Monday, February 18, 2013

২৪ ।। চিহ্ন ।। চিহ্নগ্রন্থমালার ২৩টি বইয়ের মূল্যায়ন





স্মৃতি রুমানা
মুখ ও শ্রীর অন্তর্বলোকন
_____________________

মুখশ্রীর পটে ॥ প্রচ্ছদ : অনুজ আদিত্য ॥ প্রকাশকাল : ২০০৮

প্রথম কথা
যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রবন্ধ-শিল্প নানা সময়ে সাহিত্যের বিভিন্ন সৃষ্টিকে আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। মানবধর্মের সবকিছুই সাহিত্যে বিরাজমান। সময়ের পরিবর্তনের সাথে রাষ্ট্র-রাজনীতি-প্রযুক্তি যেভাবে পরিসর করে নিয়েছে তাতে করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও সাধিত হয়েছে নানাধরনের পরিবর্তন। মানবজীবনের এই বহুমুখী পরিবর্তন সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। প্রবন্ধে হয় সেই সাহিত্যের অন্তর্জগৎ বিশ্লেষণ। কিন্তু এটাও ঠিক সাহিত্য আলোচনায় শেষ কথা বলে কিছু নেই। বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি এখানে খাটে না। কল্পনা ও সম্ভাবনা সাহিত্য আলোচনার ভিত্তি। তবে সেই কল্পনার ও সম্ভাবনাকে প্রবন্ধে রূপায়িত করতে প্রয়োজন প্রজ্ঞা। শহীদ ইকবালের প্রবন্ধগ্রন্থ মুখশ্রীর পটে সম্পর্কে প্রথম কথাটি বলতে গেলে বলা যায়, লেখক তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁর শাণিত সাহিত্যবোধের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।


অন্য কথা
কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নামক একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ দিয়ে লেখকজীবন শুরু করেছিলেন শহীদ ইকবাল। প্রকাশকালের দিক থেকে মুখশ্রীর পটে বইটি তাঁর পঞ্চম গ্রন্থ। প্রথম পাঁচটি বইয়ের সবগুলো প্রবন্ধগ্রন্থ হলেও ইতোমধ্যে সাহিত্যের ছোটকাগজ চিহ্ন সম্পাদনার পাশাপশি তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ শতকের রূপকথার নায়কেরা উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যের সৃজনশীল ধারায় প্রবেশ করেছেন। মুখশ্রীর পটে প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে শহীদ ইকবাল বাংলা সাহিত্যের যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন, লেখকের ভাষ্যে--মূলত শৈলীর দিকটা আলোচনাকালে অগ্রাধিকার পেয়েছিল-সেজন্যই মুখশ্রী শব্দটা নামকরণে প্রিয় হয়ে উঠেছে।’ সাহিত্যের বিশ্লেষণে তত্ত্ব ছাড়াও জরুরি যে বিষয়টা সেই স্টাইলটিকে প্রাধান্য দিয়ে শহীদ ইকবাল রচনা করেছেন তাঁর মুখশ্রীর পটে গ্রন্থটির তেরটি প্রবন্ধ। বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতির যিনি পথিকৃৎ সেই রোকেয়ার সমাজচিন্তা নিয়ে শহীদ ইকবাল যেমন বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনি এ বইয়ে তিনি তুলে এনেছেন প্রায় বিস্মৃত কথাশিল্পী আনিস চৌধুরীকেও। বাংলাদেশের অন্যতম মহিলা ঔপন্যাসিক মকবুলা মনজুরের লেখা মহাকাব্যিক উপন্যাস কালের মন্দিরাও তাঁর এ গ্রন্থ মুখশ্রীর পটেতে স্থান করে নিয়েছে।


