গানটির অনুবাদকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন তাঁর কাব্যিক সৌন্দর্যের জন্য :

আজি     শ্রাবণঘন-গহন-মোহে
        গোপন তব চরণ ফেলে
    নিশার মতো নীরব ওহে
        সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।
ওহ ঃযব ফববঢ় ংযধফড়ংি ড়ভ ঃযব ৎধরহু ঔঁষু, রিঃয ংবপৎবঃ ংঃবঢ়ং,
ঃযড়ঁ ধিষশবংঃ, ংরষবহঃ ধং হরমযঃ, বষঁফরহম ধষষ ধিঃপযবৎং.
        প্রভাত আজি মুঁদেছে আঁখি,
        বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
        নীলাজ নীল আকাশ ঢাকি
        নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।
ঞড়-ফধু ঃযব সড়ৎহরহম যধং পষড়ংবফ রঃং বুবং, যববফষবংং ড়ভ ঃযব রহংরংঃবহঃ পধষষং ড়ভ ঃযব ষড়ঁফ বধংঃ রিহফ, ধহফ ধ ঃযরপশ াবরষ যধং নববহ ফৎধহি ড়াবৎ ঃযব বাবৎ-ধিশবভঁষ নষঁব ংশু.
    কূজনহীন কাননভূমি,
        দুয়ার দেওয়া সকল ঘরেজ্জ
    একেলা কোন পথিক তুমি
        পথিকহীন পথের ’পরে।
            হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
            রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
            সমুখ দিয়ে স্বপনসম
            যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।

ঞযব ড়িড়ফষধহফং যধাব যঁংযবফ ঃযবরৎ ংড়হমং, ধহফ ফড়ড়ৎং ধৎব ধষষ ংযঁঃ ধঃ বাবৎু যড়ঁংব. ঞযড়ঁ ধৎঃ ঃযব ংড়ষরঃধৎু ধিুভধৎবৎ রহ ঃযরং ফবংবৎঃবফ ংঃৎববঃ. ঙয সু ড়হষু ভৎরবহফ, সু নবংঃ নবষড়াবফ, ঃযব মধঃবং ধৎব ড়ঢ়বহ রহ সু যড়ঁংব, ফড় হড়ঃ ঢ়ধংং নু ষরশব ধ ফৎবধস.

মূলের সাথে অনুবাদের এই অর্থান্তর ও ভাবান্তর সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু নিজের মুগ্ধতাবসত বলেছেন, ‘মূল থেকে খুব সামান্য বিচ্যুত হয়ে যে রূপান্তর তিনি অর্জন করেছেন তা এককথায় অপূর্ব’। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর এই মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গত কারণেই দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে। ‘আজি শ্রাবণঘন-গহন-মোহে গোপন তব চরণ ফেলে /নিশার মতো নীরব ওহে সবার দিঠি এড়ায়ে এলে’, এই পঙক্তি কটি পাঠ করলেই বোঝা যায় সেই চরণে কী বিপুল ভয় আর কতোই না ব্যকুলতা। কিন্তু সেই ভাবটিরই অনুবাদ হিসেবে ‘ওহ ঃযব ফববঢ় ংযধফড়ংি ড়ভ ঃযব ৎধরহু ঔঁষু, রিঃয ংবপৎবঃ ংঃবঢ়ং, ঃযড়ঁ ধিষশবংঃ, ংরষবহঃ ধং হরমযঃ, বষঁফরহম ধষষ ধিঃপযবৎং’জ্জএই কথাগুলোকে শিশুপাঠ্য সরল গদ্যের মতো মনে হয়। আবার ‘বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি’, এই অপূর্ব বেদনাময় উচ্চারণের সঙ্গে মিল নেই ‘যববফষবংং ড়ভ ঃযব রহংরংঃবহঃ পধষষং ড়ভ ঃযব ষড়ঁফ বধংঃ রিহফ’ এই দীর্ঘ বাক্যবিন্যাসের। অথবা ‘হে একা সখা, হে প্রিয়তম’, হৃদয় নিংড়ানো এই হাহাকার উচ্চারণের পাশে ‘ঙয সু ড়হষু ভৎরবহফ, সু নবংঃ নবষড়াবফ’ বড়ই সাধারণ মনে হয় (যেমনটি ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান’-এর পাশে হাস্যকর মনে হয়, ঢ়ধঃঃবৎ ঢ়ধঃঃবৎ ৎধরহ ফৎড়ঢ়ং, ভষড়ড়ফ রহ ঃযব ৎরাবৎ'-কে)। তবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এই শর্তে একমত হওয়া যায় যে, বাংলা গানটি না জানা থাকলে একে অপূর্ব একটি ইংরেজি কবিতা বলে বিবেচনায় নিতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। এই গানের কথাগুলি কেবল হৃদয় ও বুদ্ধিকেই আকর্ষণ করে না, দেহকেও উষ্ণ করে, তার স্বাদ বাঙালি পাঠক ছাড়া আর কারো পক্ষে উদ্ধার অসম্ভব। আবার স্বরবিতান-এর অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতিবিষয়ক এবং একই রকম সৌন্দর্যমণ্ডিত আরেকটি বাংলা গান, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’জ্জএখানেও প্রকৃতির চেয়ে প্রেমের আহ্বান। গীতাঞ্জলির ১৮ নম্বর এই কবিতাটি বাঙালির কাছে একইসঙ্গে আনন্দ ও বেদনার, মিলনের ও বিচ্ছেদের। গানের কথাগুলি মনে পড়ে গেলেই আমরা গুনগুনিয়ে উঠি, মন ভরে ওঠে এক অস্থির অনির্বচনীয় আনন্দে। ইংরেজিতে কিন্তু এই মিলন ও বিচ্ছেদের দ্বৈত সুরটি অনুপস্থিত। ‘আঁধার করে আস্তে...’ এই বাক্যবন্ধনে নিষিদ্ধের যে আমন্ত্রণ ‘ধহফ রঃ ফধৎশবহং’-এ তার কণামাত্র নেই। ‘কর আমায় হেলা...’ এই কথার মধ্যে যে আহ্লাদমিশ্রিত অভিমান রয়েছে, ‘ওভ ঃযড়ঁ ংযড়বিংঃ সব হড়ঃ ঃযু ভধপব’, এই রূপান্তরের না আছে সেই কৌতূহল, না আছে তার উদ্বেগ। ‘দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি’, এই বাক্যের রূপান্তরে ‘ও শববঢ় মধুরহম ড়হ ঃযব ভধৎ ধধিু মষড়ড়স ড়ভ ঃযব ংশু,’ এতে যে চিত্রটি যুক্ত হয়েছে তা এক সাইজ বড় জামার মতো গায়ের সঙ্গে কেমন যেন বেঢপ ঝুলে থাকে। শুধু শেষ বাক্যাংশ, ‘পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে’, তার রূপান্তরে ‘সু যবধৎঃ ধিহফবৎং ধিরষরহম রিঃয ঃযব ৎবংঃষবংং রিহফ’ চমৎকার ছন্দময় মনে হয়। মূল বাংলায় এই গানটি কেবল বেদনার নয় প্রতীক্ষারও। একটি তীব্র বেদনায় সুর আছে বটে, কিন্তু প্রতীক্ষার কামনায় থরোথরো সে সুর। এই বিরহব্যাকুলমিলনতৃষ্ণায় অনুভূতির যে অন্তরঙ্গ আবেদন, ইংরেজিতে সেটি অনুপস্থিত। তার বদলে সেখানে কেবলই ভক্তি, কেবলি ভাগবতপ্রেম :

মেঘের ’পরে মেঘ জমেছে,
        আঁধার করে আসেজ্জ
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
        একা দ্বারের পাশে।
ঈষড়ঁফং যবধঢ় ঁঢ়ড়হ পষড়ঁফং ধহফ রঃ ফধৎশবহং. অয, ষড়াব, যিু ফড়ংঃ ঃযড়ঁ ষবঃ সব ধিরঃ ড়ঁঃংরফব ধঃ ঃযব ফড়ড়ৎ ধষষ ধষড়হব?
তুমি যদি না দেখা দাও
        কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
        এমন বাদল-বেলা।

ওভ ঃযড়ঁ ংযড়বিংঃ সব হড়ঃ ঃযু ভধপব, রভ ঃযড়ঁ ষবধাবংঃ সব যিড়ষষু ধংরফব, ও শহড়ি হড়ঃ যড়ি ও ধস ঃড় ঢ়ধংং ঃযবংব ষড়হম, ৎধরহু যড়ঁৎং.

