Saturday, March 2, 2013

চিহ্ন

 

 

 

 

 

সৈকত আরেফিন
পাতা পতনের সজলধারা


পত্রে রচিত ভোর সজল সমুদ্র ॥ চিহ্নগ্রন্থমালা ২ ॥ ফেব্রুয়ারি ২০০৫॥ রাজশাহী




ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে...
-লালন ফকির

পত্রে রচিত ভোর নামে সজল সমুদ্রের কাব্যগ্রন্থটি খুলে বসে, লালন ফকিরের এই গানের কথাই মনে আসে। প্রথম বিবেচনা কবিতা হলেও, কবিনাম ও কবির কাব্যরচনার সময় ও পটভূমি চকিতে লালন ফকিরের গানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাউলকবির এ গানের অধ্যাত্মচেতনার সঙ্গে কবি সজল সমুদ্রের ভাবগত অনৈক্যই বেশি। এবং এ গানে লালন হয়তো তাঁর পরমেশ্বরের কথাই বলেন, যে পরমেশ্বর শূন্যের উপর ঘর বেঁধেও বাস করতে পারেন; তবে এখানে পরমেশ্বর আমাকে ভাবায় না, শুধু শূন্য শব্দটি আমাকে উল্লোলিত করে। এজন্যে যে, তাহলে শূন্যতার মধ্যেও বিনির্মিত হতে পারে পাকা দালান-বাড়ি! তখন, বহুদিন আগে পড়া রবীন্দ্রনাথের, ‘প্রাচীন শূন্যবাদ’ নামে লেখাটি খুঁজে পেতে আবার পড়ার প্রয়োজন হয়। লেখাটিতে মধ্যমকবৃত্তি নামক একটি বইয়ের কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ, যেটি বিনয়-সূত্র নামের আরেকটি প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থের ভাষ্য। ভাষ্যকারের নাম চন্দ্রকীর্তি আচার্য। বইটিতে, সবই যে শূন্য, শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নাই, শূন্যবাদী চন্দ্রকীর্তি এটা প্রমাণ করতে চান। শূন্যতা প্রসঙ্গে আমরা নাগার্জুনের কথাও বলতে পারি। বিদর্ভনগরের এক ব্রা‏‏হ্মণ পরিবারে নাগার্জুন জন্মেছিলেন খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় দশকে। মহাযান বৌদ্ধতত্ত্ব অধ্যয়নের সময় তিনি বৌদ্ধধর্মেও দীক্ষা নেন। কারিকাশৈলীর প্রবর্তনাও করেছিলেন তিনি। সত্তরটি কারিকায় রচিত তাঁর গ্রন্থ বিগ্রহব্যবর্তনী যার অন্য নাম শূন্যতা-সপ্ততি; এই বইতে নাগার্জুন বলেন-‘এই শূন্যতাকে যিনি অনুভব করতে পারেন তিনি সবকিছুর অর্থই অনুধাবন করতে পারেন। যিনি শূন্যতাকে বোঝেন না, তিনি কিছুই বোঝেন না।’ এভাবে ঐতিহাসিক ও ধারণাগতভাবে ‘শূন্য’ একটা মহিমা পায়। পেলেও, সম্প্রতি ‘শূন্য’ শব্দটি প্রয়োগজনিত কারণে, যখন এটি ক্যালেন্ডারের দশবছুরে কালপরিক্রমাকে সাহিত্যের পটভূমে ‘শূন্যদশক’ নামে পরিচয় করায় তখন যে বিভ্রান্তি নিয়ে আমরা ব্যতিব্যস্ত হই এবং বিস্তর হৈচৈ করি তা আমাদের চিৎকারপ্রীতির স্মারক হবে। দশকনামের এই বিভ্রান্তিকে আলগোছে সরিয়ে রেখে যদি বরং পাঠে মনোযোগী হই, দেখব, সমস্ত কলহ এড়িয়ে একটা প্রগাঢ় মৌনতা আমাদের সম্মোহিত করেছে। এখানে, বিভ্রান্তিকর শূন্যদশকের কবি সজল সমুদ্রের কাব্য পত্রে রচিত ভোর পাঠের অসনির্বন্ধ অনুভব শব্দে অনুবাদের একটা নিস্ফল প্রয়াস লিখিত হবে।