যোগাযোগের ব্যক্তি-মানুষ
মানুষের অন্তরের গভীরতম তলদেশে প্রবেশ করে একেকটি চরিত্রকে বিকশিত করার যে শক্তি রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন তাঁর উপন্যাসসমূহে তা বিস্ময়কর। অবশ্য তাঁর এই শক্তির প্রকাশ ঘটেছিল ক্রমধারায়। রাজর্ষি, ও বৌ-ঠাকুরাণীর হাট উপন্যাসে উপন্যাস গঠনের প্রচলিত পদ্ধতির চাপে আবৃত হয়ে পড়লেও ‘নষ্টনীড়’, চোখের বালিতে তাঁর এই শক্তির ক্রমবর্ধমান রূপ লক্ষ্যযোগ্য। গোরা ও ঘরে বাইরেতে এই নিমগ্ন শক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা পূর্ণ রূপ লাভ করলেও উপন্যাস হিসেবে যোগাযোগ এ ঘটেছিল এই শক্তির পূর্ণ বিকাশ।  রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ  উপন্যাসে ব্যক্তি-মানুষ নামক প্রবন্ধটিতে শহীদ ইকবাল উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের সমাজবীক্ষার রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন।
উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সমাজকে চিহ্নিত করেছেন। ৭ই আষাঢ় অবিনাশ ঘোষালের জন্মদিন ধরে উপন্যাসের শুরু। কিন্তু চাটুজ্যে পরিবারের সঙ্গে ঘোষাল পরিবারের দ্বন্দ্বকে শহীদ ইকবাল বিশেষভাবে নির্দেশ করেছেন। ‘চাটুজ্যেরা ঘোষালদের ওপর শেষ কোপটা দিল সমাজের খাঁড়ায়। রটিয়ে দিল এককালে ওরা ছিল ভঙ্গজ ব্রাহ্মণ, এখানে এসে সেটা চাপা দিয়েছে, কেঁচো সেজেছে কেউটে।’ শহীদ ইকবাল বলতে চান ‘জাতপাত ও সমাজভেদের ইতিহাসটা এখানে গল্পের মুকুর । প্রজন্মান্তরের প্রবহমান সংবাদ, রীতিকে অতিক্রম না করে ধ্বনিত হলেও-এর ভেতরে বাঙালি সমাজের সংস্কার-আধিপত্য-অধ্যাত্ম চিন্তার সংঘটন আছে, একই সঙ্গে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক সংক্রমণে সমাজ-মানস-স্তরে বাস্তব অনিবার্যতা লক্ষণীয়। উত্থাপিত গল্পের যে বাস্তব পটভূমি; তার জন্যেই রবীন্দ্রনাথের মধুসূদন তৈরি।’ [রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসে ব্যক্তি-মানুষ,  মুখশ্রীর পটে, পৃষ্ঠা: ১২]  বস্তুত, উপন্যাসের মত আধুনিক প্রকরণটিতে রবীন্দ্রনাথ যে নিরীক্ষা না করে একেবারে দিব্যদৃষ্টিতে সবকিছুকে মর্মস্পর্শী করে তুলতে পেরেছেন শহীদ ইকবাল তাঁর এ লেখাটিতে এই কথাটি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়-‘বলা চলে ব্যক্তি উন্মোচনের বা ভঙ্গুর সমাজের ক্ষয় তার কাঠামোতে যেমন দ্যুতি দিয়েছে তেমনি প্রগতির শকটকেও তিনি চালিয়ে দিয়েছেন আবহের উৎসধারায়। রবীন্দ্রনাথ যেন চিরপ্রণম্য হয়ে ওঠেন এরূপে-তাঁর সকল সৃষ্টির ভেতরে।’