এই গানটিতে দেখতে পাইজ্জইংরেজি রূপান্তরের সময় রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর মূল থেকে সরে এসেছেন, ফলে নতুন ভাষার পাশাপাশি সেই কবিতাগুলোও নতুন হয়ে উঠেছে, যাকে বলা যায়, ‘মূলানুগত নতুন সৃষ্টি’। কিন্তু তাহলে আমাদের এই চিরপ্রেমের চিরভালোলাগা গীতাঞ্জলির কী হবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা বোধহয় এভাবেই টানতে হবে যে, ছন্দের আঁটোসাঁটো বাঁধনে নির্মিত কবিতার অনুবাদ আক্ষরিক হয় না, হলে তার কাব্যিক শোভা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেকথা বলেছেন, ইংরেজি অনুবাদের সময় পশ্চিমা পাঠকের কাছে তা অধিক অর্থবহ ও সহজগম্য করার লক্ষ্যে তিনি মূলের হীরেজহরৎ খুলে নিয়েছেন। সেকথা মাথায় রেখেও বলা যায় বাংলা গানটি ও তার ইংরেজি রূপান্তর একে অপর থেকে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন। শুধু ভাষার সংকোচন নয়, বাণীর বিচ্যুতিও রূপান্তরিত কবিতার চরিত্র বদলে দিয়েছে। এ কেবল ভাষার সীমাবদ্ধতা নয়, ভাবসংকোচনের নির্বাচিত সিদ্ধান্তের ফলাফল। মূল গানের একটি গোপন, নিষিদ্ধ মাদকতা রয়েছে, ইংরেজি রূপান্তরে যা স¤পূর্ণ অনুপস্থিত। বাঙালি বৈষ্ণবপদাবলিতে রাধার কণ্ঠে এমন প্রতীক্ষাকাতর ও মিলনব্যাকুল উচ্চারণ অনেকবারই আমরা শুনেছি। কিন্তু ইংরেজি রূপান্তরটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি আসলে এক প্রতীক্ষারত প্রণয়প্রার্থী রমণীর রোদনসিক্ত নিবেদন। এখানে বক্তার ব্যকুলতায় কোনো সন্দেহ থাকে না এবং  একবার যখন বক্তার পরিচয় নির্ধারিত হয়ে যায়, তখন গানটির পরিবেশিত বাণীও স¤পূর্ণ নতুন দ্যোতনা অর্জন করে। ইংরেজি রূপান্তরে বক্তার পরিচয় যেন ইচ্ছাকৃতভাবে অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। বাংলা গানটি শুনে আমরা অনায়াসেই কল্পনা করে নিতে পারি ঘুমকাতুরে রমণীটির মনোভঙ্গের কারণ। যে প্রেমিকের অপেক্ষায় সে ছিল, নিশিথের আঁধার গায়ে জড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে তার কাছে সে ঠিকই আসে, এসে তার পাশে বসেও এবং নিজ গলা থেকে পুষ্পমাল্য তার বুকের ওপর রেখে নীরবে, নিভৃতে চলে যায়। ইংরেজি রূপান্তরে এর সবই অনুপস্থিত। যদিও বাঙালি পাঠক হিসেবে গীতাঞ্জলির গানের সুষম রূপান্তরের দাবি ও উপর্যুক্ত খেদ আমাদের নিতান্তই ঘরোয়া ব্যাপার। অমিয় চক্রবর্তী তাকে বলেন এভাবে, ‘গীতাঞ্জলিতে যা আছে, তার প্রত্যেকটিই হচ্ছে গান। গান মাত্রই সুরের অপেক্ষা রাখে, তা না হলে তার অন্তরতম ভাবরূপের পূর্ণ বিকাশ নেই। গানের মধ্যে কবি ইচ্ছে করেই সুরের জন্যে খানিকটা করে ফাঁক রেখে যান, সঙ্গীত সেই ফাঁকগুলি ভরে দেয়।’ এইসব বিবিধ  যুক্তি-তর্কের অবতারণা নানা বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক হলেও একথা তো ঠিক যে, এইসব গানের পেছনে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আবহের আবরণ রয়েছে, বাঙালি পাঠককে তা আলাদা করে ধরিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। নিশিথযামের সেই অজানা অতিথি, যার হাতে ছিল বীণা, গলায় ছিল পুষ্পমাল্য, তাকে আলাদা করিয়ে চিহ্নিত করা অপ্রাসঙ্গিক। সেই সাংস্কৃতিক আবহটি সরিয়ে নিলে গানের অর্থই বদলে যায় এবং অনিবার্য অর্থান্তর ঘটে। সেকথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও শেষ জীবনে এসে উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু তাতে কী? একথা তো বলাই যায় যে, অনুবাদঅসাধ্য এই গানগুলি নির্বাচন করে এবং তার এমন একরৈখিক ভাষান্তরের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজের কাব্যের প্রতি সুবিচার তো করেনইনি, বরং বাংলা কবিতার প্রতিও অবহেলা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বুঝেছিলেনজ্জতাঁর ইংরেজি ভাষায় লেখার চেষ্টার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, এমনকি বিদেশি স্বীকৃতি আদায়েরও কোনো দরকার ছিল না। আর এই কাজে শ্রম ও সময় ব্যয় করার ফলে রবীন্দ্রনাথ লজ্জিতই হয়েছিলেন। তাই তো (২৬ নভেম্বর ১৯৩২) রদেনস্টাইনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেনজ্জওঃ ধিং ধহ ধপপরফবহঃ ভড়ৎ যিরপয ও ভববষ ধষসড়ংঃ ধংযধসবফ ঃযধঃ ও যিড়ংব ঁহফড়ঁনঃবফ পষধরস যধং নববহ ৎবপড়মহরুবফ নু সু পড়ঁহঃৎুসবহ ঃড় ংড়াবৎবরমহঃু রহ ড়ঁৎ ড়হি ড়িৎষফ ড়ভ ষবঃঃবৎং ংযড়ঁষফ হড়ঃ যধাব ধিরঃবফ ঃরষষ রঃ ধিং ফরংপড়াবৎবফ নু ঃযব ড়ঁঃংরফব ড়িৎষফ রহ রঃং ড়হি ঃৎঁব সধলবংঃু ধহফ পড়হারৎড়হসবহঃ. রবীন্দ্রনাথের এই আত্মস্বীকৃতির ভেতর এক ধরনের আত্মধিক্কারের নীরব উচ্চারণ রয়েছে। বাংলায় তাঁর সাহিত্যকর্মের এক নিজস্ব প্রভা আছে, সে প্রভা রাজসিক ও স্বতন্ত্র প্রসাদগুণে মণ্ডিত, কিঞ্চিৎ শ্ল¬াঘার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুরনো বন্ধুকে সেকথা জানিয়েছেন। কিন্তু এই চিঠির মূল লক্ষ্য তো বিদেশি বন্ধু নন, তিনি নিজে। ভুলটা হয়েছিল তাঁর, সেজন্য তিনি নিজের কাছেই যেন ক্ষমা চাইছেন। এই চিঠির তিন বছর পর (১১ জুন ১৯৩৫ সালে) স্টার্জ মোরের কাছে এক দীর্ঘ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সে কথার পুনরাবৃত্তি করেন, সঙ্গে সঙ্গে এও বলেনজ্জ ইউরোপীয় পাঠক ও বোদ্ধা তাঁর লেখা পড়ে যদি এখন মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাতে তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি আরো বলেনজ্জ‘আমি জানি, তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত লেখা নিয়ে, তাতে ভিনদেশি চকমকি আর আপনাদের কাছে পরিচিত এমন ভাবভঙ্গি কথাবার্তা জুড়ে দিয়ে, আপনাদের গৌরবের প্রদেশে নাক গলানোর চেষ্টা করা আমার কিছুতেই ঠিক হয় নি। এ কাজ করে আমি নিজের প্রতিই অবিচারই করেছি। কাব্যের দেবী, যিনি তাঁর মন্দিরে যার যার নিজের জলবায়ু ও সংস্কৃতিতে লালিত পুষ্পমাল্য গ্রহণে ভালোবাসেন, তার প্রতিও আমি অবিচার করেছি। ভুল সময়ে তড়িঘড়ি করে নিজের নগদ পাওনা আদায়ের চেষ্টা, তা বড়ই অসম্মানজনক।’ মৃত্যুর ছয় বছর আগে লিখিত এই চিঠি অনুশোচনায় যেমন দীর্ণ তেমন আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত। তাঁর এই অনুশোচনার কারণজ্জএকদা গীতাঞ্জলি, এর অনুবাদ এবং নোবেল পুরস্কার বিষয়ক বিবিধ কারণে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেছেন। তাতে খ্যাতি পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু ক্ষতি যা হয়েছে তার পরিমাণও কম নয়। ইতিহাস উভয়ের কথাই লিখে রেখেছে যতœ করে। তবুও উপর্যুক্ত চিঠি পাঠের পর ভালোলাগার পরিমাণটা নিতান্তই কম নয়Ñ কেননা এই চিঠির মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে বাঙালি জাতির প্রতি কবির অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের কারণ হলো, তিনি দেরিতে হলেও বুঝেছিলেনÑ একদা ঝড়হমং ড়ভ ঙভভবৎরহমং-এর নাম পাশ্চাত্য থেকে হয়তো মুছে যাবে কিন্তু গীতাঞ্জলি দিনে দিনে বাঙালির সহজাত প্রেমে, স্বপ্নে, আশায়, ভালোবাসায় হয়ে উঠবে ইতিহাসের সমান বয়সী।