সমূহ আবেগ কবিতায় শিল্প ব্যাহত করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে । তবে বাংলা কবিতায় শিল্প, মনন ও চিন্তা ফিরেছিল দশক হিসেবে বললে, আশিতেই। এই প্রবণতাকে নব্বুই দশকের কবিরা বিমূর্ত গদ্যঢংয়ে বিন্যস্ত করেন। সাম্প্রতিক অনুভব ও অনুবেদনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তারা ব্যবহার করেন কোলাজরীতি। তখনই কবিতায় ঘোষণা বা বিবৃতিধর্মীতা বর্জিত হতে শুরু করে। আবেগের বিহ্বলতা সরে গিয়ে কবিতায় বৌদ্ধিক সারল্য আসে; বিদ্রুপ আসে নান্দনিক ঐশ্বর্য নিয়ে। আর কবিদের মধ্যে যে একধরনের ছন্দবিমুখতা এসেছিল আগের দশকে, ফিরতে শুরু করে হারিয়ে যাওয়া ছন্দনিষ্ঠতাও। শূন্যদশকে, বলা দরকার নব্বুইয়ের এই ধারাবাহিকতা অংশত অক্ষুণ্ন থাকে। নাম বিভ্রান্তির এই দশক, শূন্য বা প্রথম যে নামেই ডাকি না কেন, যখন, সেই সময়পর্ব পেরিয়ে আমরা নতুন আরেকটি দশকের প্রথমার্ধ অতিক্রম করছি, তখন পেছন ফিরে তাকালে সজল সমুদ্রের পত্রে রচিত ভোর কাব্যগ্রন্থটি সমস্ত বৈভব নিয়ে আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়। শূন্যের এই কবি যে অর্থবহ ভোরের ইঙ্গিত করেন কাব্যটিতে, বাউল কবি লালনের সঙ্গে ভাবগত অনৈক্য সত্ত্বেও এই কাব্যনির্মিতি যেন ব্যাপক অর্থে শূন্যের উপর পোস্তা ঘর নির্মাণের মতই। তাকে ধন্য ধন্য করাই যায়।

এসো সন্ধ্যা, এসো রাত্রি-তারা টলমল
পত্রে রচিত ভোর এই নামটি এমন একটি পাতাময় ভোরে আমাদের নিয়ে যায়, প্রত্যেকের মনেই যে ভোরের স্মৃতি ঘন হয়ে আছে। যেন পাতা মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতিটি তখনও নবীন। এবং কবিনাম সজল সমুদ্রও আমাদের না ভাবিয়ে পারে না। জলহীন একটি সমুদ্রের নামও যখন জানা নেই তখন সমুদ্রের সম্মুখে সজল বিশেষণটি একটি জলভরা চোখের দৃশ্য আমাদের মনের সামনে এনে স্থাপন করে। অথবা এই পাতা কি কোন নারীর নাম! এই ভোর কি রমণীর অপেক্ষায় থেকে বিগত করা রাত! বা পত্রে রচিত এই ভোর একটি ফিনফিনে রোমান্টিক হাওয়ায় আমাদের মর্নিংওয়াক করায়! সজল সমুদ্রের এই কাব্যটির একাগ্রপাঠ তেমনি এক পেলব অনুভবে আমাদের ঘোরগ্রস্ত করে-

আমি বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে কুয়াশাকে বলি-
আচ্ছা, এই রোদে ধাঁধা মেখে মাঝে মধ্যে কোথায় হারাও
অবিশ্বাস্য, কুয়াশা তখনই উধাও
দাঁড়াও, ও কুয়াশা- আমার নামের শেষে বর্ষা লিখে যাও।

প্রেম, পত্রে রচিত ভোর, চি‎হ্নপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ-ফেব্রুয়ারি-২০০৫, পৃষ্ঠা, ৩৯

সেই সকাল পেরুনো শীতের দুপুরে যখন বৃষ্টির পত্র আসে হেমন্তের ডাকগাড়িতে, খামের মধ্যে একপৃষ্ঠা জল। বৃষ্টি যদি আমাদের সব দুঃখকে ভাসিয়েও নেয়, তবু অস্ফুট বেদনার জলবিন্দুটুকু একেবারে সরাতে পারে না। সেইসব কাক্সিক্ষত বেদনাকে কুয়াশার চাদরে মুড়ে আমরা পুষি। পুষতে ভাল লাগে।