শামসুর রাহমান : কাব্যপাঠের সূত্র
তিরিশি পাঁচ মহৎ আধুনিক-উত্তর বাঙলা কবিতার প্রধান প্রাণপুরুষ শামসুর রাহমান। তিনি দ্রোহী নন। ভেঙে তছনছ করে আসেন নি। বিপ্লবী নন-দিকে দিকে আত্মঘোষণার ইশতেহার ছড়ান নি। তিনি বিনয়ী ও শ্রমী, পূর্বগামীদের পথের শেষপ্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু তাঁর এবং একদিন চলে যান অনেকদূর। যতদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখে নি পূর্বগামীরা। তার কবিতা হঠাৎ আলোর ঝলক, শান্ত-স্নিগ্ধতা, প্রশান্তির বদলে  সঞ্চার করে বিশ শতকের তাপ-জ্বালা-দাহ।
কবিতা যুগের বিবর্তনে চিন্তায় ভিন্ন রূপ নিয়ে আসে। রূপ ভাঙতে ভাঙতে স্বতন্ত্র আকার ধারণ করে। কবিদের পরিবর্তন হয়। দেশকাল, সমাজচিন্তা, দৃশ্যমান জগতের যূপকাষ্ঠে কবিতার মেজাজের ভিন্নতা ঘটে। শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতার এমন অপরিহার্য কবি যাঁর হাতে কবিতার বিষয়, ভাষা প্রাকরণিক দিক ও আধুনিকতা নান্দনিকতার শিখর স্পর্শ করেছে সফলভাবে। জীবনানন্দের আত্মসচেতন এবং নিজস্ব উদ্ভাবনা ও দর্শনসঞ্জাত কবিতায় শামসুর রাহমানের কাব্যের প্রথম ও মৌলিক প্রেরণা। এই উৎসমুখ থেকে তিনি নিজস্ব পরিণতির পথে অত্যন্ত সচেতন ও সজাগ, সতর্ক ও সর্বভুক মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হয়েছেন। শামসুর রাহমানের কাব্যপাঠের সূত্র বিচার করতে গিয়ে স্বপ্ন, রূপকল্প, নাগরিকবোধ, দেশপ্রেম সবকিছুই বিচার করেছেন শহীদ ইকবাল। শামসুর রাহমানের কাব্যপাঠের সূত্র বিষয়ক প্রবন্ধটিতে তিনি শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্রকে ‘অনেকরকম কবিতা’ বলতে চেয়েছেন। রকম ও বৈভবে শামসুর রাহমানের কবিতা উদ্দীপিত। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়েছিল তাঁর যে কাব্যযাত্রা আমৃত্যু সেই যাত্রা অব্যাহত ছিল। কেন এত প্রণোদনা, কবিতা তাঁকে কীভাবে এতদূর নিয়ে গেল, তাঁর কবিতায় জীবন ও সমসাময়িক বাস্তবতা কোন ভঙ্গিতে উঠে আসে আর শিল্পই বা কোন অনিবার্যতায় দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর প্রাণবন্যায় পুলকিত করে পাঠককে, এই লেখায় শহীদ ইকবাল সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে টি.এস এলিয়ট, ম্যাথু আর্নল্ড, মালার্মে থেকে স্মরণ করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতার  রূপকল্পের তাৎপর্যময় কথাটি উপস্থাপন হয়েছে কাব্যপাঠের সূত্রটিতে।
প্রকৃতই শামসুর রাহমানের কবিতায় স্থান করে নিয়েছে শহরের বিধ্বস্ততা, অধরা ও আধাভৌতিক শহর, পরাবাস্তব শহরচিত্র, গণিকা, যৌনতার অপপ্রণোদনা, মিথ্যা ও সত্য রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবনের চিত্রকল্প। চিত্রকল্পের এসব উপাদানের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে খাদ্যাভ্যাস, শ্রমজীবী, মৃত্যু, সূর্য, জিহ্বা, চাঁদ, অস্তিত্ত্ব, ক্ষণ, রোগ; প্রাণীকেন্দ্রিক চিত্রকল্প-বাঘ, শুয়োর, কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, পাখি, মাছ, কাঁকড়া, উকুন;  এবং অন্ধকার ইত্যাদি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগের বাস্তবতা কবিকে বিচ্ছ্ন্নিতাবোধে তাড়িত করে। বুদ্ধদেব বসু প্রণীত শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা পাঠ তাঁর মনোগঠনে ভূমিকা রাখে। লেখাটিতে শহীদ ইকবাল কবির সময় ও ইতিহাসজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বলেছেন :
যেখানে নন্দনপ্রতিমার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে বায়ান্নো-চুয়ান্নো-বাষট্টি-ছেষট্টি-ঊনসত্তর-একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী সময়; সামরিক ও আধা-সামরিক শাসন; মৌলবাদের হিংস্র থাবায় নিপতিত বাংলাদেশ।
-শামসুর রাহমান : কাব্যপাঠের সূত্র, মুখশ্রীর পটে, পৃ. ২৮