পুনর্মুদ্রণ


ভবানী মুখোপাধ্যায়
বিদেশে রবীন্দ্রনাথ

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই য়ুরোপে রবীন্দ্রনাথের কবি হিসাবে স্বীকৃতি মিলেছে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-বিজয়ের শুরু। রবীন্দ্রনাথ লণ্ডনে এসে পৌঁছেছিলেন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন। তারিখে। রবীন্দ্রনাথের হাতে ছিল তাঁর নানা কাব্যগ্রন্থের মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। এই অনুবাদও যে সার্থক এবং সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছিল তা নয়, তবুও রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের পরিচয় ছিল সেই অনূদিত কবিতাগুলিতে। এই বছর ১লা জুলাই তারিখে, অর্থাৎ লণ্ডনে পৌঁছানোর এক পক্ষ কালের মধ্যেই শিল্পী উইলিয়াম রথেনস্টাইন তাঁর বন্ধু জর্জ বার্নার্ড শ’কে যে চিঠিখানি লিখেছিলেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই চিঠিতে রথেনস্টাইন তথা বিদগ্ধ ইংলণ্ডের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পাওয়া যাবে :
...আমার একান্ত বাসনা তুমি এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখে যাও। একদিন এসে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে যাও। বাংলার সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, প্রজ্ঞা, ধর্ম, আভিজাত্য, গণতন্ত্র প্রভৃতি সবকিছুরই প্রতিনিধি এই রবীন্দ্রনাথ। ভারতের আর কোনও দূত যদি আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব না হয় তা হলে এই একটি মানুষকে দেখেই ধারণা করা যাবে যে ভারতবর্ষ সারা বিশ্বের মধ্যে এক সার্থকতম দেশ।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উইলিয়াম রথেনস্টাইনের পরিচয় এর কয়েক বছর আগে ভারতবর্ষে ঘটেছিল। রথেনস্টাইন এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে, সেই সূত্রে আলাপ। রবীন্দ্রনাথ সেই যোগসূত্র ধরেই লণ্ডনে পৌঁছে উইলিয়াম রথেনস্টাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কথাপ্রসঙ্গে একদিন কয়েকটি কবিতার অনুবাদ পাঠ করে শোনালেন রথেনস্টাইনকে। কবিতাগুলি রথেনস্টাইনকে মুগ্ধ করল। তার কয়েকটি বেছে নিয়ে টাইপ করিয়ে রথেনস্টাইন তাঁর যে সব বন্ধুদের পাঠালেন তাঁদের মধ্যে ইয়েট্স, স্টপফোর্ড-ব্র“কস্ ও ব্রাডলি উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, এঁরা সকলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে অভিভূত ও বিস্মিত হলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাঁদের ভাল লেগেছে। কবিও এই উৎসাহ ও প্রশস্তি লাভে পুলকিত হলেন।

রথেনস্টাইন এই অভাবনীয় উৎসাহ লক্ষ্য করে আনন্দিত হলেন এবং তাঁর বাসভবনে এক বৃহত্তর মজলিসের আয়োজন করলেন। এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত হলেন মে সিনক্লেয়ার, ইভিলিন আণ্ডারহিল, আর্নস্ট রিস্, ফক্স-স্ট্রাংওয়েজ, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, এজরা পাউণ্ড, এলিস মেনেল, হেনরী নেভিনসন প্রভৃতি। সেদিনকার অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে শোনালেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্স।

এই দিনই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম দেখলেন চার্লস এনড্রুজকে, তিনি তখন দিল্লীর সেন্ট স্টীফেন্স কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন।
ইংরেজি সংস্করণ গীতাঞ্জলির মোট ১০৩টি কবিতার ৫১টি গীতাঞ্জলির, ১৭টি গীতিমাল্যর, ১৬টি নৈবেদ্যর, ১১টি খেয়ার, ৩টি শিশুর, আর বাকিগুলি চৈতালী, স্মরণ, কল্পনা, উৎসর্গ, অচলায়তন থেকে একটি করে গৃহীত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
“এরঃধহলধষর-(ঝড়হম ঙভভবৎরহমং)-অ পড়ষষবপঃরড়হ ড়ভ ঢ়ৎড়ংব ঃৎধহংষধঃরড়হং সধফব নু ঃযব ধঁঃযবৎ ভৎড়স ঃযব ড়ৎরমরহধষ ইবহমধষর-রিঃয ধহ ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ নু ড. ই. ণবধঃং : চৎরহঃবফ ধঃ ঃযব ঈযরংরিপশ চৎবংং ভড়ৎ ঃযব ওহফরধ ঝড়পরবঃু” :
ইংরেজি গীতাঞ্জলির এই টাইটেল পেজ। এই গ্রন্থের ৭৫০ খণ্ড মাত্র ছাপা হয়, তার মধ্যে ২৫০ খানি সর্বসাধারণের মধ্যে বিক্রির ব্যবস্থা ছিল।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : “বাংলা গীতাঞ্জলির কবিতা আপনমনেই ইংরেজীতে তর্জমা করেছিলুম। শরীর অসুস্থ ছিল, আর কিছু করার ছিল না। কোনও দিন এগুলি ছাপা হবে এমন স্পর্ধার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। তার কারণ প্রকাশযোগ্য ইংরেজি লেখার শক্তি আমার নেই-এই ধারণাই আমার মনে বদ্ধমূল ছিল।

খাতাখানা যখন কবি ইয়েটসের হাতে পড়ল তিনি একদিন রথেনস্টাইনের বাড়িতে অনেকগুলি ইংরেজ সাহিত্যিক  ও সাহিত্যরসজ্ঞকে তার থেকে কিছু আবৃত্তি করে শোনাবেন বলে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি মনের মধ্যে ভারী সঙ্কুচিত হলেম। তার দুটি কারণ ছিল। নিতান্ত শাদাসিধে ধরনের দশবারো লাইনের কবিতা শুনিয়ে কোনদিন আমি কোনও বাঙালি শ্রোতাকে যথেষ্ট তৃপ্তি পেতে দেখিনি। ...ইয়েটস সেদিনকার সভায় পাঁচ-সাতটি মাত্র কবিতা একটির পর আর একটি শুনিয়ে পড়া শেষ করলেন। ইংরেজ শ্রোতারা নীরবে শুনলেন। নীরবে চলে গেলেন-দস্তুর পালনের উপযুক্ত ধন্যবাদ পর্যন্ত আমাকে দিলেন না। সে রাত্রে নিতান্ত লজ্জিত হয়ে বাসায় ফিরে গেলাম।
পরের দিন চিঠি আসতে লাগল। দেশান্তরে যে খ্যাতি লাভ করেছি তার অভাবনীয়তার বিস্ময় সেই দিনই সম্পূর্ণভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।” (তীর্থংকরÑদিলীপকুমার রায়। পৃ. ১৩৮)
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সংশয়াচ্ছন্ন, বাংলা কবিতার ইংরেজি তর্জমা, কেমন হবে। কতটুকু বা পাওয়া যাবে। য়ুরোপকে আকর্ষণ করবে বাংলাদেশের কবির এই স্বল্পায়তন কবিতা? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ঋড়ৎঃহরমযঃষু জবারবি নামক বিখ্যাত পত্রিকায় কবি এজরা পাউণ্ড-কৃত সুদীর্ঘ সমালোচনায়। প্রবন্ধটি যখন প্রকাশিত হয়, তখনও কবি নোবেল প্রাইজে সম্মানিত হন নি, তাই এই প্রবন্ধটি বিশেষ মূল্যবান। এজরা পাউণ্ড লিখেছেন :

...শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুচ্ছের প্রকাশ (এরঃধহলধষর) আমার কাছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। পাঠক হয়তো আমার বক্তব্য ঠিক বুঝবেন না, আমার বক্তব্য কবির কাব্যে প্রমাণিত। এই কবিতা ধীরে, শান্ত পরিবেশে ও উঁচু সুরে পাঠ করতে হবে। এই কবিতার অনুবাদক স্বয়ং সুরকার, তাই সেই মহৎ শিল্পীর অভিব্যক্তি সূক্ষ্ম সঙ্গীতের মাধ্যমে।
মাসাধিক কাল কবি ইয়েটসের ভবনে গিয়ে দেখেছিলাম এই মহাকবির আগমনে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন, এই কবি আমাদের চেয়ে মহৎ ও বিরাট। কোথায় যে আমার বক্তব্য শুরু করি তাই ভাবছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা পাঁচ কোটি। প্রথম নজরে মনে হবে রেলগাড়ি আর গ্রামোফোন দেশটাকে আচ্ছন্ন করেছে। কিন্তু এহ বাহ্য, এই দেশের অন্তঃসলিলা সংস্কৃতি আধুনিক প্রঁভেসের সঙ্গে তুলনীয়। এই বাংলাদেশের মহাকবি ও গীতিকার শ্রীযুক্ত ঠাকুর। জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, সেই সুর ‘লা মার্সাই’-এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাঁর ‘সোনার বাংলা’ শুনলাম। সম্পূর্ণ প্রাচ্য সুর, অপূর্ব তার মাদকতা, জনতাকে স্পর্শ করার শক্তি তার আছে। হালকা চালের গান, ঢঙটা ঘনিষ্ঠ এবং উদ্দীপনাময়।

এই কথা উল্লেখ করার হেতু এই যে এতদ্বারা সহজেই বোঝা যাবে যে দাস্তে বর্ণিত মহাকাব্যের ত্রিবিধ গুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করায়ত্ত, যথা-প্রেম, দেশাত্ববোধ ও আত্মার মুক্তি।
এজরা পাউণ্ড তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ, এবং মহৎ কবির লক্ষণ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূত। রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠের সময় সহসা সেই কক্ষে গৃহকর্ত্রীর ছোট মেয়ে এসে হৈ-হৈ শুরু করল, কবি কবিতা থামিয়ে হেসে উঠলেন। এজরা পাউণ্ডের এই দৃশ্য ভাল লেগেছে। মনে প্রশ্ন জেগেছে নন্দনতত্ত্ব আলোচনা আর শিশুর হাসি কি একই সুরে বাঁধা?