আমার কিঞ্চিৎ পথ-লুপ্ত-সরল; ভেসে যেতে যেতে
গোলাকার আকাশের তলে যৌথ আমরাই
বক্র, একদিন নদীর নেপথ্যে বাঁকা হয়ে যাবো:
মনে হবে কিচ্ছ হাঁটি নাই পথ
অথচ আমাদের পায়ের দাগ, আঙুলের আর্তি সকল
কেবলই হেমন্তে শীতের ধারণা নিয়ে
বহুদূর একা ও অজস্র পড়ে রবে, ধুলোময়...

দেহদ্বন্দ্ববোধ, পৃষ্ঠা, ১৪

এই কবিতা পড়ে কিঞ্চিৎ লুপ্ত-সরল পথে ভেসে যেতে যেতে যখন শিরদাঁড়া বাঁকা করে যূথবদ্ধ দাঁড়াব, আমরা ভুলে যাব, এটি সজল সমুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু চেশোয়াভ মিউশের নোবেলোত্তর ভাষণটির কথা আমাদের মনে পড়বে। কৌতুক করে মিউশ বলেছিলেন-‘প্রত্যেক কবিই তার প্রথম কবিতাগ্রন্থের প্রকাশলগ্নে ভাবেন, তার মত আর কেউ নেই; দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থের প্রকাশকাল উপস্থিত হওয়া মাত্র তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পান, অসংখ্য অগ্রজের ঋণভূমে জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে আছে তার প্রথমপ্রকাশ।’ [ আবু হাসান শাহরিয়ার : আমরা একসঙ্গে হেঁটেছিলাম, পৃষ্ঠা, ১১১] কিন্তু পত্রে রচিত ভোর-এ সজল কি তেমন জড়োসড়ো! অসংখ্য অগ্রজের ঋণে! সজলের দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রকাশকাল হয়তো হয়ে এল। দুহাজার পাঁচ খ্রিস্টাব্দে যখন পত্রে রচিত ভোর কাব্যগ্রন্থটি চি‎হ্ন থেকে বেরোয়, সজল টগবগে তরুণ, সঙ্গে কাঁচা বয়সের আবেগ; তারও আগে দুহাজার এক খ্রিস্টাব্দ থেকে আরও নবীন বয়স থেকে লেখা কবিতা নিয়ে প্রকল্পিত গ্রন্থটি প্রকাশের সাতবছর পরে, কাঁচা বয়স পার করে যখন কবি সজল কবিতায় তরুণতরদের অগ্রজ, তখন তিনি লিখছেন-
এ লেখা ঈষৎ তুলোট চৈত্রে ফোটা আধোলাল শিমুল-সদৃশ
বহুঘটনার স্রোতে যারা এসেছে এদিকে, এই ঝোপঝাড়ে
যখানে ফুলের বদলে ফুটেছে হুতুমের ডিম...
বাতাস এখানে এসে ক্ষয়ে যায়, দুএক বাদুড় আসে,
তাদের চিরভাসমান বটফলের ঘ্রাণ বহু দূর দেশ অবধি যায়...

বৃষ্টিরা কথা বলে মেঘের কপাট খুলে অনর্গল থমকে দাঁড়ানোর,
যৌনগল্প বেঁচে যায় জোনাক সাপের সমঝোতায়, সংকেতময়...
বিবিধ গুল্মলতার এই ঝোপঝাড়ে মনস্তাপে, পশু-ভর্ৎসনায়
ভাঙা আয়নায় দেখি কলঙ্ক-মলিন মুখ, অই চিতাবাঘ,
হরিণ, ফড়িঙ, হলঘর-সকলের অগোচরে...’ 