শামসুর রাহমানের কবিতার আঙ্গিকের ক্ষেত্রে শহীদ ইকবাল ত্রিশোত্তর কবিদের প্রভাবের কথা বলেছেন। ষাটের কবিতা-আন্দোলনেও যে শামসুর রাহমান গুরুত্বপূর্ণ কবি-ব্যক্তিত্ব, শহীদ ইকবাল সেটাও স্পষ্ট করেন শামসুর রাহমান : কাব্যপাঠের সূত্র প্রবন্ধটিতে।  

কাঞ্চনগ্রামের মানুষ-দর্শন
মুখশ্রীর পটে গ্রন্থটির আরেকটি প্রবন্ধ ‘কাঞ্চনগ্রাম উপন্যাসে মানববীক্ষার স্বরূপ’। আবু জাফর শামসুদ্দীনের এই দীর্ঘ উপন্যাসটি নিয়ে শহীদ ইকবাল যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে উপন্যাসটি সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। বলা বাহুল্য, আবু জাফর শামসুদ্দীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৃহত্তর অবকাঠামোর নির্মাতা। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান, সংকর সংকীর্তনর রচয়িতা হিসেবে তিনি যে স্থান করে নিয়েছেন তা অনস্বীকার্য। কাঞ্চনগ্রাম উপন্যাসের মূলকাহিনি মুক্তিযুদ্ধের চলমান প্রেক্ষাপট এবং সেই সময়ের আতঙ্ক-দ্বিধা-সঙ্কট বিভীষিকার শহর উপচানো প্রচণ্ডতার স্রোত শহীদ ইকবালের মতে- ‘প্রবহমানতার সূত্র যা পৌঁছে গেছে কাঞ্চনগ্রামে, গুটিকতক শেকড় আঁকড়ে দিনগুজরান মানুষের চিত্তে যা বীভৎসতার অশনিসংকেত হয়ে জেগে উঠেছে। মানুষের চলমান জীবনের স্বাভাবিকতাকে রুদ্ধ করেছে।’ এ প্রবন্ধে শহীদ ইকবাল কাঞ্চনগ্রাম উপন্যাসের গ্রামীণ পটভূমির মানুষবীক্ষার অন্তর্রূপকে চিহ্নিত করেছেন। সেই সময়ের সমাজ-দর্শন-ইতিহাস ও রাজনীতির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রবন্ধটিতে শহীদ ইকবাল আবু জাফর শামসুদ্দীনের ধৈর্যশীল প্রয়াসের সৃষ্টি উপন্যাস কাঞ্চনগ্রামকে বলতে চান-‘বেশ দীর্ঘ সময় ব্যয়ে, সংহত চেতনায় এবং পরিপক্ব মেজাজে সুলিখিত এক উপন্যাস।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের অপরাপর উপন্যাসকেও অপক্ব মনে করবার অবকাশ অবশ্য নেই। সমাজনিরীক্ষা তাঁর পদ্মা-মেঘনা-যমুনাতেও কম নেই। তবে এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই, কাঞ্চনগাম-এ সমাজনিরীক্ষণে অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সামন্তবাদের ভাঙন কিংবা পুঁজিবাদের যে বিকাশ ঘটে তাতে বাঙালির বৃত্তি ও পেশার ধারাবাহিকতার সূত্র বিঘিœত হয়। তোফাজ্জল শেখ শহরে রিকশা চালিয়েও উন্নতির স্বপ্ন দেখে। সমাজ কাঠামোর মৌলিক প্রবণতা নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন শহীদ ইকবাল তেমনি রাজনৈতিক চেতনার কথাও বলেছেন। কিন্তু উপন্যাসটির স্বরনির্দেশ করতে গিয়ে শহীদ ইকবাল এটিকে দার্শনিক চেতনাসমৃদ্ধ উপন্যাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে-‘উপন্যাসের অন্তরে বাহিরে সারাক্ষণ লেখকের দর্শনচিন্তা তীব্রভাবে কাজ করেছে।’