তারপর রবীন্দ্রনাথের কবিতার গুনাগুন বিচারকালে বলেছেন :
...এই কবিতায় আছে এক নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতা, যেন সহসা নবীন গ্রীসকে আবিষ্কার করলাম। য়ুরোপে রেনেসাঁসের কালে যেমন ফিরে এসেছিল ভারসাম্য, তেমনই একালের যান্ত্রিক ঘূর্ণী হাওয়ার মধ্যে এক সংস্কৃত, শান্ত, মধুরতার পরিবেশ আবির্ভূত হল। অডিসির নীতি “শরীর সুস্থ থাকলেই মন সুস্থ’। মধ্যযুগীয় অস্পষ্ট মানসিকতা এই নীতিকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারে নি। বিভ্রান্ত চিন্তাকে মুক্ত করে নি। রবীন্দ্রনাথ এনেছেন সুস্থ সুস্থিরতা।
এ আমার আকস্মিক অত্যুক্তি নয়, উচ্ছ্বাস নয়, প্রায় মাসাধিককাল এই বিষয়ে চিন্তা করেছি। শ্রীযুক্ত ঠাকুরের যে সমস্ত রচনা আজও অনূদিত হয় নি সে বিষয় বলার সময় আসে নি তবে যে কাব্যগ্রন্থ আমার হাতে আছে তার সঙ্গে তুলনা করার জন্য যে গ্রন্থ মনে পড়ছে তার নাম দান্তের পারডিসো।
এই সুদীর্ঘ উদ্ধৃতিটুকু না দিলে এজরা পাউণ্ডের বিরাট আলোচনার পরিচয় পাঠককে দেওয়া সম্ভব হত না। এই প্রবন্ধে নিঃসন্দেহে সেই কালেই রবীন্দ্রনাথ কি ভাবে ইংলণ্ডের বিদগ্ধ সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যাবে। পাউণ্ড এই প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে নিজেকে অতিশয় অসভ্য বন্য বর্বর বলে মনে হয়-যেন আদিমযুগের মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের লণ্ডন যাত্রা সবদিক থেকেই সার্থক হয়েছিল। তিনি লণ্ডন পৌঁছানোর এক মাসের মধ্যেই ঞযব ঘধঃরড়হ নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের কর্তৃপক্ষ ‘ত্রেকোদারো হোটেলে’ কবি-সম্বর্ধনায় এক বিরাট পার্টির আয়োজন করেন। এই সম্বর্ধনা ভোজে বিদগ্ধ ইংরেজ সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। এই সময়েই জন মেসফিলড্, বারট্রাণ্ড রাসেল, এইচ. জি. ওয়েলস প্রভৃতির সঙ্গে কবির পরিচয় ঘটে।

এই সম্বর্ধনা ও খ্যাতির মূলে গীতাঞ্জলির সেই কয়েকটি অনূদিত কবিতা। ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন- “এই কবিতাগুলি আমি লিখব বলে লিখিনি, এ আমার জীবনের ভেতরের জিনিস-এ আমার সত্যিকারের আত্ম নিবেদন-এর মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত সুখ, দুঃখ, সমস্ত সাধনা মিলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে। এই জীবনের জিনিস জীবনের ক্ষেত্রে আদর পায় এ কথা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু এ কথা বোঝানো শক্ত।” [চিঠিপত্র ৫ম খণ্ড ]

রবীন্দ্রনাথের কাব্যের যে সামান্যতম নমুনা য়ুরোপ সেদিন পেয়েছিল তাতেই তারা মেতে উঠেছিল। কারণ, তার মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল নতুন দিগন্তের আভাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ছিল এক অনাবিষ্কৃত জগতের আভাস, সারা বিশ্বের নয়নে তাই কবির কবিতা সেদিন ধাঁধা লাগিয়েছিল।
বারবার রবীন্দ্রনাথের মনে প্রশ্ন জেগেছে কি আছে আমার কবিতায়, যা নিয়ে এই বিদেশির দল এমন মেতে উঠেছে। তাঁর প্রশ্নের জবাবে সেদিন তাঁরা বলেছিলেন-আমরা যা করতে চাই, যা করতে চেয়েছি, তুমি তাই করেছ, তাই এই অভিনন্দন।

আঁদ্রে জিদের জার্নালে আছে যে ডাকঘরের ইংরেজি অনুবাদের প্র“ফকপি যখন ম্যাকমিলন কোম্পানি তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন তখন তিনি এমনই আত্মহারা হয়ে পড়েন যে সেই রাতেই তারযোগে ফরাসি অনুবাদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। আঁদ্রে জিদ গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদও করেছিলেন। সেদিনও তিনি উত্তেজিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বলেছিলেন-তোমার মত কবির পথ চেয়েই বসেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদের সুদীর্ঘ ভূমিকাশেষে যে কথা আঁদ্রে জিদ বলেছেন, তার মধ্যে তাঁর সব বলা হয়েছে মনে করি-“গীতাঞ্জলির শেষ কটি কবিতায় মৃত্যুর মন্ত্র ধ্বনিত। এর চেয়ে ভাবগম্ভীর ও সুমধুর সুর আমি কোনও দেশের কোনও সাহিত্যে আর শুনি নি।”
য়ুরোপ সেদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে পেয়েছিল শান্তি ও সান্ত্বনা। জীবনের রহস্যলোকের চাবিকাঠি, তাই সারা পৃথিবী ভারতবর্ষের কবিকে সেদিন এইভাবে দু বাহু প্রসারিত করে হৃদয়ে গ্রহণ করেছিল।
এই ১৯১২ খ্রিস্টাব্দেই রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা যাত্রা করেন, তারপর সারা আমেরিকা ভ্রমণ করে আবার লণ্ডন হয়ে স্বদেশে ফেরেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর। নোবেল পুরস্কারের সংবাদ ভারতে আসে ১৩ই নভেম্বর ১৯১৩।

রবীন্দ্রনাথের এই আমেরিকা ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ অতি সুন্দর ভাবে লিখেছেন মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর “বিশ্বের চোখে বিশ্বকবি” নামক প্রবন্ধাবলীতে (যুগান্তর)। এই কালে তাঁর ইংরেজি এরঃধহলধষর-র ম্যাকমিলন সংস্করণ এধৎফবহবৎ এবং ঈৎবংপবহঃ গড়ড়হ প্রকাশিত হল, ইংরেজি এরঃধহলধষর-র প্রথম প্রকাশক ‘চিত্রাঙ্গদা’র ইংরাজী অনুবাদ ঈযরঃৎধ প্রকাশ করলেন।

রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় প্রদত্ত বক্তৃতাবলী ‘চবৎংড়হধষরঃু’, এবং লণ্ডনে ক্যাকস্টন হলে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্রদত্ত বক্তৃতাবলী ‘ঝধফযধহধ’ নামক প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় ঐতিহ্য ধর্ম দর্শন ইত্যাদি বিষয়েই এইসব প্রবন্ধে কবি আলোচনা করেছেন।
এর পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি জাপান ভ্রমনে গিয়েছিলেন। তখন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ঋৎঁরঃ এধঃযবৎরহমÑবিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত ৬৭ টি কবিতার সংকলন এই গ্রন্থে পরিবেশিত। জাপানে কোবে শহরে রবীন্দ্রনাথকে যেদিন “জাপানি সাংবাদিক সমিতি” সম্বর্ধনার আয়োজন করেন সেইদিন কাউণ্ট ওকুমা জাপানী ভাষায় কবিকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন, কবি তাঁর প্রতিভাষণ দিয়েছিলেন বাংলা ভাষায়। জাপানে রবীন্দ্রনাথ “ঞযব ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ ঔধঢ়ধহ” এবং “ঞযব গবংংধমব ড়ভ ওহফরধ ঃড় ঔধঢ়ধহ” এই দুটি বিষয়ে বক্তৃতাদান করেন, রবীন্দ্রনাথের অপ্রিয় সত্যভাষণের ফলে জাপানি কর্তৃপক্ষরা তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হন। এই সময়েই ভারতীয়দের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ কানাডার ভ্যানকুবেরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যন করেন।
আমেরিকার ‘স্বর্ণপ্রীতি’ ও ‘অর্থগৃধুতা’র প্রতি কবির কটাক্ষে সে দেশেও তাঁকে অপ্রীতিভাজন হতে হয়েছে। সত্যভাষণে এবং সত্যনিষ্ঠায় অচঞ্চল রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজের বক্তব্যকে অনুচ্চারিত রাখেন নি।
এই সূত্রে ‘চবৎংড়হধষরঃু’ নামক প্রবন্ধসংগ্রহ থেকে পশ্চিম সম্পর্কিত উক্তিটি বিশেষ, অর্থসূচক। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
ঞযব বিংঃ সধু নবষরবাব রহ ঃযব ঝড়ঁষ ড়ভ গধহ, নঁঃ ংযব ফড়বং হড়ঃ ৎবধষষু নবষরবাব ঃযধঃ ঃযব ঁহরাবৎংব যধং ধ ঝড়ঁষ. ণবঃ ঃযরং রং ঃযব নবষরবভ ড়ভ ঃযব ঊধংঃ, ধহফ ঃযব যিড়ষব সবহঃধষ পড়হঃৎরনঁঃরড়হং ড়ভ ঃযব ঊধংঃ ঃড় সধহশরহফ রং ভরষষবফ রিঃয ঃযরং রফবধ.
বিশ্বের সঙ্গে মানুষের নিবিড় আত্মিক যোগ। এই সংযোগই বিশ্বেরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে, এই বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ছিল।
আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ এ শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ভারতের মাটি থেকে লাভ করে বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছেন। প্রায় এই কালেই বলেছেন-আমাদের সভ্যতার জন্ম অরণ্যে, সেই জন্মলগনে পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তার প্রবৃত্তিকে গড়ে তুলেছে। ক্যাকস্টন হলে যে সব বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার মধ্যে বলেছেন :
...যিবহ ধ গধহ ফড়বং হড়ঃ ৎবধষরংব যরং শরহংযরঢ় রিঃয ঃযব ড়িৎষফ, যব ষরাবং রহ ধ ঢ়ৎরংড়হ-যড়ঁংব যিড়ংব ধিষষং ধৎব ধষরবহ ঃড় যরস.” (ঝধফযধহধ)