-ঝোপঝাড়ে : ফেসবুক নোট, সজল সমুদ্র, শনিবার, নভেম্বর ২০১২, রাত ৯ টা ১০মিনিট

ফেসবুক নোট থেকে এই কবিতা, যার মধ্যে সুপ্ত হয়ে আছে পত্রে রচিত ভোরর সুরের আবেশ, ‘ঝোপঝাড়ে’ পাঠের পর তাই প্রথম গ্রন্থটিকে মোটেও নড়বড়ে লাগে না, এবং খুব একটা ঋণজর্জরও নয়। যে পেলব কোমলতা দিয়ে শুরু হয় সজলের কবিজীবন, সেই কোমলতা যে তার ভঙ্গি নয়, সহজাত, তা বোঝা যায়। এ ভয় হয় বরং, প্রথম গ্রন্থটিকে কি উতরে যেতে পারবেন সজল! পারলে ভালই হবে। কিন্তু উতরে যাওয়া শব্দটিও এখানে হয়তো বিভ্রান্তিকর; যে মৌনতা তার মধ্যে অন্তর্ভুত হয়ে আছে, সেটাকে ইচ্ছেকৃত ত্যাগ না করেও বোধ ও প্রকাশে ঝরনাধারার মত অনায়াস হতে পারেন কি না সজল সেই আশাবাদের প্রসঙ্গ আসে। তখন আবার এ প্রশ্ন হতে পারে-তাহলে কি পত্রে রচিত ভোরএ সজল যথাযোগ্য অনায়াস নন! এক্ষেত্রে আমরা তার জীবন-অভিজ্ঞতার কথা বলব। প্রতিটি দিনই একেকটা নতুন অনভূতির জন্ম দেয়। প্রতিটি পরিচিত মানুষ তো একেকটা পাঠযোগ্য বই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই অভিজ্ঞতাও ঋদ্ধ হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার ছাপ কবিতায় না পড়লেও সজল সমুদ্র ইতোমধ্যে যা লিখে ফেলেন পত্রে রচিত ভোরএ; ফলে কবির খাতা থেকে নাম কাটা যাবার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যায়।

সঞ্চয়ে মধু রাখি নাই, পাত্রখানা অযথা টলমল
দ্বিধায় মধু-সংগ্রহদিনে ঘুরি নাই বন;
বসন্তের দুপুরে মধু নিতে এসে
কী প্রকার জটিল হয়েছো-গ্রাহ্য করি নি মধুস্বাদ
জানি, মৌমাছি সদাভ্রাম্যমান 


মধু-সংক্রান্ত, পৃষ্ঠা ২৩

এর মত কবিতা লিখতে এসে হয়তো তারও কিছু ভ্রাম্যমানতা থাকতে পারে, অস্থিরতাও; কিন্তু নিষ্ঠাও যে আছে মৌমাছিরই মত, সজল সেটিও বলেন কবিতায়-‘তবু ব্যাকুল এ মধুনিষ্ঠ মন/ সারাবনে মধু ও মলিন গ্রাহক খোঁজে’। [ মধু-সংক্রান্ত, পৃষ্ঠা ২৩]

পত্র মানে চিঠি নয়, চিঠি মানে না-লেখা সব ভাষা
যে সময়-বৃত্তে অধিবাস করে সজল সমুদ্র পত্রে রচিত ভোরর পটভূমি পরিভ্রমণ করেন, তখনো মুঠোফোন আমাদের মুঠো অধিকার ফেলে নি। না করলেও, আমরা নিজেরাই তখন মনে মনে একেকটা মুঠোফোন হয়ে আছি স্বভাবে। হয়তো তাই মুঠোফোনের ভ্রাম্যমানতা সজল সমুদ্রের কবিতার শরীর নির্মাণ করে দেয় ‘পাখিদের দূরত্বে  এসে দেখি-/ আমার ঠিকানা কেবল খড়কুটো’, [ ঠিকানা, পৃষ্ঠা : ৪৬] কোন্ পাখিদের কাছ থেকে দূরে যেতে হয় সজলকে! পাখি কি কোন তরুণীর নাম! না কি অসংখ্য তরূণীর ডাকনাম পাখি, যার বা যাদের জন্য কবির মনে বহু প্রেম জমা হয়ে থাকে! কিন্তু প্রার্থিতাকে কখনো জানান যায় না সেই অনুভূতির অনুরণন। তখন দূরে খড়কুঠোর কাছে গিয়ে অন্তর্লীন মৌন-আন্দোলনের ভেতর নিজের মধ্যে একটা আকাশ রচনা করতে হয় কবিকে-
খড়ে যত আগুনের ভয়, পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে
উড়ে, না-জানি কোন মেঘে যাই; দূরে-মেঘের দূরত্বে যদি
আমার ঠিকানা আকাশ হয়ে যায়, কেবলই বাতাস
যথা সদাভ্রাম্যমাণ!