পদ্মার পলিদ্বীপ : সংগ্রামের সাহসী রূপালেখ্য
সূর্য দীঘল বাড়ী উপন্যাসের খ্যাতির কারণে আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসের দিকে পাঠক সমালোচকের তেমন দৃষ্টি পড়ে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে লিখিত হয়েছে পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসের আখ্যানভাগ। গত শতকের প্রথমার্ধের শেষভাগে নদীপ্রধান বাংলাদেশের নদীভাঙন ও জেগে-ওঠা চরদখলের জীবনবাস্তবতার পটভূমিতে কৃষিজীবী মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংকট এই উপন্যাসের উপজীব্য। নতুন জেগে ওঠা একটি চরের দখল নিয়ে একটি উঠতি জোতদার পরিবারের সংগ্রামের এবং সেইসঙ্গে সেই পরিবারের কোলশরীকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার এই উপন্যাসে আরও আছে নরনারীর আদিমপ্রবৃত্তির কথা। ফজল-রূপজান-জরিনার অনাবিল প্রেমের ভেতরও রচিত হয়েছে সংগ্রামের সাহসী রূপালেখ্য। বত্রিশ খণ্ডে বিভক্ত এই উপন্যাসের আবর্তিত ঘটনাবলিকে শহীদ ইকবাল মোটেই সমান্তরাল বলতে চান না। তিনি এই ঘটনাপ্রবাহকে পরিপূরক বলতে স্বস্তিবোধ করেন। উপন্যাসকারের লক্ষবিন্দু যে শ্রেণিশোষণের কাঠামো নিরূপণ, স্থিরিকৃত-পরাস্ত কোনো জীবন নয়, যুদ্ধে জয় মানুষকে বিবর্তনের পটে উন্মোচন করা, এই সম্পর্কে শহীদ ইকবাল গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসে প্রকরণ পরিচর্যা নিয়েও কথা বলেছেন শহীদ ইকবাল। এ উপন্যাসে বিষয় অনুযায়ী ভাষা নির্মিত হয়েছে বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। প্রবন্ধকার ঔপন্যাসিকের আকাক্সক্ষার প্রতি দৃষ্টি দেন। তিনি বলে-বহির্বাস্তবতার রূপময় সংগ্রামী মানুষের আলেখ্য রচনা করেছেন। মূলত জীবনযুদ্ধে মানুষকে জয়ীই দেখতে চেয়েছেন তিনি। তবে এক্ষেত্রে সহানুভূতি নয়-নিরপেক্ষ ও নির্মোহ থেকে লেখক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়-সন্নিপাতে প্রতিরোধী শক্তির বিপরীতে ভূ-সংলগ্ন মানুষের সম্ভাবনার সমগ্র রূপকে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন।’ এজন্যেই পদ্মার পলিদ্বীপ নিয়ে লিখিত এ প্রবন্ধটির মর্মের গভীরে ঢুকে এর নাম দিয়েছেন ‘সংগ্রামী মানুষের রূপালেখ্য।’