৩০ শে মে ১৯১৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের অত্যাচারের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। লর্ড চেমসফোর্ডকে তিনি জানালেন : “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি”-(ঝঁৎঢ়ৎরংবফ রহঃড় ধ ফঁসঢ় ধহমঁরংয ড়ভ ঃবৎৎড়ৎ.) বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের এই বিচিত্র প্রতিবাদে সেদিন ঘরে-বাইরে একটা বিস্ময়ের ঢেউ জেগেছিল। এর পর ১৯২০তে রবীন্দ্রনাথ আবার য়ুরোপ যাত্রা করলেন। আগা খাঁকে জাহাজে সহযাত্রী হিসাবে পেয়েছিলেন। তিনি কবিকে হাফিজ আবৃত্তি করে শোনাতেন, মাঝে মাঝে সুফীবাদ সম্পর্কে আলোচনাও করতেন। লণ্ডনে পৌঁছে রথেনস্টাইন হাডসন, বার্নার্ড শ, ফকস্-স্ট্রাংওয়েজ, নিকোলাস রোয়েরিখ্, কানিংহাম গ্রেহাম প্রভৃতির সঙ্গে দেখা হল। ১৯শে জুন তারিখে অক্সফোর্ডে এক ছাত্রসভায় কবির ভাষণ দানের কথা। ডা. রবার্ট ব্রীজেসের সেদিন সভাপতিত্ব করার কথা। তিনি তখন ইংলণ্ডের রাজকবি। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না, চিঠি লিখে জানালেন :

...ও ফড় হড়ঃ ভববষ ধনষব ঃড় ধপপবঢ়ঃ ঃযব রহারঃধঃরড়হ, যিরপয ও যধাব লঁংঃ ৎবপবরাবফ, ঃড় ংঢ়বধশ ধঃ ঃযব সববঃরহম রহ ঙীভড়ৎফ ড়হ ভৎরফধু-ও ধস ৎিরঃরহম, বংঢ়বপরধষষু ধং ও হবাবৎ ংবহঃ ধহু ধহংবিৎ ঃড় ুড়ঁৎ ংবাবৎধষ পড়সসঁহরপধঃরড়হং ংরহপব ঃযব ষধঃব ফরংঃঁৎনধহপবং রহ রহফরধ.... [পুরুষোত্তম রবীন্দ্রনাথ-অমল হোম : পৃ. ৮১]
মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ নামক গ্রন্থেও এ কথার উল্লেখ আছে :
ওদের ওটা খুব অপমান লেগেছিল। তারপর ইংলণ্ডে গিয়ে দেখলাম-ওরা সে কথা ভুলতে পারছে না। ইংরেজ রাজভক্ত জাতÑরাজাকে প্রত্যাখ্যান তাই অত আঘাত দিয়েছিল ওদের।
কবি ইংলণ্ডের এই শীতল অভ্যর্থনা থেকে নি®ৃ‹তিলাভের জন্যই (রিঃয ধ ভববষরহম ড়ভ ৎবষরবভ ভৎড়স ংঃঁফরবফ পড়ড়ষহবংং) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছলেন। কবি এই সময়ে ফ্রান্সের ধনকুবের মঁসিয়ে কানের গৃহে অতিথি হয়েছিলেন। এই সুযোগে তিনি যুদ্ধের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং অত্যন্ত বেদনাবোধ করেছিলেন। ফ্রান্সের প্রখ্যাত মহিলা কবি কঁতেস দ্য নোয়াইলে এই সময়েই কবিকে জানান যে, ঠিক যে কালে মহাযুদ্ধ ঘোষিত হল সেই মুহূর্তে তিনি এবং মঁসিয়ে ক্লেমেন্সো রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদ পড়েছিলেন। যুদ্ধের হতাশা, জ্বালা এবং তীব্রতার নিদারুণ অশান্তি থেকে নি®ৃ‹তি লাভের জন্য ভারতীয় কবির কবিতাই সেদিন তাঁদের মনে শান্তি ও স্বস্তি দান করেছিল।
আরেকটি অনুরূপ কাহিনী এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ঠিক যেদিন মহাযুদ্ধের অবসান ঘটল, সেইদিন তরুণ ইংরেজ কবি উইলফ্রেড ওয়েনের শেলের আঘাতে মৃত্যু হয়-সম্ভবত ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে! তাঁর ব্যক্তিগত জিনিস ও কাগজপত্র তাঁর শোকসন্তপ্ত জননীর কাছে ‘ওয়ার অফিস’ থেকে পাঠানো হল। সেই বৃদ্ধা ওয়েনের নোটবই পড়তে পড়তে আবিষ্কার করলেন কয়েক ছত্র কবিতা এবং তার তলায় লেখা আছে এই কয় ছত্র (কবিতাটি স্মরণে নেই) আমার মনে এই দুঃসময়ে অতিশয় শান্তিদান করেছে। বৃদ্ধা কোনদিন ঠাকুর কবির নাম শোনেন নি, তবু কবিকে সন্ধান করে তাঁর ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে একবার শুনেছিলাম যে তাঁরা যখন ফ্রান্সে তখন কবিকে একবার ট্যাক্সি চড়ে কোথায় যেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নেমে যাওয়ার পর ট্যাক্সিচালক শ্রীযুক্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে প্রশ্ন করেনÑএই ঋষিতুল্য মানুষটি কে! শ্রীযুক্ত চট্টোপাধ্যায় বললেনÑহিন্দুকবি রবীন্দ্রনাথ টেগোর।

এই কথা শোনার সঙ্গেই সেই ট্যাক্সিচালক সবিনয়ে তার ভাড়া প্রত্যাখ্যান করল। বললÑআমি কবির ডাকঘর নাটকের ফরাসী অনুবাদ পাঠ করে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি, তাঁকে বহন করেছি এ আমার সৌভাগ্য। কি করে ভাড়া নেব?-ঘটনাগুলি সামান্য হলেও অসামান্য। সর্বসাধারণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কি ভাবে সংযোগ ঘটেছিল এ তারই পরিচয়।
রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনী নাটকটিও ফ্রান্সে বিশেষ সমাদর লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ফাল্গুনী সম্পর্কে এক জায়গায় বলেছেন, “শারদোৎসব থেকে ফাল্গুনী পর্যন্ত যতগুলি নাটক লিখেচি, যখন বিশেষ করে মন দিয়ে দেখি তখন দেখতে পাই প্রত্যেকের ভিতরকার ধুয়োটা ওই একই-জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পরিচয় চাই। এই তত্ত্ব য়ুরোপ বুঝেছে।”
খবং ঘড়াঁবষষবং খরঃঃবৎধরৎবং নামক ফরাসি সাহিত্য পত্রিকায় ফাল্গুনীর যে সুদীর্ঘ সমালোচনা প্রকাশিত হয়, প্রমথ চৌধুরী মহাশয় তার একটি বঙ্গানুবাদ করেন। ফরাসী লেখকের বক্তব্যের সামান্য অংশ উদ্ধৃত করা হল, শেক্সপীয়রের ‘অ গরফংঁসসবৎ ঘরমযঃ’ং উৎবধস নামক নাটকের সঙ্গে তুলনা করে লেখক বলেছেন :
আমার বিশ্বাস যে বিলাতের মহা-নাট্যকার তাঁর ফুরফুরে কল্পনার খেলা দেখিয়ে কেবল আমাদের চিত্তবিনোদন ও চিন্তার ভার অপনোদন করতে চেয়েছিলেন। অপরপক্ষে হিন্দু মহাকবি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে তাঁর ফাল্গুনীতে আমাদের একটি সর্বজনীন তত্ত্বের উপদেশ দেওয়া। তিনি পৃথিবীর চিরযৌবনের উৎসব সম্পাদনে রত... (সবুজপত্র-জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)