-ঠিকানা, পৃষ্ঠা : ৪৬

কিন্তু যথানিয়মে, ঠিকানা আকাশ হলেও পাতা বলেই একদিন ঝরে পড়তে হয়। সজল পতনশীল একটা পাতার সঙ্গে নিজের মনোভঙ্গি ও নিরবলম্ব জীবনের প্রতিতুলনা করেন। আকাশচ্যূত পাতাটি বস্তুত কল্পলোক থেকে নেমে আসে পৃথিবীর বাস্তব মাটিতে। তখন পাতাটির প্রতিবেশী সেই পাখি, না কি অনিন্দ্য তরুণী, যার জন্য কবিমনে অনিঃশেষ প্রেম অব্যক্ত হয়েছিল-
দাভ্রমে ঘুরছি জীবন-ও পালক
ডানা, আমি ছলনা শিখি নি, ঘূর্ণিতে
এবার পাখিদের পার্শ্বে আমার ঠিকানা : পাতা
                     প্রযত্নে পাখি প্রতিবেশী

-
ঠিকানা, পৃষ্ঠা ; ৪৬

তখন বিভ্রান্ত ও একজন বিহ্বল কবিকে কেবলই দূরে সরতে দেখি। যে বৃক্ষ ও বৃক্ষের পত্র-পল্লবে একসময় আত্মগোপন করা যেত, সেই বৃক্ষময় বনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও তখন তার ভয়-
নের সামনে একা দাঁড়াতে পারি না,
হুলস্থুল পাতা ঝরে যায়
পাখিদল ওড়ে। ডানায় পরাজন্মের রঙ নিয়ে
ঝরে যায় প্রতিভা ও আয়ুর পালক
কার কী-বা এসে যায় তাতে?
-সঙ্গত তুলি, পৃষ্ঠা : ৪৩

এই পাতা ও পাখি হয়তো বিষণ্ন প্রকৃতিরই উপমা। সজল বিপর্যস্ত বনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইতস্তত করেন, তখন-‘পাতারা ঝরে যায় অপ্রকাশ্য বেদনার ভারে’, শিল্পীবন্ধু অনুজ আদিত্যকে সজল তাই একটা বন আঁকতে বলেন-‘পাতাদৃশ্য আঁকো, তুলিভেঙে ঝরাপাতার কোলাহল/ অপ্রকাশ্য বেদনার রঙ, পোর্ট্রেট...[ সঙ্গত তুলি, পৃষ্ঠা : ৪৩] যেখানে গিয়ে অন্তত নির্ভয়ে দাঁড়ানো যাবে। কিন্তু সদাভ্রাম্যমান যে কবির মন, পাতার স্থিরচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বনভ্রমণের ইচ্ছে তার কি মেটে! তখন তাকে সারাবন ঘুরে পিপাসার্ত হয়ে প্রার্থিত প্রিয়তমের কাছে দাঁড়াতে হয়-

সারাবন ঘুরে উন্মোচিত পিপাসা এনেছি-পাতা
পতনের জলধারা দাও
উদ্ভিদের কান্না কিছু আঁকি; অনাহারে শ্যাওলা-জীবন এই
সংবৃত কান্না কিছু উড়ে যেতে চায়, অগোচরে
কিছু ফুল ঝরে গেছে গাছেদের সরল প্রশ্বাসে;
-আক্রোশের ধ্বনি, পৃষ্ঠা : ১৫