ভিন্ন কথা
সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থের তেরোটি প্রবন্ধে শহীদ ইকবাল বাংলা সাহিত্যের এমন বিষয় ও লেখকদের উপস্থাপন করেছেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান ঈর্ষণীয় উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। ‘আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী’র মত বিখ্যাত কবিতার কবিও যখন স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন, শহীদ ইকবাল তাঁকে টেনে এনেছেন আলোচনার বিষয় হিসেবে। আবদুল গনি হাজারীর কবিতার অভিনবত্ব, নিজস্ব আঙ্গিকে স্বতন্ত্রভাবে কবিতাকে স্বচ্ছন্দ তুলে আনে। আধুনিক যুগবাস্তবতায় তার কাব্যে যা বিষয় হয়েছে তা বিভাগোত্তর পূর্ব-বাংলার শোষণ, নিপীড়ন, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্ত, ভণ্ডামী, শ্রমজীবীর নিষ্ঠা, সংগ্রামমুখরতা, জীবনের সনাতন মূল্যবোধ ইত্যাদি। শহীদ ইকবাল আবদুল গনি হাজারীর কবিতার বিষয় সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন--‘বহুর ভিতরে এক মানুষের’ সন্ধানে ব্রত রয়েছেন কবি।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ যায় নিয়ে লিখতে গিয়ে শহীদ ইকবাল এই কাব্যনাট্যটির বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে কথা বলেছেন। প্রবন্ধকার বলতে চান এ নাটকটি রচনায়--‘লেখকের উদ্দিষ্ট শিল্পবিন্যাসে বাড়তি কিছু গুণ ও পাওনা যুক্ত  কারণ, মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে তিনি নাটকের প্রসঙ্গ করেছেন--এবং নাটকের মানুষগুলো যে সময়ের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত করেছেন তার মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের সীমানা নির্ণয়ের কার্যকারণ সম্ভাবনাগুলো আমাদের ইতিহাস অনুষঙ্গে ারবি ড়ভ ষরভব হয়ে উঠেছে।’ ইলিয়াস মাত্র দুটো উপন্যাস লিখেছেন তাঁর লেখকজীবনে। খোয়াবনামার রচনারীতিকেই শহীদ ইকবাল বলেছেন প্রতিরোধ-আক্রান্ত। এ উপন্যাসের কাহিনি-সংগঠন, চরিত্র নির্মাণ উপনিবেশবদ্ধ, শোষণ কবলিত। ঘটনার পরতে পরতে ব্যক্তি-বিচ্ছুরিত দম্ভ-দ্বেষ-তেজ কিংবা বিপরীতে উচ্ছ্বাস-আনন্দ-উৎসব এসবের সামগ্রিক জীবনযাত্রা শোষণ ও দ্বন্দ্বপ্রসূত, প্রতিরোধ-চিহ্নিত। শহীদ ইকবাল খোয়াবনামা নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটির তাই নাম দিয়েছেন ‘খোয়াবনামার প্রতিরোধের সংস্কৃতি’। এছাড়া প্রেমেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্পের নাগরিকজীবনের জটিলতা, বাংলাদেশের ছোটগল্পের প্রকৃতি ও পরিচর্যা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি শহীদ ইকবাল প্রমথনাথ বিশীর ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস কেরী সাহেবের মুন্সী নিয়েও একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রমথনাথ বিশী কেরী সাহেবের মুন্সীর মধ্যে ব্যক্তির ইতিহাসকে সামগ্রিক সমাজদ্বন্দ্বের ভাষ্যে রূপায়িত করতে পেরেছেন বলেই শহীদ ইকবাল মনে করেন। তিনি বলতে চান এ উপন্যাসে সচল এক জীবনবীক্ষারই সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে এবং বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে কেরী সাহেবের মুন্সী সিদ্ধি লাভ করেছে।

শেষকথা
শহীদ ইকবালের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা-গ্রন্থ  মুখশ্রীর পটেতে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নিজের বিশ্লেষণ ও মতামত দিয়েছেন। যুক্তিনিষ্ঠ এই বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেভাবে বিষয়গুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছেন, এই আলোচনায় শহীদ ইকবালের বিশ্লেষণর এই দিকটি সম্পর্কে লেখার চেষ্টা ছিল। কিন্তু আলোচনাটি শেষপর্যন্ত সেভাবে গভীরে প্রবেশ করতে পারে নি। না পারার কারণ আমার সীমাবদ্ধতা। এখানে কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয় আমার পূর্বপাঠ-অভিজ্ঞতায় ছিল না বলে আলোচনাটি বেশ সংক্ষিপ্ত এবং অগভীর হলো। এই দায় নিতে আমার কোন আপত্তি নেই।