ফাল্গুনীর মূল সুর যৌবনের এগিয়ে চলার বাণী য়ুরোপকে সেদিন আনন্দ দিয়েছে।
জার্মানির কাপুত শহরে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার ঘটে। সেই সময় আইনস্টাইন প্রশ্ন করেন জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও দৈবশক্তিতে কি আপনি বিশ্বাসী?
উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন বিচ্ছিন্ন শক্তি নয়, মানুষের সীমাহীন ব্যক্তিত্ব বিশ্বকে ধারণায় আনে। মানুষের ব্যক্তিত্বের আয়ত্তে সবকিছু আসে। বিশ্ব সত্য, মানুষ সত্য। প্রোটন ও ইলেকট্রন এবং তাদের পরস্পরের মধ্যকার ফাঁকটুকু মিলেই বস্তু গড়ে ওঠে। তবু বস্তুর আপাতকঠিন রূপ। তেমনই ব্যক্তিসমূহ নিয়ে বিশ্বমানব, ব্যক্তির মধ্যে আছে মানবসম্বন্ধের সংযোগ এবং এই সংযোগই মানুষকে জীবন্ত ঐক্যে বেঁধেছে। সমগ্র বিশ্ব এইভাবে সংশ্লিষ্ট। এই হল মানবীয় বিশ্বের আহুতি। আমি সেই ভাবধারাকেই শিল্প, সাহিত্য ও মানুষের ধর্ম-জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রকাশ করেছি।
সুদীর্ঘ কথোপকথন-শেষের লাইনটিতে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রকাশিত। তাই তাঁর চিত্রপ্রদর্শনীর পরিচয় পত্রিকায় ফরাসি মহিলা কবি কঁতেস দ্য নোয়াইলস লিখেছেন ঃ
“ঐড়ি হড়নষব যব ধিং ধহফ ঁহংঃরহঃবফ ঃযরং রিংব সধহ, রহ পড়সসঁহরড়হ রিঃয যরসংবষভ, বহরমসধঃরপধষ ধহফ ুবঃ ঃৎধহংঢ়ধৎবহঃ, ষরশব ঃযব ঝরষাবৎ ঝবধ!”
রবীন্দ্রনাথের ছবিও য়ুরোপকে সেদিন বিস্মিত করেছিল, স্তব্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে যখন বার্লিনে গিয়েছিলেন তখন সেখানে তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা দান করা হয়। এমনই একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তৎকালীন (১৯২০-২৬) বার্লিনস্থ ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ভাইকাউন্ট জি এবারনন। সেই ডায়রির সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি :

জুন ৩, ১৯২১। গতকাল ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসেছিলেন। কি সুন্দর মূর্তি, সাধুমানবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তরঙ্গায়িত চুল আর দাড়িতে রমণীয় আকৃতি। যীশুখ্রিস্টের যে মূর্তি আমাদের কল্পনায় গড়া তার চেয়ে মনোহর। তাঁর ধীর, মৃদু, মসৃণ কণ্ঠস্বর আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্ক্যানডানভিয়া ও জার্মানিতে তিনি বিপুল অভ্যর্থনা লাভ করেছেন।

গতকাল হেলেন, (লেডী ডি এবারনন, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রোসবেরীর কন্যা) একটি সভায় তাঁর কবিতাপাঠ শুনতে গিয়েছিল, সভাগৃহের ভেতরে তো ভিড়ের জন্য ঢুকতে পারে নি, এমন কি সেই রাস্তাতেই পৌঁছতে পারে নি, এমনই প্রচণ্ড জনসমাগম হয়েছিল।...
সেদিন য়ুরোপ নির্লিপ্ত, আত্মস্থ, নৈর্ব্যক্তিক রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবে বিস্মিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপকে বারবার দেখেছেন অন্তরঙ্গভাবে, তার পোশাকী ও আটপৌরে চেহারা রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়েছে। তিনি সত্যভাষণে চিরদিনই নির্ভিকত্ব দেখিয়েছেন। তাই ভাইকাউণ্ট ডি এবারননের সেই ১৯২১ সনের ডায়েরির সামান্য কয়েকটি কথার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ-সম্পর্কিত স্পষ্ট উক্তি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা উচিত। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালান্তরে প্রাক্-মহাসমরের য়ুরোপ ও সমরোত্তর য়ুরোপে ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে যে বিরোধ বেধেছে তা বলেছেন। য়ুরোপের সংস্কৃতিতে মনুষ্যত্ব আজ নির্বাসিত, সেখানে স্থানাধিকার করেছে পশুবল। খ্রিস্টিয় নীতির বাক্য ঠাণ্ডা সিন্দুকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মুখোশ খুলে পড়েছে য়ুরোপের-তার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে তার পশুপ্রকৃতি। মানুষের অধ্যাত্ম সম্পদকে বিকশিত করতে হবে, মানুষকে তার স্বর্ণসিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে-এই ছিল রবীন্দ্রনাথের বাণী।

প্রমথ চৌধুরী মহাশয় লিখেছেন :
রবীন্দ্রনাথের বাণী ইউরোপের বহুলোকের মনে যে প্রবেশ করেছে ও স্থান পেয়েছে এটা হচ্ছে ইউরোপের গৌরবের কথা। এ থেকে শুধু এই প্রমাণ হয় যে ইউরোপের বহুলোক শিক্ষা-দীক্ষার ফলে সেই মন লাভ করেছে, যে মন পৃথিবীর সকল দেশের সকল জাতের বড় কথা সাদরে গ্রহণ করতে পারে।Ñ (সবুজ পত্রÑশ্রাবণ ১৩৩৪)
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কবি চীন এবং জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য তাঁর সাম্য ও মৈত্রীর বাণী সব দেশেই সমান সাড়া জাগিয়েছে। চীনা তরুণ সম্প্রদায়ের ডা. হু সী কবির গুণমুগ্ধ ভক্ত শিষ্য হয়ে পড়েন। জাপানে কবির সঙ্গে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সাক্ষাৎকার ঘটে। জুলাই মাসে কবি স্বদেশে ফিরে আসেন।

এই ১৯২৪ সনের সেপ্টেম্বর আবার দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা করেন। পেরুর স্বাধীনতা-শতবার্ষিকীর আমন্ত্রণ কবি গ্রহণ করেছিলেন। সান ইসাডোরে গুণমুগ্ধ ভক্ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পের সুন্দর বাগানবাড়িতে কবি কিছুদিন বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এই সময়ে পূরবী অধিকাংশ কবিতাবলী লিখিত হয়, পূরবীর এই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকেই কবি ‘বিজয়’ নামে উৎসর্গ করেন। এই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ১৯৩০ সনের মার্চ মাসে কবির শিল্পপ্রদর্শনীর ব্যাপারেও বিশেষ সাহায্য করেন।

১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে কবি ইতালি যাত্রা করেন। মুসোলিনী কবির সঙ্গে দেখা করেন। কবির উক্তি নিয়ে কিঞ্চিৎ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ফ্যাসিস্ত সরকার কবির বাণীর সুবিধামত অংশ নিয়ে নিজেদের প্রচারকার্যে ব্যবহার করেন। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়েনে’, ইতালির বিধানসভার সদস্য ম্যাত্তিয়েতি কবির ফ্যাসিবিরোধী মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। প্রফেসর ডি. লেসনীÑ“ঞধমড়ৎব'ং পড়হাবৎংধঃরড়হং রিঃয ৎবঢ়ড়ৎঃবৎং রহ ওঃধষু বিৎব ঃযব ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ ঃযবৎব ঢ়বড়ঢ়ষব : ঃযব ৎবঢ়ড়ৎঃবৎ, ঃযব রহঃবৎঢ়ৎবঃড়ৎ ধহফ ঞধমড়ৎব যরসংবষভ.” সুতরাং এই অবস্থায় যেমন বিকৃতি ঘটা সম্ভব তাই হয়েছে।

আগস্টে কবি ইংলণ্ডে ফিরে এলেন। ইংলণ্ডে রথেনস্টাইন, রবার্ট ব্রীজেস্ প্রভৃতি পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করে কবি নরওয়ের সম্রাটের আমন্ত্রণে অসলো শহরে অভ্যর্থিত হলেন। স্টকহোলমে স্বেন হেদিন, বিয়র্নসেন, যোহান বোয়ার প্রভৃতির সঙ্গে পরিচয় হল। কোপেনহেগেনে দার্শনিক হফডিং এবং বিখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক জর্জ ব্রানডেসের সঙ্গেও কবির যোগাযোগ ঘটেছিল।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ১৯২৬ সনে ‘লীগ অব নেশনসে’র আমন্ত্রণে যখন জেনেভায় গিয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপে। তিনি জধনরহফৎধ ঘধঃয অঃ উৎবংফবহ নামক প্রবন্ধে সেই সময় য়ুরোপে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিরকম আগ্রহ লক্ষ্য করেছেন তা লিখেছেন। বারবার তাঁকে রবীন্দ্রনাথ মনে করে সাধারণ মানুষ ভিড় করে এসেছেন। রামানন্দবাবু লিখেছেন  :
নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে সভাস্থলে পৌঁছিলাম। তিন চার সহস্র মানুষ ধরে এমনই বিরাট সভাকক্ষ। একটিও আসন খালি নাই। অনেকে দণ্ডায়মান, শ্রোতাদের অনেকেই রমণী। এঁদের অনেকেই ইংরেজি জানেন, যাঁহারা জানেন না তাঁহাদের জন্য বার্লিন য়ুনিভার্সিটির হিন্দি অধ্যাপক পণ্ডিত তারাচাঁদ রায় জার্মান ভাষায় কবির বক্তব্য অনুবাদ করিয়া দিলেন, ইনি পাঞ্জাব প্রদেশবাসী। অনেক রিপোর্টার ছিলেন, তাঁহারাও অধিকাংশক্ষেত্রে নারী। যিনি সমগ্র বক্তৃতা লিখিয়াছেন তিনি নারী। কবি অনেকগুলি ইংরেজি ও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করিলেন। কবিতা পাঠের সময় ঘনঘন হর্ষধ্বনি হইতেছিল। ঞযব ঈৎবংবহঃ গড়ড়হ হইতে যে সব কবিতা পাঠ করা হইল, তাহা বিশেষভাবে সমাদৃত হইল, ফলে কবিকে নির্ধারিত সংখ্যার বেশি কবিতা পাঠ করিতে হইল। নিম্নলিখিত কবিতাটি কবিকে দু-তিনবার পড়িতে হইল :