কিন্তু অন্বিষ্ট প্রিয়তমের হয়তো বনের পিপাসায় অনীহা; পাতা পতনের জলধারা দিতেও সে অনিচ্ছুক বলে কবিকে তখন বনের ছায়া ছেড়ে পথের রোদ্দুরে নামতে হয়। সারাপথ ঘুরে উচ্ছাস এনে তাকে বলতে হয়--গাছ/ পতনের পাতা-ধ্বনি দাও/ বনের তুলিতে নিদেন অরণ্যের প্রতিবেশ আঁকি, কিছু আক্রোশ...[ আক্রোশের ধ্বনি, পৃষ্ঠা : ১৫] কেননা তার আগেই কবি জেনে যান, বনে তিনি আর কাক্সিক্ষত নন। জিজ্ঞাসার সূচক ভেঙে সবশেষে বৃক্ষের কাছে গিয়ে আশ্চর্য কবি উপলব্ধি করেন, বনময় সুরভিত মৌতাতের মধ্যে তিনি দুর্গন্ধ ছাড়া কিছু নন-‘জেনে গেলাম-এ বনের ঘ্রাণে আমি উৎকট,/ আশ্চর্য নিজেই। এবার দিতে পারি পথের জখম-বনের বর্ণনা/ মাকড়সার জাল ছিঁড়ে গাছেদের ধর্মে এসেছি, এসেই/ জানা হলো-জিজ্ঞাসা ছাড়া কোন পা-ই পথ জানে না।’ [ জিজ্ঞাসাবিস্ময়, পৃষ্ঠা : ২৫] এই আত্মোপলব্ধিও কবিকে দমিয়ে রাখতে অপারগ। জিজ্ঞাসার কৌতূহলী চাহনীকে উপেক্ষা করে কবি পৌঁছে যেতে পারেন বৃক্ষশাখায়-‘কী বলি ডালের পাখিকুলে-/আমি যে জোড়া দুই ডানা খুইয়ে এতপথ/ উড়ে উঠেছি! [ জিজ্ঞাসাবিস্ময়, পৃষ্ঠা : ২৫] তাহলে জিজ্ঞাসা ছাড়াও কোন পা পথ চলে! এবং একজন কবিই শুধু পারেন দুই জোড়া ডানা হারিয়েও উড়তে। কেননা, কবির ডানা তো একটা নয়, অনেকটা।

২.

মানুষ মোমের ঘোড়া পূর্বাপর গলে যাচ্ছে এই আস্তাবলে
তাদের কান্নারা রেললাইন, ছড়ানো পাথর আর
কখনো স্লিপার
যে ট্রেন চলে গেলে বিলাপের কেউ নেই আর...-
সন্তাপ, সজল সমুদ্র, ফেসবুক নোট রবিবার, ডিসেম্বর ৪, ২০১১, রাত ১০ টা ৪৯ মিনিট

শিল্পের সবচেয়ে বড় শক্তিই সম্ভবত কল্পনা আর শিল্পীও শক্তিমান হন স্বপ্ন ও কল্পনার শক্তিতে। তাই দৃশ্যত দুটো ডানা নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কবির ডানা একটা নয়, অনেকটা। সেই অদৃশ্য বহুডানা নিয়ে কবি উড়ে বেড়ান কেবল আকাশের নীলে নয়, কবির উড়ে যাবার গন্তব্য প্রধানত একটাই, মানুষ। তাই মানুষ যেমন মোমের ঘোড়ার উপমা হয়, মানুষের কান্না কবির কাছে রেললাইন, রেললাইনের ছড়ানো পাথর, কিংবা স্লিপারের মত এবং ট্রেন চলে গেলে শূন্য স্টেশনের হাহাকারের মত স্তব্ধ মানুষের চিরায়ত একাকীত্বকে কবি উপলব্ধি করেন গভীর সংবেদনায়। মানুষের আনন্দ, দুঃখ, শোক, বিরহ প্রেম কবিকল্পনায় হাজির হয় অনন্য মাত্রাসহ । মানুষের লগ্ন প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও নৈসর্গও কবিকে কখনো প্লুত করে, কখনো বিপর্যস্ত বিহ্বলতায় ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু যথাযোগ্য কল্পনার ডানা কবিকে যে শক্তি দেয়, শীতঋতু শেষ হয়ে গেলেও হিমকুয়াশার ভার ধরে রাখতে তার সমস্যা হয় না।
পথে যা কুড়িয়ে পাই-নাড়াভস্ম ছাইয়ে ঝরাপাতা,
ধুলো ও শিশিরতুল্য কী নরম লুণ্ঠিত ঘ্রাণের ফুল
আর যা যা যাবার শীতেই ফেলে গেছো
সে সকল লালিত ধোঁয়াশা
এতসব ধরে রেখে কী চোখে ঘুমাই?
-শীতের সারমর্ম, পৃষ্ঠা : ২৭