“ডযু ধৎব ঃযড়ংব ঃবধৎং রহ ুড়ঁৎ বুবং,
    সু পযরষফ?
ঐড়ি যড়ৎৎরফ ড়ভ ঃযবস ঃড় নব ধষধিুং
            ংপড়ষফরহম ুড়ঁ ভড়ৎ হড়ঃযরহম?”
বিস্তারিতভাবে সমগ্র প্রবন্ধ উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এর পর কবি রাশিয়া গিয়েছেন। তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’র আবেদন আজও অম্লান।
আজ পৃথিবীতে যে যুগান্তকারী দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছে, সে ভিন্ন ভিন্ন মহাজাতির মধ্যে নয়, মানুষের দুই বিভাগের মধ্যে, শাসয়িতা ও শাসিত, শোষয়িতা ও শুষ্ক। ...আমাদের দুঃখই, আমাদের দৈন্যই আমাদের মহাশক্তি। সেইটেই জগৎ জুড়ে আমাদের সম্মিলন এবং সেইটেতেই ভবিষ্যতকে আমার অধিকার করব। অথচ যারা ধনিক তারা কিছুতেই একত্র মিলিত পারে না, স্বার্থের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরে তারা বিচ্ছিন্ন। [রাশিয়ার চিঠি]
রবীন্দ্রনাথ এক হিসাবে ধর্মগুরু। তিনি স্বয়ং একটি ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক। সারা বিশ্ব জুড়ে তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেছেন, তাঁর নীতি ছিল ‘একলা চলোরে’Ñতাই এ তাঁর একক প্রচেষ্টা। তিনি যে ধর্মপ্রচার করেছেন তার নাম মানবধর্ম।

তাই ১৯১২-১৩ খ্রীষ্টাব্দেই রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার শ্রোতাদের বলেছেন
“এড়ফ রিঃয ঁং রং হড়ঃ ধ ফরংঃধহঃ এড়ফ ; ঐব নবষড়হমং ঃড় ড়ঁৎ যড়সবং, ধং বিষষ ঃড় ড়ঁৎ ঃবসঢ়ষবং. ডব ভববষ ঐরং হবধৎহবংং ঃড় ঁং রহ ধষষ ঃযব যঁসধহ ৎবষধঃরড়হংযরঢ় ড়ভ ষড়াব ধহফ ধভভবপঃরড়হ, ধহফ রহ ড়ঁৎ ভবংঃরারঃরবং. ঐব রং ঃযব ঈযরবভ এঁবংঃ যিড়স বি যড়হড়ঁৎ. ওহ ংবধংড়হং ড়ভ ভষড়বিৎ ধহফ ভৎঁরঃং রহ ঃযব পড়সরহম ড়ভ ঃযব ৎধরহ, রহ ঃযব ভঁষষহবংং ড়ভ ঃযব ধঁঃঁসহ, বি ংবব ঃযব যবস ড়ভ ঐরং সধহঃষব ধহফ যবৎব যরং ভড়ড়ঃংঃবঢ়ং. ডব ড়িৎংযরঢ় ঐরস রহ ধষষ ঃযব ঃৎঁব ড়নলবপঃং ড়ভ ড়ঁৎ ড়িৎংযরঢ় ধহফ ষড়াব যরস যিবহবাবৎ ড়ঁৎ ষড়াব রং ঃৎঁব. ওহ ঃযব ড়িসধহ যিড় রং মড়ড়ফ বি ভববষ ঐরস, রহ ঃযব সধহ যিড় রং ঃৎঁব বি শহড়ি ঐরস, রহ ড়ঁৎ পযরষফৎবহ ঐব রং নড়ৎহ ধমধরহ ধহফ ধমধরহ, ঃযব ঊঃবৎহধষ ঈযরষফ. ঞযবৎবভড়ৎব ৎবষরমরড়ঁং ংড়হমং ধৎব ড়ঁৎ ষড়াব ংড়হমং.” (চবৎংড়হধষরঃু)

বুদ্ধের পর ভারতবর্ষের বাণী এমন সুন্দর ভাবে বিশ্বের দরবারে আর কে প্রচার করেছেন জানি না। তাই যোহান বোয়ার বলেছেনÑ“ঐব রং ওহফরধ নৎরহমরহম ঃড় ঊঁৎড়ঢ়ব ধ হবি ফরারহব ংুসনড়ষ, হড়ঃ ঃযব ঈৎড়ংং নঁঃ খড়ঃঁং.”
এই প্রবন্ধটি আসলে একটি সুবৃহৎ বক্তব্যের কাঠামো। স্বল্প পরিসরে সমস্ত কথা বলা সম্ভব নয়। কবির বিশ্বজয়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও নয়। এই প্রবন্ধে এইটুকু দেখানোর প্রয়াস করেছি যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে থেকে এবং তিরোভাবের কাল পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে প্রচুর সম্মান ও সম্বর্ধনা লাভ করেছেন, সমসাময়িক চিন্তানায়কদের কাছে বিস্ময়কর অভিনন্দনলাভ করেছেন কিন্তু আজ তাঁর তিরোধানের পর কুড়ি বছরও কাটে নি য়ুরোপের একমাত্র সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রগুলি ছাড়া আর কোথাও রবীন্দ্রনাথ নেই। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের কথা শুনেছেন বা পড়েছেন তাঁরা প্রবীণ হয়েছেন, এখন যাদের বয়স কুড়ি-পঁচিশ তারা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই জানে না, এ কথা যাঁরা ঘন ঘন য়ুরোপ ঘুরে আসছেন তাঁদের মুখেই শোনা গেছে। এর কারণ বাঙালি তার কর্তব্য পালন করে নি। ভারতবর্ষ তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত নন। আর আমাদের নিজস্ব ‘বিশ্বভারতী’ ভারতের বাইরে তো নয়ই, ভারতের অন্য প্রদেশে রবীন্দ্রসাহিত্য বা জীবনী প্রচারে যে চেষ্টা করেছেন তা জানার কৌতূহল হয়। আজ বিদেশে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত এবং এখনও তজ্জন্য সচেষ্ট না হলে বাঙালিকে চরম প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

[উৎস : সাধশতজন্মবর্ষে রবিপ্রণাম : সরকারি হরগঙ্গা কলেজ বাষিকী ২০১১ (মো. শাজাহান মিয়া সম্পা.)]





পুনর্মুদ্রণ

সুনীলকান্তি সেন
রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’

______________________________________________________

১৯৪১ ৩০ শে জুলাই রবীন্দ্রনাথের জীর্ণ দেহে অস্ত্রোপচার হয়। তার কিছু পূর্বে সকাল সাড়ে ন’টায় যে কবিতা তাঁর মুখে উচ্চারিত হয় এইটেই তাঁর শেষ কবিতা :

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি-
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।

প্রথমেই চমক লাগানো সম্বোধন ‘হে ছলনাময়ী’। এ তো অনুরাগের ভাষা নয়। কবির মৃত্যু হয় ৭ই আগস্ট ১৯৪১। অর্থাৎ যে সময় এই কবিতার রচনা, মৃত্যু তখন একটি সুদূর ভবিষ্যৎ বা কল্পনাশ্রয়ী ভাববস্তু নয়। অত্যাসন্ন মৃত্যুর অন্ধকারে (?) এ এক নির্মুক্ত মনের উপলব্ধি। একদিন পূর্বে ২৯শে জুলাই তারিখে রচিত কবিতা ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি’ ও শেষ কবিতার মধ্যে ভাষায় ও দৃষ্টিতে সাদৃশ্য আছে। শেষ কবিতার একটি মূল শব্দ ‘ছলনা’ পূর্ব কবিতায় সবচেয়ে অর্থবহ শব্দ; ‘অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা তাহার’। শেষোক্ত কবিতার ‘মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে’ মনে করিয়ে দেয় শেষ কবিতার ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে’। দুটি কবিতার কণ্ঠস্বরেও মিল আছে; কিন্তু উপলব্ধি একটু ভিন্ন। পূর্ব কবিতার মূল কথা : জীবন ও মৃত্যুর একই ছলনা। জীবন ভয়ের মুখোশ প’রে বহুবার কবিকে পরিহাস করেছে। মৃত্যু শেষবারের মত অন্ধকারের পর্দায় ভয়ের চলচ্ছবি দেখাচ্ছে। কিন্তু ‘মুখোশ’ ও ‘ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি’র অন্তরালে ঈশ্বরের প্রসন্নমুখ ও এক জ্যোতির্ময়সত্যের আশ্বাস আছে।এটি ঈশ্বরের দক্ষিণাস্য এক দুর্লভসাধনার শেষপুরস্কার।

রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের কেন্দ্রে ছিলো এক গভীর ঈশ্বরচেতনা-এটা বোধহয় অবিসংবাদিত। বহু অভিজ্ঞতার সংঘাতে এই জীবনচেতনা নানা দিকে ও নানা স্তরে পরিব্যাপ্ত হয়েছে কিন্তু কখনো কেন্দ্রচ্যুত হয়নি। দৃষ্টি ও চেতনার এই ব্যাপ্তির সঙ্গে তিনি জীবনের বিভিন্ন পর্বে ঈশ্বরকে নানারূপে দেখেছেন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে যে অনন্য দৃষ্টিতে তিনি ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টির বৈপরীত্যকে দেখেছেন এর কোন পূর্বাভাস বোধহয় রবীন্দ্রকাব্যে নেই। ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় ভগবানের আবির্ভাব ভৈরবের বেশে :

ভৈরব, তুমি কী বেশে এসেছ,
ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী,
রুদ্রবীণায় এই কি বাজিল
সুপ্রভাতের রাগিনী।
‘দীক্ষা’ কবিতায় তিনি রণগুরু :
অস্ত্রে দীক্ষা দেহো,
রণগুরু। তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিয়া উঠুক আজি কঠিন আদেশে।
‘নীড় ও আকাশ’ কবিতায় :
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়।
হে সুন্দর, নীড়ে তব প্রেম সুনিবিড়
প্রতিক্ষণে নানা বর্ণে, নানা গন্ধে গীতে,
মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারিভিতে।

‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় এক ‘পউষ প্রখর শীতে জর্জর’ রাত্রিতে যে অবগুণ্ঠিতা রমণী কবিকে তপ্ত সুখশয্যা থেকে হরণ ক’রে এক জনহীন সিন্ধুপারে নিয়ে যায় তার ‘ছলনা’ মিলনের এক অভিনব পূর্বরাগ :
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি।
কবির ‘জীবনদেবতা’র কথা মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে :
ও হে অন্তরতম,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ আসি অন্তরে মম।
*    *    *
এখন কি শেষ হয়েছে প্রাণেশ, যা কিছু আছিল মোর-
যত শোভা যত গান যত প্রাণ, জাগরণ ঘুমঘোর?
শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন,
মদিরা বিহীন মম চুম্বন--
জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা আজি কি হয়েছে ভোর?
এই মহাপ্রেমিক জীবনদেবতার সঙ্গে শেষ কবিতার ছলনাময়ী নারীর কোন সামীপ্য নেই। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ১৯৪১, ১৪ই ফেব্র“য়ারি লেখা কবিতা ‘মধুময় পৃথিবীর ধুলি’ :
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি-অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি,
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।

কবির এই বাণীই আমরা এতোদিন মুগ্ধ হৃদয়ে শুনেছি। তাই তাঁর শেষ কবিতার ভিন্ন উপলব্ধি রবীন্দ্র কাব্য সম্বন্ধে আমাদের অভ্যস্ত চিন্তাকে বিপর্যস্ত করে। রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা সম্পূর্ণ নিরাভরণ। কোন কারুময়ী ছন্দ ও মিল নেই। ভাষা কাব্যিকতার অনুষঙ্গহীন, তীক্ষè ও ঋজু। এক গভীর বহুস্তর চেতনার প্রকাশেই এ কবিতার ঐশ্বর্য। এ জাতীয় কবিতার কোন গদ্যার্থ হয় না। তবুও আমি চেষ্টা করছি একটি গদ্যার্থ দেবার।
সৃষ্টির পথে নানা ছলনার জাল ও মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ। ছলনাময়ী নারীর মত ঈশ্বর নিপুণ হাতে এই মিথ্যার জাল বুনেছেন। আমাদের সরল জীবন এই ছলনার দ্বারা বিড়ম্বিত। কিন্তু এই প্রবঞ্চনাকে সহজভাবে গ্রহণ করাই মহত্ত্বের সাধনা। ঈশ্বরের এ এক দুর্জ্ঞেয় বৈপরীত্য। পথে নানা ফাঁদ ও বিড়ম্বনা, কিন্তু আকাশে জ্যোতিষ্কের আলো। এই আলো যে পথ দেখায় সেটা অন্তরের পথ, সহজ বিশ্বাসে উজ্জ্বল। বিড়ম্বিত জীবনের পথরেখা কুটিল, কিন্তু অন্তরের পথ সরল। জীবনের সকল প্রবঞ্চনা সহ্য করার সাধনায় যে উত্তীর্ণ সেই জ্যোতিষ্কের আলোয় সত্যের সন্ধান পায়, মৃত্যুর প্রান্তদেশে অক্ষয় শান্তি লাভ করে। এই গদ্যার্থ অবশ্যই কবিতার সরলীকরণ। এর মধ্যে কবিতার বহু ব্যঞ্জনা অব্যক্ত থেকে গেছে। যে চেতনায় কবির শেষ কবিতার উত্তর তার মূলে আছে কবির দীর্ঘ জীবনের নানা অভিজ্ঞতার স্তর। স্বভাবতই এ জাতীয় কবিতার প্রকাশে কিছু দুর্বোধ্যতা থাকে; কিন্তু সেটা অক্ষম প্রকাশের অস্পষ্টতা নয়। এতে আছে নানা অর্থের সংঘাত ও সংযুক্তি :

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
‘তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি’, এর পথ বোধহয় মহত্ত্বের দৃষ্টিতে অন্ধকার রাত্রির আকাশে জ্যোতিষ্কের উদ্ভাস। এক দিকে প্রবঞ্চনা অন্য দিকে জ্যোতিষ্কের দীপ্তিতে ভাস্বর রাত্রির আকাশÑএই ঢ়ধৎধফড়ী কি মহত্ত্বের অনিবার্য অভিজ্ঞতা? অথবা,
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু-

অন্তরের পথ সত্যে উজ্জ্বল কিন্তু বাহিরের জীবনরেখা কুটিল, এও কি মহত্ত্বের অনিবার্যতা? গদ্যার্থের সরলরেখায় এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন অনেকের মনেই জাগবে। আমাদের বিড়ম্বিত জীবন কি এই কবিতায় কোন সান্ত্বনার বাণী খুঁজে পাবে? মিথ্যার জালে আকীর্ণ পথই তো আমাদের চলার পথ। আমাদের জীবন সরল বিশ্বাসে অনেক মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে পা দেয়। আমাদের লৌকিক ধর্মাচার এক বিস্তৃত ছলনার জাল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বহু গানে ও কবিতায় তাঁর বাণীর ছলনায় আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন : ‘ওই মরণের সাগর পারে চুপে চুপে/ এলে তুমি ভুবনমোহন স্বপনরূপে। ... কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?/ জয় অজানার জয়। ... স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,/ মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।... সমুখে শান্তি-পারাবার’ ইত্যাদি। এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা তাঁর এক সৃষ্টিছাড়া কবিতা। পথে ছলনার ফাঁদে, আকাশে দীপ্যমান জ্যোতিষ্ক,-এই নিষ্ঠুর বৈপরীত্য কোন গুহানিহিত তত্ত্ব নয়। আমাদের অনেকের জীবনেই এই অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই ছলনা ঈশ্বরের নিপুণ হাতে ‘তৈরি,-জীবনের প্রদোষে কবির এই উপলব্ধি বিস্ময়কর : ‘এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত’-মহত্ত্বকে চিহ্নিত করাই যদি এই প্রবঞ্চনার অভিপ্রায় এবং জ্যোতিষ্কের আলো যদি এই দুর্জয় মহত্ত্বের পুরস্কার হয়-তবে আমাদের অনেকের ভাগ্যই শান্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার।’ মৃত্যুর প্রান্তদেশে রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির মধ্যে সান্ত্বনার কোন ললিত বাণী নেই। কবির বিভিন্ন কবিতায় দেখেছি ভগবানের রুদ্র রূপ, প্রেম ও ক্ষমাসুন্দর রূপ, লীলাময়ী রমণীরূপ। কিন্তু এমন নিষ্ঠুর, নিঃসান্ত্বন রূপ আর কোন পরিচিত কবিতায় নেই। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি অল্পপরিচিত কবিতা মনে পড়ে। যৌবনে কোন এক সংকট মুহূর্তে কণ্ঠে বলেছিলেন :

হৃদয়-বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি কি আসিল প্রলয় রাত্রি ঘোর।
চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া?
চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া?
*    *    *
আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকোঠর।
আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে-কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
‘চয়নিকা’ বা ‘সঞ্চয়িতা’য় এ কবিতার স্থান হয়নি। কবির সংশয়ক্ষুব্ধ মনের খবর তিনি বোধহয় পাঠকের কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। কোন রবীন্দ্রভক্তের মুখে বা লেখায় এ কবিতার উল্লেখ শুনিনি। রবীন্দ্রনাথের শেষকবিতা একান্তভাবে ভগবানের উদ্দেশে :

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

কবির এই বিশ্বাস আশা ও সংশয়ের উর্ধ্বে মৃত্যুর উদ্ভাসনে জীবনের শেষ উপলব্ধি। রবীন্দ্রনাথের কাব্যাকাশে এই কবিতা একটি নিঃসঙ্গ জ্যোতিষ্ক। ‘মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মধু নক্তমুতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।’ বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই আনন্দময় মন্ত্র সমগ্র রবীন্দ্রকাব্যে নানাভাবে প্রতিধ্বনিত। কিন্তু জীবনের শেষ রচনায় এই মন্ত্রের কোন প্রতিভাস নেই।

[উৎস : গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘কথাসাহিত্য’ ৩৭ বর্ষ, বৈশাখ ১৩৯৩ সংখ্যা]

No comments:

Post a Comment