আবার অনুভূতির অনুবাদে সজল সমুদ্র কুয়াশা-সঙ্গীতের টুপটাপ সুরমূর্ছনাকেও কবিতায় ধারণ করেন। যেমন শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা নেমে আসে, কুয়াশা বিরাজমানতারও নিশ্চয়ই সেরকম কোন সুর আছে। পত্রে রচিত ভোর প্রধানত প্রকৃতির ফিনফিনে শরীরের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে থাকা সেই নরম সুরমুখর নৈসর্গের পটভূমি নির্মাণের কাব্যসুষমা-‘শীত: আবার কণ্ঠে ধরেছি টুপটাপ কুয়াশা-সঙ্গীত,/ ঘন। আমি কাঁপাতে জানি উত্তরের হাওয়া/ থরথর/ শতবর্ষের পাতা। বৃক্ষ-বনভূমি। গৃহে গৃহে পুরনো আঁচল/ দিনমান। নানাবিধ রাত্রি-অবধি। [ শীত-সারল্য, পৃষ্ঠা : ৩২]

চোখের বিশ্বাস জলে ঢেউ দিও
ঢেউ দিও
ভ্রমের দরজা খুলে রচেছি এ ভোর :
উজ্জ্বল লালবেলা
-মহুয়াকে লেখা উৎসর্গপত্র, পত্রে রচিত ভোর, সজল সমুদ্র
একটি অসনির্বন্ধ অনুভব-অনুবাদের এই প্রয়াস অবশেষে নিস্ফল হবে এতো জানাই ছিল। তবে মূলত বৃক্ষ, পাতা ও ভোরের দিকে হাঁটতে গিয়ে এখানে নদী, নদীপাড় ও নদীর বিবিধ ঢেউয়ের কথা বলাই হল না। বৃক্ষের কথাও কি কিছু বলা হল! পাতা অথবা ভোরের কথা! একদিকে চোখ রাখলে অন্যদিক আড়ালে পড়ে যায়, বা চোখের দেখাই হয়তো সবকিছু নয়। দেখলেও, এমনও অনেককিছু আছে যা খালি চোখে দেখাও যায় না। যে বৃক্ষকে শুধুই উদ্ভিদ বলা হল, সেকি কেবলই একটা উদ্ভিদ! যে পাতাকে পাতা বলা হল, সেকি কেবল পাতাই! বা বৃক্ষ ও পাতার মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি হল যে ভোর, সে ভোরের আবহাওয়াটাই বা কেমন! একটুও উচ্চস্বরে না বলে, প্রায় চুপিসারে, সজল যে একটি উজ্জ্বল সকালবেলায় আমাদের ডাক দিয়ে নিয়ে যান, যেতে পারেন, ভ্রমের দরজা খুলে রচিত এই উজ্জ্বল লালবেলায় নিয়ে যাবার অন্তর্শক্তি যার আছে তার  উত্থানসময় শূন্যদশক অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর ও শূন্যতাগ্রস্ত হলেও একজন সজল সমুদ্র আবারও আমাদের নাগার্জুনের কাছেই ফিরিয়ে নেন-‘শূন্যতাকে যিনি অনুভব করতে পারেন তিনি সবকিছুর অর্থই অনুধাবন করতে পারেন। যিনি শূন্যতাকে বোঝেন না, তিনি কিছুই বোঝেন না।’ এবং শুধু নাগার্জুনই নয়, আমাদের ফিরতে হয় লালন ফকিরের কাছেও-‘বেঁধেছে এমন ঘর, শূন্যের উপর পোস্তা করে’; বলা বাহুল্য পত্রে রচিত ভোর শূন্যের ওপর নির্মিত সজল সমুদ্রের পোস্তা ঘরেরই উপমা, অন্তত এ লেখক তা-ই মনে করে।